মানুষের প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে হরেক রকম দ্রব্যের উৎপাদনে যন্ত্রপাতি তৈরির জায়গাটিতেই প্রযুক্তির আনাগোনা। প্রত্যক্ষভাবে বিজ্ঞানীদের দেখানো পথে বাস্তবে সেই কাজ প্রয়োগের মাধ্যমে করে দেখানোর দায়িত্ব থাকে বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রযুক্তিবিদদের হাতে।
শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য
গপ্পো তক্কো যুক্তি : যাহা বিজ্ঞান তাহাই কি প্রযুক্তি
‘আমি ব্যক্তি-ঈশ্বরের কল্পনা করতে চাই না, আমরা আমাদের অসম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়ের সহায়তায় যে মহাবিশ্বের গড়ন এখনও পর্যন্ত সম্যক বুঝতে পেরেছি, এতেই শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়ে আমরা আপ্লুত।’ –আলবার্ট আইনস্টাইন।
সুপার ডিজিটাল যুগের হাওয়ায় হাওয়ায় মোবাইল টাওয়ারের সিগন্যাল, সুনীল সাগরের গভীরে ফাইবার অপটিক কেবল্, বৃষ্টি-অরণ্যের নীচে ড্রিল মেশিনের একচেটিয়া দাপুটে ঝংকার। এগুলো আজকের জগতের বাইরের কয়েকটি দিক। অন্যদিকে, দ্রুত বদলাতে থাকা এই জগতের সঙ্গে পাল্লা দিতে চার দেয়ালের ভেতরে ছয়-সাত বছরের শিশুরা বাবা-মায়ের উত্তুঙ্গ উৎসাহে চটপট শিখে নিচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির অ-আ-ক-খ।
বিশ বছর আগে বাবা যখন কলেজে পড়তেন, তার পড়াশোনার বিষয় ছিল পদার্থবিদ্যা। ইদানীং চাকরি করছেন এক বিমা কোম্পানিতে। ভাইরাসের প্রকোপ সংক্রান্ত তথ্য, ভাইরোলজির বেসিক, মৃত্যুর হার ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে নতুন একটি বিমার সফল প্রয়োগে মন্দায় থাকা কোম্পানিটিকে ভরাডুবি থেকে বাঁচাতে চাইছেন। বাঁচাতে না পারলে চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। মায়ের কলেজের বিষয় ছিল প্রাণীবিদ্যা। তিনি এখন চাকরি করেন ব্যাঙ্কে। কয়েক মাস হল বাড়িতে বসেই অনৈচ্ছিক ছুটি কাটাচ্ছেন। কারণ। ব্যাঙ্কের সমস্ত পুঁজি নিয়ে উধাও হয়েছেন জনৈক হিরে ব্যবসায়ী। বলা বাহুল্য, পারিবারিক এই পরিস্থিতি মোটেই সুখের নয়। আগুপিছু খুঁটিনাটি বিচার করে তারা শেষে এই উপসংহারে দাঁড়ালেন যে পদার্থবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেলে আগামীতে আরও বিদঘুটে পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে তাদের সন্তানদের। সামাজিক মাধ্যম, প্রতিবেশী, অফিসের বড়বাবুরাও বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা তো বটেই, বরং তার সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত কোর্সগুলিতে ছেলেমেয়েকে এখন থেকেই তালিম দিলে অন্তত জীবিকার দিক থেকে তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত। বাবা-মা দু’জনেই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এই বিষয়ে অল্পবিস্তর কাটাছেঁড়া করলেন। অবশেষে কড়া সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই হল ভবিষ্যৎ জীবিকার সর্বোত্তম পথ। সন্তানের বরাবরের ঝোঁক রসায়নের দিকে হলেও বাবা-মায়ের হালে আমদানি করা প্রযুক্তিমনস্ক কথাবার্তায় সেও বুঝে নিল যে, প্রযুক্তির অপর নামই হল বিজ্ঞান। আইআইটি-তে প্রথম র্যাঙ্ক বাগিয়ে নেওয়া ছাত্রটির মতো বিজ্ঞান জানা ছাত্র ভারতে খুব কমই আছে। কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো অঙ্ক, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি জেনে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির খুঁটিনাটি আগাম বুঝে সঠিক চাকরি বাগিয়ে নেওয়াই হল প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয়।
সকালের ঘুমকাটা আলসে হাই থেকে রাতে বিছানায় শরীর ছুড়ে ফেলার মধ্যের সময়টুকুতে বিজ্ঞান বলতে অনেক মানুষই বোঝেন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, এলইডি টিভি, অটোমেটিক ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি। ঘরভর্তি ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের সঙ্গে দৈনিক কারবার মানেই হল বিজ্ঞানভিত্তিক যাপন। কয়েক দশক হল এই যাপন এক পরিবার থেকে আর এক পরিবারে জারিত হয়েছে। পরিবারগুলি মূলত মধ্যবিত্ত। জোর দিয়ে বলা যায়, এইসব পরিবারের অনেক ছেলেমেয়েই লাইফ সায়েন্স হোক বা কম্পিউটার সায়েন্স, সবেতেই দারুণ নম্বর পেয়েছে। তাদের মধ্যে ক’জনই বা জানে কোপার্নিকাস আর জিওর্দানো ব্রুনোর কথা!

