ইংরেজিতে যাহাকে সুপারস্টিশন বলে, বাংলায় তাহারই নামান্তর করা হয় ‘‘কুসংস্কার’’। ঐ জিনিসটার প্রতি কটাক্ষপাত নিবারণের জন্য একশ্রেণীর লোকে একটা বড় গোছের জুজু পুষিয়া থাকেন, তাহার মন্ত্র “দেয়ার ইজ এ সুপারস্টিশন ইন এ্যভয়ডিং সুপারস্টিশন’’ অর্থাৎ কুসংস্কার বর্জনের প্রয়াসটাও একটা কুসংস্কার।
সুকুমার রায়
সত্যিকার বাস্তব খবরের চাইতে অমূলক বাজার-গুজবের প্রতিপত্তি যেমন প্রবল, স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষের তুলনায় অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্টের মোহপ্রভাব তেমনি অনেক বেশি। স্পষ্টভাবে যাহাকে দেখি শুনি ও জানি, তাহাকে নাড়িয়া-চাড়িয়া দুকথায় তাহার নাড়ীনক্ষত্রের হিসাব ফুরাইয়া যায়, কিন্তু যাহাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, সম্ভব-অসম্ভব নানা ডাল-পালায় পল্লবিত হইয়া সে মনের কল্পনাকে ভরাট করিয়া রাখে। তাই প্রত্যক্ষ আলোকের চাইতে অস্পষ্টতার আবছায়াই মনের মধ্যে অধিক সম্ভ্রমের সঞ্চার করে। স্পষ্ট শাসনের ভয়ে যে শিশু বিব্রত হয় না, সেও দেখি “জুজু’’ নামক অনির্দেশ্য পদার্থটিকে যথেষ্ট খাতির করিতে জানে।
এই অস্পষ্টতার আবরণ দিয়া মানুষ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই নানারকম জুজু পুষিয়া থাকে। কতকগুলি পরিচিত নাম বা দু-দশটা প্রচলিত বচনকে গাম্ভীর্যের মুখোশ পরাইয়া এমন বড়-বড় আসনে বসাইয়া রাখে যে তাহাদের সম্বন্ধে তর্কবিচারের চেষ্টাও বেয়াদবির নামান্তর বলিয়া গণ্য হয়। ব্রহ্মচর্যের অক্ষয়মাহাত্ম্য অস্বীকার করিবার জো নাই। কিন্তু বালবিধবার প্রবোধচ্ছলে সে মাহাত্ম্যের উচ্ছ্বসিত কীর্তন যে অনেক স্থলেই জুজু দেখাইবার আড়ম্বর মাত্র এরূপ সন্দেহ করা অসঙ্গত নয়। ভারতের অধ্যাত্ম-সম্পদ কিছু অবাস্তব কল্পনা নয়, কিন্তু সাত্তিকতা ও আধ্যাত্মিকতার বাহুল্য বর্ণনায় মন যে অকারণ সম্ভ্রমে ভরিয়া ওঠে, তাহা অনেক স্থলেই নিছক জুজুতন্ত্রের নিদর্শন মাত্র। মোটকথা, অস্পষ্ট তত্ত্ব ও অনির্দিষ্ট সংস্কারকে যথাসম্ভব স্পষ্ট ও গভীর ভাষায় ব্যক্ত করিলে তাহাতে অল্পায়াসে অনেকখানি ফল পাওয়া যায়। তর্কস্থলে প্রতিপক্ষের মুখ বন্ধ করা যখন আবশ্যক হয়, তখন এইরূপ দু-একটি জুজুকে অকস্মাৎ আসরে নামাইলে, তাহার ফলটি হয় ঠিক চলন্ত রেলগাড়ির মুখে লালবাতি দেখাইবার অনুরূপ।
প্রবল তর্কের উৎসাহমুখে, ‘‘দিন আগে না রাত আগে?” বলিয়া সুকৌশলে একটা বিরাট সমস্যার অবতারণা করিলে, বেহিসাবী সাধারণ লোকে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত করিয়া বসে যে, ইহার পরে আর তর্ক চলে না। কিন্তু স্পষ্ট-বুদ্ধির সতর্কতা কোমর বাঁধিয়া বলে যে তর্কবিচার করিতে হয় তো এইখানেই করা দরকার। এইখানেই বিশেষভাবে স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন যে দিবারাত্রির এই আপাতভীষণ দ্বন্দ্বটা একটা নিতান্তই মোটা কৃত্রিম তর্ক মাত্র। দিন এবং রাত, ভিতর ও বাহিরের মতো, উত্তর ও দক্ষিণের মতো, কাগজের এপিঠ-ওপিঠের মতো, শাশ্বতকাল একই বাস্তব আইডিয়ার দুই মাথায় বসিয়া আছে। শাশ্বত কাল হইতে যেখানে-যেখানে সূর্য প্রদীপ্ত হইয়াছে, সেখানে-সেখানেই নানা ছন্দে নানা বিচিত্রতালে দিবারাত্রির যমজলীলার অভিনয় চলিয়াছে। এই পৃথিবীও যখন আপনার স্বতন্ত্রজীবনে প্রথম সূর্যালোক প্রত্যক্ষ করিয়াছিল, তখন হইতেই আলো-আঁধারের একই চক্রে দিবা-রাত্রি গণনার সূত্রপাত হইয়াছিল। সেইরূপ ‘‘বীজ আগে না গাছ আগে” এই প্রশ্নেরও একটা সম্মোহন মূর্তি আছে। শুনিলেই মনে হয় একটা বিরাট নিরুত্তর