জীবনের শেষ অনিশ্চয়তা ছাড়াও যে অন্য অনিশ্চয়তা জীবনে উঁকি দিতে পারে, এমনকি জীবনকে সংশয়াচ্ছন্নও করে তুলতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা তো এখন আমাদের হচ্ছে। আমাদের নিশ্চয়তার অভ্যেস তাতে টাল খাচ্ছে। ঠিক আছি, তবু হঠাৎ মনে হচ্ছে, ঠিক আছি তো?
অমিয় দেব
সঞ্জয় ঘোষ সমীপেষু
সিসিফাসের কথা একদা শুনেছি। পুরাণবাগীশের বারণ সত্ত্বেও, নিজেকে খুদে সিসিফাসও ভেবেছি। পাথর ঠেলে তুলব, কিন্তু তা গড়িয়ে পড়বে, আবার ঠেলে তুলব, আবার গড়িয়ে পড়বে— এই চলবে, ঠেলে তোলা, গড়িয়ে পড়া, ঠেলে তোলা, গড়িয়ে পড়া। আমার কাজ ও পাথরের কাজে কী ভয়ানক বৈপরীত্য, অথচ এক অচ্ছেদ্য সম্পর্কও আছে। আমি না থাকলে পাথর নেই; পাথর না থাকলে কি আমি আছি? হয়তো আছি, মনুষ্যেতর (বা মনুষ্যোত্তর?) প্রাণী হয়ে। পাথর আমাকে যা দেয় তা মানুষী অস্তিত্ব, বিরূপ বিশ্বে এক আত্মপ্রণোদনা। কাম্যু পড়ার ফলেই হয়তো এমত চিত্তবৃত্তির উদ্ভব। নিজেকে অস্তিত্ববাদী ভাববার প্রয়াস। তে হি নো দিবসাঃ।
সত্যিই কি একটা সময় ছিল একদিন, যাকে আমরা বলতে পারতাম ‘আমাদের’? আমরা মানে যারা ১৯২৮ থেকে ১৯৪০-এর মধ্যে জন্মেছি। একটা সময়, কেবল গড়িয়ে পড়তে থাকা পাথর ঠেলে তুলবার নয়, জীবনে জীবন যোগ করারও বা আপন অস্তিত্বকে ঈষৎ ছড়িয়ে দেবারও? বন্ধুর সঙ্গে গড়িয়াহাট থেকে রাসবিহারী মোড় হেঁটে যাবার ও রাসবিহারী মোড় থেকে গড়িয়াহাট হেঁটে আসবার এক অনিবার্য সময়? ন্যাশনাল লাইব্রেরির ক্যান্টিনে বসে এক অন্য বন্ধুর মুখে শুধু লেনিনের নয়, পাস্তেরনাকেরও যে ‘প্রয়োজন ছিল’ সেই কথা শোনার সময়? শুধু হাততালির নয়, তর্কেরও? দক্ষিণ ও উত্তর কলকাতার দুই কবিতাপত্রিকার উত্থান ও সমকালীন সব কবিদের স্বর শুনতে পাওয়া? গল্প-উপন্যাসেও নতুন স্বাদ। আবার, আমহার্স্ট স্ট্রিট লাগোয়া এ-গলিতে ও-গলিতে সেই অন্য লিটল ম্যাগাজিনের প্রুফে মেতে থাকা, যা ছিল এক অলীক সাময়িকী? মাঝে মাঝে বনগাঁ লাইনে হাবড়া-পেরোনো এক স্টেশনে নেমে সেই মানুষটির সামীপ্য নেওয়া যাঁকে একবার গোবরা, একবার লুম্বিনি যেতে হয়েছিল আর একবার সরকারপুল? জিগেস করার ছিল না, তাঁর পুঁতে দেওয়া কবিতা কি অঙ্কুরিত হয়েছে? এখানে আড্ডা ওখানে আড্ডা, কিন্তু পায়ের তলায় মাটি। কবে কী একটা লেখা পড়ে তুমি, সঞ্জয় ঘোষ, এখনকার এক লেখক-চিত্রকর, হঠাৎ বলে ফেললে, একটা সময় বোধ করি ছিল আপনাদের। ছিল? সময়? এক বিদেশি ভাষায় যাকে ৎসাইটগাইস্ট বলে তার তুল্য এক অন্তঃস্রোত? না কি নিতান্তই দশকের দাক্ষিণ্যে এ-চরে ও-চরে জোট বাঁধা?