১৬০০ সাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি। এই দিনেই জিওর্দানো ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তাঁর অপরাধ, তিনি ছিলেন এক বেপরোয়া সত্যসন্ধানী। কোপার্নিকাসের নিষিদ্ধ বই লুকিয়ে পড়তেন। সেই বই হাতে নিয়ে যাজকের ছদ্মবেশে পাহাড়ি পথ ধরে তিনি গিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডে। সেখান থেকে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি। সাধারণ মানুষের অন্ধবিশ্বাস ভেঙে তাদের মধ্যে সত্যের ধারণা পৌঁছতে থাকেন ব্রুনো। কী সেই সত্য? পৃথিবীই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। উল্টোটা নয়। কোপার্নিকাসের পর্যবেক্ষণ সে কথাই বলে। এই তত্ত্ব সত্য হলেও তা ছিল গির্জা-বিরোধী। তখনকার দিনে গির্জার বিপক্ষে কথা বলা ছোটখাটো বেয়াদবি নয়, রীতিমতো বিদ্রোহের সামিল। বিপদকে তোয়াক্কা না করে এই সত্যের প্রচার করায় রোমের ঘাতকরা ব্রুনোকে বন্দি করে। বিনা রক্তপাতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। মানে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ। জনতার মাঝে হাত-পায়ে শিকল বেধে তাঁকে আনা হয়। ধর্মের বিপক্ষে যাতে আর কিছু বলতে না পারেন তাই পেরেক ফুটিয়ে তাঁর জিভ ঠোঁটে আটকানো। অসত্য বলে ছাড়া পাওয়ার শেষ সুযোগ পেয়েও তিনি ছিলেন অদম্য। আগুন জ্বলে ওঠে। ছাই হয়ে যান জিওর্দানো ব্রুনো।
কোপার্নিকাস বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। এখন আমরা জানি এটাই অমোঘ সত্য। যদিও খালি চোখে দেখে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করা তখন সম্ভব ছিল না। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব থাকলেও কোপার্নিকাসের ছিল অনুসন্ধিৎসু সত্যান্বেষী মন। এই মন নিয়ে চলতে থাকে অনুমান এবং পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণকে খাতায় কলমে প্রমাণ করার বিরামহীন এক প্রক্রিয়া।
এই অনুসন্ধান আসলে প্রকৃতির নিয়মকানুনগুলিকে বুঝে ওঠারই এক নিবিড় প্রচেষ্টা। প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে সত্যান্বেষণের এই সুন্দর প্রক্রিয়াটি হল বিজ্ঞান। বিজ্ঞানই হল সমস্ত আবিষ্কারের সম্মিলিত সামাজিক জ্ঞানের ভাণ্ডার আর এই জ্ঞানের ভাণ্ডারকে পাথেয় করেই প্রকৃতির অজানা দিকটিকে খুঁজে ফেরার নামই হল আবার বিজ্ঞান। মানুষের অর্জিত সমস্ত জ্ঞানই আসলে সামাজিকভাবে তৈরি হওয়া মানুষের সম্মিলিত সম্পদ। ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’-র জন্য আমরা আইনস্টাইনের কাছে ঋণী কিন্তু ভুললে চলবে না যে, এই জ্ঞান আসলে মানব সভ্যতার সমবেত বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান। আগের প্রতিষ্ঠিত সূত্রের ওপর দাঁড়িয়েই গড়ে ওঠে নতুন সূত্র। নিরন্তর চলতে থাকে এই প্রক্রিয়া। তত্ত্ব থাকলে তার প্রয়োগও থাকবে। আর এইখানেই পাকাপাকি জায়গা করে নেয় প্রযুক্তি।
বিজ্ঞানের হাত ধরে বিজ্ঞানের প্রয়োগের জগৎটিকেই বলা হয় প্রযুক্তি। মানুষের প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে হরেক রকম দ্রব্যের উৎপাদনে যন্ত্রপাতি তৈরির জায়গাটিতেই প্রযুক্তির আনাগোনা। প্রত্যক্ষভাবে বিজ্ঞানীদের দেখানো পথে বাস্তবে সেই কাজ প্রয়োগের মাধ্যমে করে দেখানোর দায়িত্ব থাকে বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রযুক্তিবিদদের হাতে। প্রয়োগগত দিক থেকে দেখলে এই ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রযুক্তিবিদদের দায়িত্ব কোনও অংশেই কম