সমস্যা, তাই মানুষ সসম্ভ্রমে পথ ছাড়িয়া দেয়। কিন্তু সতর্ক সহজ বুদ্ধি চোখে আঙুল দিয়া দেখায় যে জড় ও চেতনের সন্ধিমুখে জীবনের আদি উন্মেষ যেখানে, সেখানে বীজও নাই, বৃক্ষও নাই, কেবল আকার বৈচিত্র্যহীন জীবকোষ পরিপুষ্টির আতিশয্যে ফাটিয়া দুখান হয়, ‘‘এক’’ সেখানে সাক্ষাৎভাবে ‘‘দুই’’ হইয়া বংশ বিস্তার করিতে থাকে। ক্রমে জীবন-রহস্যের জটিলতা যখন বাড়িয়া পরিণত ও অপরিণত জীবের প্রভেদ স্পষ্ট হইয়া ওঠে, জীবাবস্থা ও বৃক্ষাবস্থার স্বাতন্ত্র্যকল্পনা যখন সম্ভব হয়, তখন সেই একই সম্ভাবনার যুগলচিত্র বৃক্ষ ও বীজের অবিচ্ছিন্ন দ্বন্দ্বের মধ্যে যুগপৎ প্রকাশিত হয়। দ্বন্দ্বটা যে কি এবং তাহার প্রতিষ্ঠাভূমি কোথায়, এরূপ স্পষ্টভাবে ঘাঁটাইয়া না দেখিলে, তাহা যেকোনো ঝাপসা তর্কের ও নৈয়ায়িক আগাছার উর্বরক্ষেত্র হইয়া উঠিতে পারে। কাৰ্যটা যেভাবে স্থূল ও সূক্ষ্ম কারণের মধ্যে বীজাকারে নিহিত থাকে, বৃক্ষটা ঠিক সেইরূপ সূক্ষ্মভাবে বীজের মধ্যে “একাধারে’’ ‘‘অপ্রকট’’ থাকে কিনা, এবং বীজটা যদি উপাদান কারণ হয় তবে বৃক্ষের নিমিত্ত কারণটা ঐ বৃক্ষবীজ-সম্বন্ধেরই অঙ্গীভূত কিনা, কাৰ্য ও কারণ এবং বৃক্ষ ও বীজ, কৃতকৰ্ম ও অকৃতকৰ্ম এবং বাস্তববৃক্ষ ও বৃক্ষসম্ভাবনা ইহাদের পরস্পর নাম-সম্পর্ক কিরূপ, ইত্যাকার এ্যাবস্ট্রাকশন বা অবস্তুর বিচার তখন সমস্যার চারিদিকে জটিলতার জট পাকাইয়া তাহাকে দুর্বোধ্য করিয়া রাখে।
এইরূপ ঝাপসা কথার ধোঁকা দিয়া মানুষ আপন মনে এক-একটা অস্পষ্টতার মোহ সৃজন করে, এবং সেই মোহকে জীবনের মধ্যে সংক্রামিত করিয়া অকারণ তৃপ্তিবোধ করে। এই দুর্ভাগ্য দেশে, জীর্ণতার পরিত্যক্ত কঙ্কাল যেখানে প্রাণের চাইতে অধিক মূল্যে বিক্রীত হয়, এই জুজুতন্ত্রের শাসনও এইখানেই মারাত্মকরূপে প্রবল। এ জিনিস যে অন্যদেশে নাই তাহা নয়, বাক্য ও চিন্তার ফেটিশ সকল দেশে সকল সমাজেই সুলভ। কিন্তু মোহের কবলে এমন নিশ্চেষ্ট নিরাশ্রয়ভাবে মানুষ আর কোথাও পড়িয়া থাকে না। লোকশাসন ও সমাজবিধির অপচার সর্বত্রই আছে কিন্তু তাহার এমন পাকাপাকি প্রতিষ্ঠার আড়ম্বর আর সকলখানেই দুর্লভ।
ইংরেজিতে যাহাকে সুপারস্টিশন বলে, বাংলায় তাহারই নামান্তর করা হয় ‘‘কুসংস্কার’’। ঐ জিনিসটার প্রতি কটাক্ষপাত নিবারণের জন্য একশ্রেণীর লোকে একটা বড় গোছের জুজু পুষিয়া থাকেন, তাহার মন্ত্র “দেয়ার ইজ এ সুপারস্টিশন ইন এ্যভয়ডিং সুপারস্টিশন’’ অর্থাৎ কুসংস্কার বর্জনের প্রয়াসটাও একটা কুসংস্কার। উঠিতে বসিতে চলিতে ফিরিতে, শুভাশুভ লক্ষণ-বিচারে, তিথিনক্ষত্রের নানা-উপদ্রবে, হাঁচি-টিকটিকি আসন-মুদ্রার মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে যে জিনিসটার জাল-বিস্তার হইতে দেখি, তাহাকে কুসংস্কার বলিলে অনেকে রাগ করেন। বলেন, “তুমি কি এমনই দিগ্গজ ত্রিকালজ্ঞ হইয়াছ যে কিসে কি হয় না হয়, সমস্ত জানিয়া শেষ করিয়াছ? বিজ্ঞানের কয়েকটা পুঁথি আওড়াইয়া তুমি কি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল তত্ত্ব একেবারে দিব্যদৃষ্টিতে বুঝিয়া ফেলিয়াছ?’’ ইহার পালটা জবাব দেওয়া যায় যে, ‘‘প্রত্যক্ষ দেখিতেছি যে তোমার অন্ধ আচারের কোনো বন্ধন না মানিয়াও সহজ স্বাধীনভাবে কত দেশ কত জাতি সংসারে তরিয়া গেল, আর তোমার জটিল নিয়মের বিরাট প্রশস্তি যুগযুগান্তর জপিয়া জপিয়াও ‘তুমি যেই তিমিরে সেই তিমিরে’। তাই সন্দেহ হয় যে আধ্যাত্মিক জীবন-পুষ্টির খাতিরে তুমি যে সূক্ষ্ম আহারের অভিনয় করিতেছ, তাহা ফাঁকা রোমন্থন মাত্র।’’ কিন্তু ইহাতেও নূতন তর্ক জুটবে যে সত্য-সত্যই আর কোনো জাতি অগ্রসর হইতেছে কিনা এবং আমরাও যথার্থই পশ্চাতে পড়িয়া আছি কিনা, আর যাহাকে ‘‘তিমির’’ বলা হয় সেটাও কি যথার্থই তিমির, না স্নিগ্ধ আলোর আশ্চৰ্য প্রকার বিশেষ। এই প্রকার ধাঁধাঁচক্রে নিরুদ্দেশ ভ্রমণ আমাদের এমনই অভ্যাসগত যে, চক্রের ব্যূহভেদ করা যে আবশ্যক, একথাটাই লোকে ভুলিয়া যায়। তাই অন্ধতার গৌরব করিয়া মানুষ বলে, ‘‘সকল বিষয়ে অতি জাগ্রত হওয়াটা কিছু ভালো নয়, ওটা সাবধানতার বাড়াবাড়ি মাত্র। দেয়ার ইজ এ সুপারস্টিশন ইন এ্যভয়ডিং সুপারস্টিশন!’’ মনের এক-একটা অন্ধ সংস্কার নিশ্চিন্ত নিরীহভাবে জীবনের উৎসরূপে চাপিয়া বসে, সহজ ব্যাপার কথার পাকে জটিল হইয়া ওঠে, গভীর তত্ত্ব নিরর্থক মুখস্থ বুলির মতো বচনমাত্রে পরিণত হয় তাহাতে কাহারো আপত্তিও নাই, অতৃপ্তিও নাই।
এইরূপে কতগুলি অস্পষ্ট ও অচিন্তিত সংস্কার যখন কথায় নিবদ্ধ হইয়া জীবনের ঘাড়ে চাপিয়া বসে তখন তাহার প্রভাব কতদূর মারাত্মক হইতে পারে তাহার সব চাইতে বড় দৃষ্টান্ত আমাদের এই অদৃষ্টবাদ। এতবড় সৰ্বগ্রাসী জুজু এদেশে বা কোনো দেশে আর দ্বিতীয় নাই। আকার ও প্রকারের প্রভাবে ও প্রতিপত্তিতে এই এক সংস্কারের মূঢ়তা এমন আশ্চর্য সম্পূর্ণ ভাবে জীবনের আট-ঘাট জুড়িয়া জীবনের হাড়ে-হাড়ে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া আছে যে, মনে হয় জীবনের সকল অভ্যাস বন্ধনকে আমূল উপড়াইয়া না ফেলিলে ইহার আর প্রতিষেধ হয় না। এই এক জিনিসের মোহপ্রভাব সমস্ত জীবনের স্বতঃস্ফূৰ্ত সজীবতার উপর এমন পাকা করিয়া আপন রঙের ছোপ ধরাইয়া দেয় যে জীবনের প্রবল স্রোতে অবিশ্রান্ত ধুইলেও রঙের ঘোর ছুটিতে চায় না বিচারের প্রখর রৌদ্রে উন্মুক্ত থাকিয়াও মরিতে চায় না। তাই জীবন সংগ্রামের সহস্ৰ তাড়নার মধ্যে নিশ্চেষ্ট মানুষ সুখে হতাশ, দুঃখে হতাশ, বিচার নাই, উদ্যম নাই, হাত পা গুটাইয়া বসিয়া থাকে, আর বলে, “দৈবেন দেয়ম্।” দৈবে করায়, দৈবে ঘটায়, অদৃষ্টের ফেরে পাই, অদৃষ্টের ফেরে হারাই। কৰ্মবন্ধনের আবর্তে পড়িয়া ঘুরিতেছি ফিরিতেছি, বাহির হইবার পথ দেখি না, কারণ বাহির হইবার পথ নাই। যদিবা মুহূর্তের উৎসাহে বলিয়া ফেলি যে, “উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মী’’ কিন্তু সেই উদ্যোগী পুরুষটিকে এই উত্তম-পুরুষরূপে দেখিবার অগ্রহ নাই, থাকিলেও তাহার আয়োজন দেখি না। কেবল জীবনের নিরুদ্যম ভীরুতা, “দৈবেন দেয়ম্ ইতি কাপুরুষাঃ বদন্তি” এই কথার সত্যতা প্রমাণ করিতে থাকে।
দৈবেন দেয়ম্। দৈবে যাহা আনিয়া দেয়, ঘাড় পাতিয়া তাহাই লও। সে দৈব যে কে, সে যে কোথা হইতে কিরূপে দেয়, তাহা দৈবই জানে, তোমার আমার কিছু বলিবার নাই, কিছু করিবার নাই। দৈবের অমোঘ চক্ৰে তুমি আমি কলকব্জার খুঁটিনাটিমাত্ৰ, তোমার আমার সুখ দুঃখে, তোমার আমার ইচ্ছা অনিচ্ছায়, নিয়তির চক্র টলিবে কেন? দৈবে হাসায়, দৈবে কাঁদায়, নতুবা তুমি হাসিতেও জানো না কাঁদিতেও পার না, তুমি কেবল দ্রষ্টা মাত্র, দৈবকর্মের সাক্ষীমাত্র। দারিদ্র্যে দুর্ভিক্ষে লোক মরে, ব্যাধিতে দুশ্চিকিৎসায় লোক মরে, মানুষ তাহার কি করিবে? যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিবেই, কপালে যদি মরণ থাকে, মরণ তবে আসিবেই। আগুন জ্বলিয়া ঘর যায়, বাড়ি যায়, কি করিব? দৈবের লিখন। আগুনের মধ্যে দু-কলসী জল ঢালিবার চেষ্টাও যেন দৈবের নিষিদ্ধ! আর দশজন যাহারা আমাদেরই মতো দৈবের অধীন, তাহারা দৈবশক্তি লাভ করে আর দৈববলে বলী হয়, দৈবের উপর আস্থা রাখিয়া সংগ্ৰাম করে, কেবল আমরাই এমন দুর্দৈবের দাস যে দৈবের চাপে আড়ষ্ট হইয়া একবার মাথা তুলিয়াও দেখিতে জানি না?