তার উপর, আমি তো কখনই ঠিক দেউড়ি পেরোইনি যে বলতে পারব ভিতরমহলে কী সাযুজ্য রচনা হয়ে চলছিল। যাঁরা ভিতরে ছিলেন তাঁদের অভিজ্ঞতার গল্প তাঁরা আমাকে করে থাকতে পারেন, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে আমারও সেই সমূহ অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। আমি বড়জোর সেই গল্পগুলি জুড়ে এক ইতিহাস বানাতে পারি। সেই ইতিহাসের তলায় যত দাপট করেই আমার স্বাক্ষর বসাই না কেন, তাতে অভিজ্ঞতার জারকরস সঞ্চরিত হয় না। ইতিহাস মরা, অভিজ্ঞতা জ্যান্ত। অতএব আমার কথা শুনলে তুমি ভুল করবে, সঞ্জয়, তোমার শোনা উচিত কুশীলবের কথা। আমাকে বরাত না দিয়ে তুমি সেই কালখণ্ডের যে দু-চারজন এখনও আছেন তাঁদের খুঁজে নাও, তাঁদের কাছে গিয়ে বসো।
আমি বরং তোমার ‘যামিনী কলকাতা সংবাদ’-এ পাত পাড়ি, নয়তো আমার আরেক স্নেহভাজন বন্ধুর ‘অ-নিয়ন্ত্রণরেখা’-য় ফিরে যাই, দেখি অনিশ্চয়তার পাদদেশে এখন তোমরা কী কী ফুটিয়ে চলেছ। আসলে আমার চোখের সামনেকার ওই ফুজি-শিখরের স্পর্ধিত স্ফটিক তো আমাকে অব্যাহতি দিচ্ছে না— যে তামাকো কাতাওকা কৃত প্রিন্টের কথা এই সেদিনও বলেছি। আর এই মুহূর্তের যে ত্রাস সারা ভুবন কাঁপিয়ে তুলেছে তাও কি ওই ক্ষুরধার স্ফটিকের সামিল নয়? এর বুক তার বুক সকলের বুকে বাসা বাঁধবার জন্য এক মারণ জীবাণু কেবলই এগিয়ে আসছে। ঠেলে তোলা পাথরের গড়িয়ে পড়ার একটা মানে আছে; কিন্তু এর? একেই কি বলে ‘পেস্ত্’? আমাদের মতো তোমরাও কি, সঞ্জয়, ওই কাম্যু পড়েছিলে, ওই রিয়ো ডাক্তারের গল্প, যাঁর পাশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শশী ডাক্তারকে বসিয়ে সুবীর রায়চৌধুরী ও আমার বন্ধু নবনীতা— নবনীতা দেব সেন— ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’ নামে এক মর্মস্পর্শী প্রবন্ধ লিখেছিল। এতটাই তা নাড়িয়ে দিয়েছিল এক তদাতরুণকে যে তার শেষ অসুখ যখন গাঢ় হয়ে উঠবে, তখন এ নিয়ে এক সংশয় তার মনে গুমরে উঠেছিল। আর এই নভেম্বরের গোড়ায়, নবনীতার অদম্য প্রাণশক্তি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কি তার ঈশ্বর চোখ চেয়ে দেখলেন না? না কি কেউ কেউ বলবেন তিনিই তাকে কোলে তুলে নিলেন?