নয়। হিতোপদেশের মতো কত বইতেই না লেখা আছে যে বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রযুক্তির মিলিত ব্যবহার মানুষের ভালর জন্য। যদিও আজকের উৎপাদন ব্যবস্থায় যে বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তির গবেষণা ও বিকাশ ঘটে চলেছে তার দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য— পুঁজির কেন্দ্রীভবন এবং যুদ্ধের প্রয়োজন সাধন। বছরের পর বছর এই অনুশীলনের পরিণাম বিশ্ব উষ্ণায়ন, বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা।

বর্তমান সামাজিক কাঠামোয় প্রযুক্তির সঙ্গে পণ্য উৎপাদনের আবার গভীর যোগাযোগ। এই পণ্য থেকেই তো আসে মুনাফা। যদিও বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হল প্রকৃতির নিয়মগুলিকে জেনে-বুঝে প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক বজায় রেখে সামগ্রিক বিকাশের দিকে এগিয়ে যাওয়া যা পৃথিবীকে আরও সুন্দর করার পথ গড়ে তোলা। বিজ্ঞান যেমন মানুষের ব্যবহারিক জগৎকে মজবুত করে ঠিক তেমনই প্রযুক্তির ব্যবহার মজবুত করে বিনিময়মূল্যের জগৎকে, লেনদেনের জগৎকে, বাণিজ্যের জগৎকে। ব্যবহারিক জগৎকে মজবুত করতে দরকার মানুষের সহজাত বুদ্ধি যা অজানাকে জানতে চায়। প্রকৃতির রহস্য ছেনে বের করতে চায় প্রকৃত জীবন গড়ে তুলতে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরমাণুলোক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সূর্য পৃথিবীর থেকে আছে দূরে। কম দূরে নয়, প্রায় ন’কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল তার দূরত্ব।… মানুষের বুদ্ধির দৌড় তার বোধের চেয়ে আরও অনেক বেশি, জগতের সকল দৌড়ের সঙ্গেই সে পাল্লা দেবার স্পর্ধা রাখে। সে এই প্রকাণ্ড জগতের প্রকাণ্ড মাপের খবর জানতে বেরল, অনুভূতির ছেলেভুলানো গুজব দিলে বাতিল করে। ন’কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইলকে আমরা কোনওমতেই অনুভব করতে পারি নে, কিন্তু বুদ্ধি হার মানলে না, হিসেব কষতে বসল।’
অন্যদিকে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্তর্নিহিত বুদ্ধির চরিত্রটি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। এই বুদ্ধির ব্যবহার আপাতঅর্থে মানবকল্যাণে হলেও আসল উদ্দেশ্য এতদিনের জমানো সম্পদের সুরক্ষা। এই সম্পদ মূর্ত প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, বিমূর্ত ডলার সাম্রাজ্য। বস্তুত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বর্তমান ব্যবহার হল জল, জঙ্গল, জমিনের লাগামছাড়া অপচয় করে এই সর্বনাশা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাটিকে যেনতেনপ্রকারেণ টিকিয়ে রাখা।
বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরু থেকেই রকফেলার, মেলন, ফোর্ড, ডুপন্ট প্রমুখ অতিকায় একচেটিয়া শিল্প-ঘরানা থেকে আজকের বিল গেটস, ল্যারি পেজ, মার্ক জুকেরবার্গ, জেফ বেজোস— সকলেই এই আর্থ-সামাজিক কাঠামোর ফসল। তথ্য খোঁজার জন্য অমলকান্তির এখন একটাই পথ, গুগলং শরণং গচ্ছামি। কারণ, তথ্য খোঁজার ক্ষেত্রে গুগলের একচেটিয়া রাজত্ব। এই একই নিয়মে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মানুষের মধ্যে অনলাইন সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুরাহা একমাত্র ফেসবুকের জিম্মাতেই থাকতে হবে। তথ্যনির্ভর সঙ্গীতজগতের যে বিশাল বাজার তার পঁচাত্তর ভাগই অ্যাপেল (Apple) নামক বহুজাতিক সংস্থার দখলে। অ্যাপেল যেসমস্ত মূল্যবান প্রযুক্তির সাহায্যে তথ্যজাত দ্রব্যগুলি প্রস্তুত