ইহার চাইতে মানুষ যদি চাৰ্বাকের মতো বেপরোয়া নাস্তিক হইয়া বলিত, “যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’’, জীবনের মাশুল ষোলো আনা আদায় করিয়া লও, জীবনের পক্ষে তাহাও আশার কারণ হইত, অন্তত বোঝা যাইত যে প্রাণের আশা এখনো সে ছাড়ে নাই।
ফ্রি উইল ও ডেস্টিনীর দ্বন্দ্ব-সমস্যা সকল দেশেই আছে এবং ছিল, কিন্তু তাহাতে আর কোথাও এমন নিষ্ফলতার বিভীষিকা ও অবসাদের সৃষ্টি হয় নাই। তাহার কারণ এই যে দৈবের বিচার-তত্ত্বকে পাকা কথায় গাঁথিয়া সিস্টেম বা তন্ত্রে পরিণত করিয়া জীবনের ভিত্তিমূলে বসাইয়া দিবার এমন অর্গানাইজড ব্যূহবদ্ধ আয়োজন আর কোথাও দেখা যায় না।
যে মোহ ভাঙিবার জন্য মোহমুদগরের সৃষ্টি, সে মোহ মানুষের ভাঙে নাই, কিন্তু আনাড়ির হাতে মুদগরের প্রয়োগ এখনো মারাত্মক। শাস্ত্রের অভিপ্রায় ও ভগবান শঙ্করাচার্যের শিক্ষা, আসলে যাহাই হউক, তাহার সংস্কারগত সহজমন্ত্র এই যে, “সংসারটা কিছু নয়’’। যাহা দেখি মিথ্যা দেখি, যাহা শুনি, তাহা মিথ্যা শুনি; তুমি আমি, জগৎসংসার এই ঘটনার পর ঘটনা, সব মিথ্যা সব মায়া। সুতরাং সুখই বা কি আর দুঃখই বা কি? ‘‘কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ” ইত্যাদি। আসল কথা, সংসারটাকে মন হইতে ঝাড়িয়া ফেল। যে কৰ্মজীবন চায় সে সংসারের হাটে কোলাহল করিয়া ফিরুক, যে মানুষের সঙ্গ চায় সে সংসারের হাহাকার বহন করিয়া মরুক; তুমি এসবের শৃঙ্খল ভাঙিয়া, চিত্তবৃত্তি নিরুদ্ধ করিয়া, জগতের সুখ-দুঃখে উদাসীন হইয়া কর্মের জন্ম-জন্মান্তরবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ কর।
কথাটা বলিলেই কাজটা সহজ হয় না কারণ সংসারটাকে ‘‘মায়া’’ বলিয়া উড়াইতে চাহিলেই সে সরিয়া দাঁড়ায় না বরং মায়াপুরীর যমদূতগুলি ক্ষুধার আকারে ব্যাধির আকারে সংসারের নানা তাড়নার আকারে জীবনের কণ্ঠরোধ করিবার উপক্রম করে কিন্তু কুতর্কের কণ্ঠরোধ করিবে কে?