আবার যাঁরা বস্তুবাদী তাঁরা বলবেন তাঁদের অন্বেষা নিশ্চয়কে নিয়েই, তাঁরা অনিশ্চয়ের ফেরে পড়তে চান না। কিন্তু তাঁদেরও যে বিস্ময়বোধ নেই তা তো নয়। কী একটা ঈশ্বরকণার গল্প তো একবার চাউরও হয়েছিল : ‘সে কি খুঁজে পেল ঈশ্বরকণা’ নামের কবিতাবইতে কি তা দোল খেয়ে যায়নি? আর কত গবেষকই তো আজ ‘কোভিড-১৯’-এর মর্মোদ্ধারে ডুবে আছেন। আর তুমি, সঞ্জয়, পেশায় ডাক্তার, তোমার কাছে তো বস্তুই মুখ্য, তোমার সাধনা নিশ্চয়েরই। আবার তুমি যে লেখ, ছবি আঁক, তার কি উৎস নয় কোনও বিস্ময়— বস্তুজগৎ থেকেই উঠে আসা কোনও বিস্ময়— এবং তা কি তোমাকে কখনও অনিশ্চয়ের দিকেও ঠেলে দেয় না? জানি না, জিগেস করছি। না কি তুমিও প্রকৃতিবাদী, বস্তুর অন্তর্গত অঙ্কই কষে যাচ্ছ? রহস্য শব্দটাই কি তোমার কাছে ট্যাবু? আশা করি, না।
দু’সপ্তাহ আগে এক সভায় গিয়েছিলাম করোনা-সংক্রমণরোধক মাস্ক পরে। (আর কেউ তা পরে আসেননি।) এক সুহৃদ বললেন, সে কী, এটা কেন? আমি বললাম, শঙ্কা। ওই নির্দ্বিধ নিশ্চয়ের জগতে সারাক্ষণই খানিক অবান্তর লাগছিল নিজেকে : অনিশ্চয়ের বার্তা বয়ে না আনলেই বোধহয় ভাল হত। অথচ তখন অনিশ্চয় তো অদূরে দাঁড়িয়ে। তারপরেই এক এক করে জারি হতে লাগল নিষেধাজ্ঞা। সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনে সভাসমিতি বন্ধ হল। আর গোড়ায় কারও কারও অপরিণামদর্শিতায়ই বলব, সংক্রমণও শুরু হল। অন্যে আক্রান্ত হলেও আমি আক্রান্ত হব না, বা আমি আক্রান্ত হলেও অন্যকে সংক্রমিত করব না— এমন নিশ্চয়তাই কি আমাদের বেপরোয়া করে তোলে? অন্যদিকে, আরেকজন শেষ দূরপাল্লার ট্রেন থেকে শিয়ালদায় পৌঁছে যথারীতি পরীক্ষিত হয়ে, লোকালে আপন স্টেশনে নেমে সোজা বাড়ি না গিয়ে প্রথমে স্বেচ্ছায় থানায় যায়, এবং থানা থেকে হাসপাতালে প্রেরিত হয়ে ফের পরীক্ষিত হয়, এবং পরীক্ষায় অনাক্রান্ত ঘোষিত হলেই তবে সে শংসাপত্র হাতে করে অবশেষে বাড়ি আসে; কিন্তু বাড়ি এসেও সে সুস্থির হয় না, অন্যদের থেকে এক আলাদা ঘরে, পুরসভা নির্ধারিত চৌদ্দ দিন নিজেকে বন্ধ করে রাখতে প্রস্তুত হয়— এত সব সে করে শুধু উপস্থিত অনিশ্চয়তাকে মাথায় রেখে। তাকে কি আমরা বাধাই দেব না? পেশায় সে মুক্তদ্বার নর্তক, অর্থাৎ লঘু বিনোদনশিল্পী, কিন্তু সেই জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীর মতো নয়, যিনি এই অনিশ্চয়তার আবহেও সোজা এয়ারপোর্ট থেকেই নাকি গানের জলসায় চলে যান। ওই নর্তকের কথা বুঝি দুশো তিরিশ বছর আগে টমাস গ্রে লিখে গেছেন, ‘সাম মিউট ইনগ্লোরিয়াস মিল্টন’।
জীবনের শেষ অনিশ্চয়তা ছাড়াও যে অন্য অনিশ্চয়তা জীবনে উঁকি দিতে পারে, এমনকি জীবনকে সংশয়াচ্ছন্নও করে তুলতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা তো এখন আমাদের হচ্ছে। আমাদের নিশ্চয়তার অভ্যেস তাতে টাল খাচ্ছে। ঠিক আছি, তবু হঠাৎ মনে হচ্ছে, ঠিক আছি তো? ঈর্ষা করি সেই বিরল প্রতিবেশীকে যার দিনানুদিন নয় ভবিতব্যভারাতুর। অথচ, এক দূরের বন্ধু লিখেছেন, এই মন্দেরও ভাল আছে। তলস্তয়ের ‘ইভান ইলিয়িচের মৃত্যু’ কি একদিক থেকে ইভান ইলিয়িচের জীবনই হয়ে ওঠেনি? হয়তো এই অনিশ্চয়তা আমাদের নতুন করে বাঁচতে শেখাচ্ছে। নিশ্চয়ের গতানুগতিকতা ফেঁড়ে ভবিতব্যের দ্বার খুলে দিচ্ছে। আর এও কি নয় এক ‘কবিতার মুহূর্ত’?
মন ছুয়ে গেল।