করে তা একমাত্র অ্যাপেল নির্মিত যন্ত্রগুলির সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। ধরা যাক, বব ডিলানের এর ‘লাইক আ রোলিং স্টোন’ গানটির আই টিউন ট্র্যাকটির কথা। স্যামসাং-এর অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে কিন্তু এই আই টিউন ট্র্যাকটির মজা নেওয়া যাবে না। তার কারণ, সেটি ব্যবহার করার জন্য যে বিশেষ সফ্টওয়্যার দরকার হয় তা সম্পূর্ণরূপে অ্যাপেলের হাতে। অতএব কান পেতে উচ্চমানের সাঙ্গীতিক আনন্দ নিতে অ্যাপেলের ঠিক করে দেওয়া আর্থিক মূল্যেই সেই সফ্টওয়্যারটি কিনতে হবে। এই বিশেষ সফ্টওয়্যারটির ক্ষেত্রে অ্যাপেলের রয়েছে একচেটিয়া বাজার।

মাইক্রোসফ্টের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস প্রথম জীবনে বেসিক (BASIC) নামের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজটি তৈরি করেছিলেন। এইবার এই ব্যক্তিগত শ্রমের ফসল কোনওরকম বিনিময়মূল্য ছাড়াই সামাজিকভাবে ভাগ বাঁটোয়ারা হতে থাকলে মালিকের কাছে তা মোটেই সুখবর নয়। এ কারণেই বিল গেটস এইসব বিনিপয়সার উপভোক্তাদের উদ্দেশে এক চিঠিতে বলেছিলেন, “Most of you steal your software. [You believe] hardware must be paid for but software is something to share, who cares if the people who worked on it get paid”। পরক্ষণেই তিনি অপারেটিং সিস্টেম এবং প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের ওপর মালিকানা কায়েম করে মনোপলির হাত ধরেই বিপুল ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। তুখোড় মস্তিষ্কের অধিকারী বিল গেটস নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, এই কম্পিউটার প্রযুক্তির পেছনে বড় অবদান রয়েছে পরমাণু বিজ্ঞানের জ্ঞানের। জ্ঞান সামাজিক বলেই বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলিকে পরবর্তী আবিষ্কারের রসদ হিসেবে দেখা হয়। প্রশ্ন ওঠে— আইনস্টাইন, ম্যাক্সওয়েল, মাদাম ক্যুরি এবং আরও অনেক মহামতি বিজ্ঞানসাধক তাঁদের আবিষ্কারকে মানবিক এবং সামাজিক বিকাশের লক্ষ্য থেকে সরিয়ে বিল গেটসের মতো যদি মনোপলির গণ্ডিতে বেঁধে রাখতেন, পরিণাম কী হত? আর কিছু না হোক, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তৎকালীন মধ্যবিত্ত মেধাবী ছাত্র বিল গেটসের বর্তমানের ধনকুবের হয়ে ওঠার পথ মোটেই এত মসৃণ হত না।
যুবক আইনস্টাইন নিজে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পারদর্শী কিন্তু তিনি যন্ত্র এবং প্রযুক্তির ঘেরাটোপে আটকে থাকেননি। বিশেষ কিছু মানুষের স্বার্থে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে বিলিয়ে দেননি নিজেকে। বাবার সঙ্গে তাঁর ঘোর বিরোধ ছিল এই জায়গায়। আইনস্টাইন সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর একমাত্র কাজ হল বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা। প্রকৃতির অজানা রহস্যগুলিকে নিয়ে নিরন্তর চিন্তা এবং সেই রহস্যের উন্মোচনে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া। এই কাজের মধ্যে দিয়েই ভবিষ্যতের বিজ্ঞান যাতে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে তার জন্য আগাম মাটি তৈরি করা। খুদে পড়ুয়াদের উদ্দেশে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘মনে রাখবে যে বিস্ময়কর জিনিসগুলি তোমরা শিখছ বিদ্যালয়ে সেগুলি বহু প্রজন্মের কাজ, পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের উৎসাহ, প্রচেষ্টা এবং নিরন্তর শ্রমের থেকেই তৈরি। এইসব তোমাদের হাতে দেওয়া হয়েছে উত্তরাধিকারসূত্রে যাতে তোমরা এইগুলি গ্রহণ করতে পারো, সম্মান দিতে পারো, সংযোজন করতে পারো এবং কোনও একদিন বিশ্বাসের সঙ্গে এইসবই পরবর্তী প্রজন্মের হাতে পৌঁছে দিতে পারো।’ এসব শুধুমাত্র তাঁর মুখের কথা নয়। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজ্ঞানের বিস্তর ফারাকের কথা বুঝিয়ে নিজের ছেলেকেও বিজ্ঞানের সাধনায় নিযুক্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন আইনস্টাইন। যদিও তাঁর ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিংকেই ভবিষ্যতের পাথেয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয় যে, এই মহৎ মানুষটির নাম ব্যবহার করে কিছু বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা তথ্য-পণ্য বিক্রি করে মোটা টাকা কামাতে চাইছে। তাদের তৈরি সফ্টওয়্যারকে জনপ্রিয় করে তুলতে বলা হচ্ছে ‘Einstein loves data’। অথচ ডেটা হচ্ছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অবিচ্ছেদ্য বিপুল সংখ্যক ঘটনার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আইনস্টাইনের বৃহৎ কর্মকাণ্ড থেকে মানুষের চোখ সরিয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থে তথ্যপ্রযুক্তির এক ক্ষুদ্র জগতে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে নিজের মতো করে ভেঙেচুরে সাজিয়ে কত সহজে আজকের ছেলেমেয়েদের মনের ভেতর বিজ্ঞানকে প্রযুক্তির সমার্থক হিসেবে পেশ করা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তথ্যসমৃদ্ধ লেনদেনের গোলকধাঁধায় আটকে পড়ে প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠাকেই আজকের প্রজন্ম বিজ্ঞান শিক্ষা হিসেবে ধরে নিচ্ছে। এই শর্টকাট পদ্ধতিটি আঁকড়ে ধরে মোটা মাইনের কাজ পাওয়া গেলেও অধরা থেকে যাচ্ছে পর্যবেক্ষণ থেকে চিন্তা ও সেখান থেকে জ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রটি। অধরা থেকে যাচ্ছে বিজ্ঞান পাঠের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় কথোপকথন।
ইদানীং বিভিন্ন সেমিনারে বিজ্ঞানের কথা উঠলেই ঘুরেফিরে আসছে মূলত প্রযুক্তির কথাই। কিছু সূত্র এবং উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একটি রোবট তৈরি করতে পারলেই যেন বিজ্ঞানের জয়গান গেয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু সমাজে এই রোবটের সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে চিন্তিত নয় এই প্রজন্মের খুব টেকনিক্যাল ছেলেমেয়েরা। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি কি আদৌ বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দেয়! তারা বোঝে না, অর্থনৈতিক বৈষম্য বজায় রাখতে বিজ্ঞান প্রসারের নামে আসলে তাদেরকেই সুকৌশলে ভবিষ্যতের ডিজিটাল শ্রমিক তৈরির কর্মযজ্ঞ চলে। ইন্টারনেটে ছয়লাপ বিভিন্ন কোর্সগুলি প্রযুক্তিবিদ্যার উপকরণ ও মালমশলার পসরা নিয়ে হাজির হয় এই কর্মকাণ্ডেরই শরিক হয়ে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে উচ্চস্তরে তুমুল গবেষণা চলতে থাকে এই উৎপাদন ব্যবস্থার কোনওরকম ক্ষতি না করেই। যেসব গবেষণা বর্তমানের সামাজিক কাঠামোটিকে চ্যালেঞ্জ করে বসে, সুচতুর কায়দায় তা উধাও করে দেওয়া হয়। কেউ জানতেও পারে না।