তাহার উপর আবার কৰ্মবাদের জগদ্দলপাষাণভার। শাস্ত্রবচনের যথার্থ মীমাংসা শুনিবার উৎসাহ মানুষের নাই, তাই লৌকিক স্থূল-সিদ্ধান্তকেই ঋষিবাক্যের মুখোশ পরাইয়া মানুষ শাস্ত্রানুশাসনের নামে চালাইতে চায়। এই লৌকিক সংস্কার বলে কৰ্মবন্ধনে হাত পা বাঁধিয়া মানুষ সংসারে আসে। পূৰ্বজন্মের সুকৃত দুষ্কৃতের নাগপাশ এইজন্মের জীবনযাত্রাকে বেষ্টন করিয়া থাকে। এই জন্মে এখন তুমি দুর্দশাভোগ করিতেছে তাহার মূল কারণ তোমার “পূৰ্বজন্মকৃতং পাপং’’। পূৰ্বজন্মের কৰ্মফলবীজ তোমার মধ্যে উপ্ত রহিয়াছে, তাই ইহজন্মের জীবনবৃক্ষে তাহারই অনুরূপ ফল ফলিবে। এ জন্মে কাঁঠাল খাইবার সাধ রাখ, তবে ও-জন্মে কুষ্মাণ্ডবীজ রোপণ করিয়াছিলে কেন? এ জন্মে শূদ্র হইয়াছ অথবা অস্পৃশ্য ‘‘পঞ্চম’’ হইয়া জন্মিয়াছ, সে তোমার কৰ্মফলের দোষ। তবে আর মাথা তুলিতে চাও কেন? অযথা আর্তনাদ কর কেন? সংসারে কেউ ছোট, কেউ বড়, ইহাই তো স্বাভাবিক নিয়ম, কৰ্মফল অনুসারে সকলে যথাযোগ্য আসন পাইয়া থাকে। সুতরাং যে যেমন আছ তাহাতেই তৃপ্ত থাকিয়া সুবুদ্ধি মানুষের মতো আপন পথে নির্দ্বন্দ্ব থাক, তাহা হইলে সুকৃত সঞ্চয় করিয়া ব্রাহ্মণের আশীৰ্বাদে পরজন্মে হয়তো উচ্চতর পদবী লাভ করিবে। (অবশ্য ব্রাহ্মণের আশীৰ্বাদটাও তোমার কৰ্মফল প্রসাদে।) এই ব্যাখ্যার আশ্বাসে মানুষ কি যে সান্ত্বনা পায় জানি না, কিন্তু যে বেচারা সান্ত্বনা মানে না, মানুষ তাহাকে হতভাগ্য বলে, সমাজ তাহাকে চোখ রাঙায়।
তারপর, ইহার সঙ্গে যখন প্রাকৃতজনের অচিন্তিত অদ্বৈতবাদ জুড়িয়া দেওয়া হয় তখন জীবনতরী তাহার ভরাডুবীর আয়োজন সম্পূর্ণ করে। যে অদ্বৈতবাদের শঙ্খনির্ঘোষে জাগ্রত হইয়া মানুষ আপনার মধ্যে বিশ্বপুরুষের বিরাটরূপকে প্রত্যক্ষ করে, যে অদ্বৈত বিবেক মুমূর্ষু মানুষকে আশ্বাস দেয় তুমি ক্ষুদ্র নও; তুমি সুখদুঃখের ও জন্মমৃত্যুর ক্রীড়নক মাত্র নও; তুমি স্বয়ং অমৃত, তুমি স্বরূপত সেই বিরাট, সেই–
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণঃ
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে–
সেই জীবন্ত অদ্বৈতবাদ, লৌকিক বুদ্ধির কবলে পড়িয়া যে জুজুর আকার ধারণ করে, তাহা যথার্থই মারাত্মক। এই শখের অদ্বৈতবাদ বলে, “ভেদ যখন কোথাও নাই, আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সবই যখন একই আত্মার বহুধা প্রকাশ মাত্র, তুমি আমি বিষয় আশয় ইত্যাদির যখন কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নাই, তখন ভালোমন্দের বিচার কেন? পাপপুণ্যের ও পঙ্কচন্দনের সংস্কার কেন? কর্মের কর্তা সেই একই আত্মা; সুতরাং কে কাহার অনিষ্ট করিবে, কে কাহার সম্মান করিবে? কে কাহাকে আশ্রয় দিবে, কে কাহাকে হনন করিবে? দোষগুণের দণ্ডপুরস্কার নিরর্থক, সমাজের শাসনবন্ধন নিরর্থক, মানুষের ধৰ্মভয় ও দায়িত্ববোধ নিরর্থক। কাজের মালিক যখন একজন, তখন তোমার পাপপুণ্যের ভাগী তুমিও যেমন, আমিও তেমন। আমার লাভও নাই ক্ষতিও নাই, কিছু করিলেও হয়, না করিলেও হয়; দশের ভাবনা ভাবিলেও হয়, না ভাবিলেও হয়; কারণ আমার কাজে ও অকাজে আমার কোনো কৃতিত্ব নাই।’’
আশ্চর্য এই যে, এক সময়ে কৰ্মবন্ধন কাটিবার জন্যই মানুষ জাগ্রত ও সচেষ্ট হইয়া অদ্বৈত প্রতিষ্ঠার আশ্রয় খুঁজিয়াছিল, দৈবের জন্ম-জন্মান্তর শাসন ঘুচাইবার জন্যই সংসারকে মায়ার কবল বলিয়া মনকে উদ্বুদ্ধ করিতে চাহিয়াছিল। অথচ কার্যকালে দেখি কেহ কাহারও বন্ধন খোলে না বরং পরস্পরে মিলিয়া পরম-বন্ধুভাবে বন্ধনকেই আঁকড়াইয়া বলে, “সংসারের চক্রে জীবনটা যেমন ভাবে ঘুরিতেছে; ঠিক তেমন ভাবেই ঘুরুক, তাহাকে ঘাঁটাইয়া কাজ নাই।” সাধারণ সংসারবুদ্ধির কাছে দৈববাদ ও কর্মবাদ, মায়াবাদ ও অদ্বৈতবাদ মনের কোণে সুস্পষ্টচিন্তিত সিদ্ধান্ত নয়, কতগুলি নির্বিচার অন্ধসংস্কারের জুজু মাত্র। তাই আসলে তাহাদের অর্থ ও অভিপ্রায় কি, একথা ভাবিবার জন্য মানুষ কোনো তাগিদ অনুভব করে না। পরিচিত ব্যাপার সম্বন্ধে অতটা শ্রমস্বীকার অনাবশ্যক বাহুল্য বলিয়াই বোধ হয়। পরিচয়টা যে বস্তুপরিচয় নয়, শব্দের পরিচয় মাত্র, এ বোধটাও মনের কাছে স্পষ্ট হইয়া ওঠে না। মূঢ়তার প্রশ্ন আপন মনের প্রতিধ্বনি শুনিয়া বলে, ইহার নাম শাস্ত্রবাণী, ইহার নাম মায়াবাদ ও অদ্বৈতবাদ, ইহার নাম দৈববাদ ও কৰ্মফলবাদ। অথচ আসলে তাহা অজ্ঞতার স্বগত উক্তিমাত্র। অন্ধতার কবলে পড়িয়া মায়া বলিল, “এখানে কিছু করিবার নাই”, কৰ্মবাদ বলিল, “কিছু করিবার উপায় নাই”, আর অদ্বৈতবাদ বলিল, “কিছু করিবার প্রয়োজন নাই, করিয়া কিছু লাভ নাই’’। আর তিনের সুর মিলাইয়া দৈববাদ গম্ভীর পরিহাস করিয়া বলিল, “কেহ কিছু করিও না, কারণ না করাটাই বুদ্ধিমানের কৰ্ম।”
এইখানে কেহ-কেহ তৰ্ক তোলেন, যে, “ইহার মধ্যে কোনটা কাৰ্য আর কোনটা কারণ? দৈববাদের শাসন-প্রভাবেই কি জীবনের সচেষ্ট সংগ্রাম মরিয়া যায়, না জীবনটা নিস্পৃহ নিরুদ্যম থাকে বলিয়াই সে দৈববাদের দাস হইয়া পড়ে?” বাস্তবিক এ প্রশ্নের মধ্যে কোনো দ্বৈধ নাই। মাতাল যে, মাতাল বলিয়াই সে মদের দাস হয় আর মদের দাস হইলেই সে পাকারকম মাতাল হইয়া পড়ে। মনের মধ্যে ঔদাসীন্যের অবসাদ থাকিলেই দৈববাদের প্রতিষ্ঠাভূমি পাকা হয়; আর, দৈববাদের পাকাপোক্ত প্রতিষ্ঠার উপরেই আশাহীন নির্জীবতার আসর জমে ভালো। চিন্তা ও কর্মের এই ভিশাস সার্কল অভ্যাসের দুরন্ত চক্রে জীবনকে একবার প্রবিষ্ট করিলে আর নিষ্ক্রমণের পথ থাকে না। টাকায় যেমন টাকা আনে, দুৰ্বল মন কেবল দুৰ্বলতাই ডাকিয়া আনে। জীবনীশক্তি যাহার ম্লান হয়, ব্যাধি তাহাকে আক্রমণ করে এবং ব্যাধির আক্রমণে পড়িলে জীবনীশক্তিও ক্ষীণতর হইয়া পড়ে। সুতরাং এই আগে-পরের তর্কটা খুব সমীচীন তর্ক নয়, ইহা দিবারাত্রি ও বৃক্ষবীজের পরিচিত তর্কেরই প্রত্যাভাস মাত্র। একাডেমিক ডিসকাশন বা বৈঠকী তর্কের আসরে এ আলোচনার সমাদর ঘটিতে পারে কিন্তু বাস্তব জীবনের প্রয়োজন হিসাবে তর্কটা ফাঁকা তর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। রোগের চিকিৎসা করিতে বসিয়া চিকিৎসক এ ভাবনার বিচলিত হইতে থাকেন না যে, রোগটাকে আগে মারিব না তাহার কারণগুলিকে আক্রমণ করিব; না রোগের পরিচয়-লক্ষণগুলিকে দাবাইয়া রাখিব। রোগীর ক্ষীণপ্রাণটা ও ব্যাধির প্রকোপ চিকিৎসকের কাছে একই সমস্যার দুই তরফ মাত্র।
“অদৃষ্ট’’ কথাটার একটা ইতিহাস আছে। কাৰ্য-কারণের কতকটা শৃঙ্খল বেশ দেখা যায়, বোঝা যায়, তাহা দৃষ্ট; আর যাহা স্পষ্ট দেখা যায় না, যাহার হিসাব পাওয়া যায় না, তাহা অদৃষ্ট। সহজ তথ্যের এই সহজ সংস্কৃত পরিভাষা। ইহার সঙ্গে কোনো বাদ-পরিবাদের বা বিভীষিকার সম্পর্কমাত্র নাই। অথচ এই যুগে অদৃষ্ট বলিতেই এমন আতঙ্ককে বুঝি যাহা জীবনের ঘাড়ে ভূতের মতো চাপিয়া থাকে। সে আমাদের মাথার উপর একটা জাগ্রত উভয়সঙ্কটরূপে সর্বদাই উদ্যত হইয়া আছে। দৈবের আজন্ম চাপে জীবনটাই অবসন্ন, কৰ্মবন্ধন কাটি কিরূপে? আর, কৰ্মবন্ধনে হাত পা বাঁধা, দৈবের বোঝা নামাই কিরূপে? এই প্যারাডকস-এর সৃষ্টি করিয়া কথার চরকী ঘুরাইয়া মানুষ বেশ আশ্চৰ্য রকম পরিতৃপ্ত থাকে।