অমলকান্তির বন্ধু রোবট তৈরিতে হাত পাকিয়েছে। সহজাত বুদ্ধিকে সে এখন কাজে লাগায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির জন্য। তার বানানো একটি রোবট কতরকমের কঠিন কাজ অবলীলায় করে ফেলছে। কত বাহবা, কত পুরস্কার সে পায়। একজন পুরোদস্তুর বিজ্ঞানীর চেয়ে সে কম কীসে! অর্থ, প্রতিপত্তির চূড়ায় বসে সে নিজেকে এক মহৎ কর্মকাণ্ডের একজন মনে করে। সে সবসময় রোবট নিয়ে ভাবে। নির্জন সৈকতে দাঁড়িয়েও তার চিন্তায় কেবলই ঘুরেফিরে আসে রোবট। কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরও লাভজনক প্রয়োগ করা যায়, তাই নিয়ে সে মশগুল হয়ে থাকে। সে অবশ্য জানে পরমাণু বিজ্ঞানের কথা, রোবোটিক্সের বিকাশে পরমাণু বিজ্ঞানের বিপুল অবদানের কথা। অণু-পরমাণু নিয়ে পদার্থবিদ্যায় তার গবেষণার কাজটি ছিল তাক লাগানো।
রোবটের চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকা অমলকান্তির এই প্রতিভাবান বন্ধুটি বিশাল সমুদ্রকে চোখের সামনে পেয়েও আজকাল আর ভাবে না, ছোট-বড় ঢেউগুলির অবিরাম আন্দোলন, সেই ঢেউয়ের গভীরে কত অণু-পরমাণু! একটি আর একটিকে নিয়ে মোটেই ভাবিত নয়। কত দূরত্ব তাদের মধ্যে অথচ তারাই একত্রে কী আশ্চর্য এক প্রক্রিয়ায় ফেনিল সফেদ ঢেউ গড়ে তুলছে একটার পর একটা! দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ। অথচ একসময় তাদেরকে প্রশংসার চোখে দেখার সেই চোখটিই ছিল না। মানুষ ছিল না, প্রাণ বলেই কিছু ছিল না! তবুও তো তীব্র জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আছড়ে পড়েছে একের পর এক ঢেউ, কার জন্য? কেন? এই পৃথিবীতে, বিরামহীন স্রোতে, শক্তির প্রভাবে জর্জরিত! শক্তি! তা কি শুধুই সূর্যের অহেতুক সাদামাটা অপচয়! দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে, সমুদ্রের গভীর থেকে গভীরতর অঞ্চলে এইসকল অণু কতরকমের আকার নিয়ে আবার ফিরে আসে, নতুন আকৃতিতে বদলে যায়, কত জটিল সেই আকৃতি! নিজেদেরকে অন্যের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে অণুগুলি পাগলের মতো নাচতে থাকে, ছটফট করতে থাকে, ক্রমশ আকারে তারা বড় হয়, জটিল থেকে আরও জটিল, প্রাণ আসে পৃথিবীতে, অনেক অণুর সম্মেলনে ভর তৈরি হয়। ডিএনএ, প্রোটিন। আবার নাচ শুরু হয়। অনেক বেশি জটিল এই নাচ। তারপর জল থেকে আস্তে আস্তে ডাঙায় উঠে আসে প্রাণ, অণু থেকে অণুর সংযোগে চেতনা, প্রকৃতির সঙ্গে অনবরত আদানপ্রদানে গড়ে ওঠে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ মানুষের মস্তিষ্ক! ক্রমে আসে কৌতূহল, কল্পনা।
সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে অমলকান্তির বন্ধুর গভীর প্রযুক্তিমনস্কতায় কিছুতেই গড়ে ওঠে না বিস্ময় থেকে আরও বিস্ময়। সে নিজের মনে বলে ওঠে না, প্রকৃতির মাঝে মানুষ, আমি, আমি একাই অণু-পরমাণুর এক জটিল বৃহৎ বিশ্ব, আবার একইসঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একটিমাত্র অণুর মতোই কতই না সামান্য!
ছবি : ইন্টারনেট
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ১
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ২
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ৩
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ৪
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ৫
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ৬
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ৭
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ৮
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ১০
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ১১
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ১২
প্রযুক্তি, তক্কো, গপ্পো পর্ব ১৩
সমৃদ্ধ হচ্ছি।