এই বর্তমান যুগে দৈববাদের এক নূতন আশ্রয় জুটিয়াছে, তাহার নাম বিজ্ঞান। বিজ্ঞান তাহার বিষয়রাজ্যে যে নিয়মের প্রতিষ্ঠা দেখিতে পায়, সে নিয়মকে পুরাপুরি একতরফা স্বীকার করিলে, বাস্তবিক একটা দৈবতত্ত্বকেই স্বীকার করা হয়। এই বৈজ্ঞানিক অদৃষ্টবাদ কাৰ্যকারণের সকল সম্বন্ধকে অঙ্কের হিসাবে মিলাইয়া দেখায় যে, প্রত্যেক কার্য, প্রকারে ও পরিমাণে, উপযুক্ত কারণ হইতে প্রসূত। প্রত্যেক কারণ নির্দিষ্ট পরিমাণ ও নির্দিষ্ট প্রকারের কার্যফল প্রসব করে। প্রত্যেক নির্দিষ্ট ‘কজ’ হইতে নির্দিষ্ট ‘এফেকট’ উৎপন্ন হয়, কোথাও তাহার ব্যতিক্রম হইতে পারে না। এই মুহূর্তে জড়জগতের যেখানে যাহা ঘটিতেছে, তাহা পূৰ্বমুহূর্তে অকাট্যরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছিল। পূৰ্বমুহূর্তের কারণসমষ্টি, যাহা এই মুহূর্তের কারণসমষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত করিতেছে, তাহাও তৎপূৰ্ব সময় হইতেই অলঙ্ঘ্যরূপে নির্দিষ্ট ছিল। এইরূপে এই শৃঙ্খলপরম্পরায় সুদূরতম অতীত হইতেই সুদূরতম ভবিষ্যৎ পৰ্যন্ত এক অমোঘ শাসনে আবদ্ধ রহিয়াছে, কোথাও চুলপ্রমাণ ব্যতিক্রম হইবার উপায় নাই। প্রত্যেক জড়কণার প্রত্যেক পরমাণু কখন, কোন পথে, কেমন ভাবে চলিবে, শাশ্বতকাল হইতে তাহা অকাট্য সঙ্কেতে নির্দিষ্ট রহিয়াছে, কোথাও তাহার বিচ্যুতির সম্ভাবনা নাই। বিশ্বসংসারে এই মুহূর্তে যাহা কিছু যেমন ভাবে আছে তাহার পরিপূর্ণ হিসাব যদি পাওয়া যাইত, তবে অতীত ও ভবিষ্যতের সমগ্র ইতিহাসকে অভ্রান্তভাবে তাহারই মধ্যে নিহিত দেখিতাম। দৈববাদ ইহার অতিরিক্ত আর কি বলিবে? অবশ্য বাহিরের জড় ব্যাপার লইয়াই বিজ্ঞানের কারবার। বাহিরের দৃষ্টি অবজেকটিভ ভিশন তাহার বিচারের সম্বল। কিন্তু এই বাহিরের দৃষ্টিকে সে জীবনের অন্তররাজ্যেও প্রয়োগ করিতে চায়, জীবনের মধ্যেও তাহার নিয়মচক্রের প্রতিষ্ঠা দেখিতে পায়। সে পূর্বজন্মের কৰ্মপ্রভাবকে দেখে না কিন্তু পূৰ্বপুরুষের সঞ্চিত গ্লানি ও প্রসাদকে দেখে, ইহজন্মের প্রত্যক্ষ আবেষ্টনকে দেখে। জীবনকে সে হেরিডিটি এনভায়রনমেনট-এর সাক্ষাৎ ফলসমষ্টিরূপে বিচার করে। ইহা বিজ্ঞানের তত্ত্বের দিক, তাহার এক তরফের বাণী। ইহারই সাধন পর্যায়ে দেখি বিজ্ঞানপ্ৰাণ জাতিমাত্রেরই জাগ্রত পুরুষকার-আবেষ্টনকে অতিক্রম করিবার জন্য মানুষের দুরন্ত সংগ্রাম, শিক্ষা ও সাধনা দ্বারা বাহিরের বিরুদ্ধশক্তিকে জয় করিবার অদম্য উৎসাহ। সুতরাং দৈবকে চূড়ান্তরূপে স্বীকার করিয়াও বিজ্ঞান আপনার সাধন বলে তাহার বিষদাঁত ভাঙিয়া রাখে।
বিজ্ঞানের জুজু যখন টিকিতত্ত্ব ও গঙ্গাজল-মাহাত্ম্যের সমর্থনেও অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, তখন দৈববাদ যে বিজ্ঞানের দোহাই দিবে, সেটা কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যথার্থ দরদ যেখানে আছে, সাক্ষাৎ জ্ঞানস্পৃহা যেখানে জাগ্রত, জীবন ও সংসার যেখানে কেবল মায়ার পরিহাস নয়, জীবন্ত প্রাণের উত্তীপ সেখানে দৈববাদের বীজকে ভর্জিত করিয়া ফেলে। জীবনের ভূমিতে উপ্ত হইয়া সে বীজ আর তাহার ডালপালা বিস্তার করিতে পারে না, অন্ধতত্বের জটিলজালে জীবনকে অভিভূত করিতে পারে না।
জীবনের যেকোনো দ্বন্দ্ব জীবনের মধ্যেই আপনার সর্বোত্তম সমাধান লাভ করিয়া থাকে। কারণ, জীবনের একটা স্বতন্ত্র ‘‘লজিক’’ আছে, তাহা তত্ত্বের লজিককে চিরকালই অতিক্রম করিয়া চলে। দৈবের যে তত্ত্বরূপ তাহা ছাড়াও তাহার একটা পরিচিত জীবন্তরূপ আছে। সেই রূপটিকে অহরহ আমাদের চোখের সম্মুখেই দেখি এবং তাহার মধ্যে সকল দ্বন্দ্বের সহজ সমাধান পাই। দৈবের দ্বারাই যে দৈবের খণ্ডন হয়, কর্মের দ্বারাই যে কৰ্ম-বন্ধনের ছেদন হয় ইহা কেবল শাস্ত্রের বচন নয়, ইহা প্রত্যক্ষ জীবনেরও সাক্ষ্য।
রোগের বীজই রোগের প্রতিষেধক জুটাইয়া দেয়। জীবন্ত দেহের ব্যবস্থা এমন বিচিত্র যে রোগের বিষ শরীরে প্রবেশ করিবামাত্র প্রাণশক্তি তাহার প্রতিষেধক (এ্যান্টিটক্সিন) সৃজন করিতে থাকে। এই ব্যাপারকে চিকিৎসার কাজে লাগাইয়া মানুষ রোগের কাছ হইতেই তাহার সাক্ষাৎ ঔষধ আদায় করিয়া লয়। ঠিক সেইরূপ, তত্ত্বের বাদপ্রতিবাদ ভুলিয়া প্রত্যক্ষ জীবনের দিকে চাহিয়া দেখি, দৈবই দৈবের খণ্ডনসংকেত স্পষ্টাক্ষরে দেখাইয়া দেয়। তত্ত্বের বিচার যখন জীবনের মধ্যে পুরুষকারের কোনো স্থান দেখে না, কোনো অর্থ খুঁজিয়া পায় না, জীবনের জাগ্রত পুরুষকার তখনো সংসারের তুচ্ছতম সাধনের মধ্যে আপনাকে পরিপূর্ণ সত্যরূপে অনুভব করিতে থাকে। ‘‘বাঘ আসিতেছে” শুনিলে অতি-বড় দৈববিৎ পণ্ডিতও পলায়নরূপ ব্যাকুল চেষ্টায় পৌরুষকর্মের আশ্রয় গ্রহণ করেন।
শাস্ত্রে বলে দৈব আছেন, তত্ত্ব বলে দৈব আছেন, বিজ্ঞান বলে দৈব আছেন, আর সহজ বুদ্ধিও সায় দিয়া বলিল যে ‘‘দৈব আছেন”। সমস্তই মানিলাম কিন্তু আমার অনুভূতিকে, আমার আমিত্বকে, আমার জীবনের স্বতঃস্ফূৰ্ত প্রেরণাকে আশ্রয় করিয়া যে পুরুষকার আছেন, একথাটা স্বীকার করি কিসের জোরে? অদৃষ্টের ভাবনা ভাবিতে গিয়া খামখা আমার প্রত্যক্ষ পুরুষকারকে খোয়াইয়া বসি কেন? দৈবও মানিব, পুরুষকারও মানিব– স্থূল বিচার বলে, এ কেমন স্ববিরুদ্ধ কথা! কিন্তু দৈবও আছেন পুরুষকারও আছেন এই তো জীবনের সহজ সাক্ষ্য। বিচার করিয়া দেখিলাম আমি কিছু করি না, আমি কিছু করিতে পারি না, সব করে দৈবে; অথচ জীবনে এই আবার প্রত্যক্ষ দেখি, এই আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা, এই আমার শক্তি ও সংগ্রাম। এই আমি ভাবিয়া চিন্তিয়া আমার শক্তি ক্ষয় করিয়া বক্তৃতা লিখিলাম, এই এখন মনের শক্তি প্রয়োগ করিয়া সেই বক্তৃতা পাঠ করিতেছি, ইহার সফলতার সুখ আমার, ইহার ব্যর্থতার দুঃখ আমার। যে শক্তি আমাকে ভাবাইয়া আমার দ্বারা কবিতা লিখাইল তাহাকে যে-নামই দেই না কেন, যে বস্তুটা ‘‘আমি, আমি’’ বলিতেছে তাহাকে কোন বুদ্ধিতে বলি যে, ‘‘তুমি কোথাকার কে? ইহার মধ্যে তুমি কেউ নও?”
তবে কি বলিব যে খানিকটা দৈবে করায়, আর খানিকটা পুরুষকার? জীবনের খানিকটা পৌরুষসিদ্ধ বা সাধনসিদ্ধ আর খানিকটা দৈবসিদ্ধ বা কৃপাসিদ্ধ? তাহাতেই বা সমস্যা মিটিল কই? জড় ও চেতন সমগ্র জগৎ যদি একই অখণ্ড নিয়মসূত্রে গ্রথিত হয়, তবে পুরুষকারকে তাহার শাসন হইতে বিচ্ছিন্ন করি কিরূপে? আর, নিয়মচক্রের অন্ধ নিষ্পেষণ যদি এড়াইতে না পারিলাম, তবে পুরুষকারের সার্থকতা কোথায়? অলঙ্ঘ্য দৈবই যদি সৰ্বস্ব হয়, তবে জীবনে-জীবনে পুরুষকারের এই অভিনয় কেন? পুরুষকারকে জাগ্ৰত করিয়া আবার তাহার কর্তৃত্ব লোপ করা হয় কেন?
তত্ত্বের আসন ছাড়িয়া প্রশ্ন যখন জীবনের ক্ষেত্রে জাগ্রত হয়, জীবন যখন আপনার মধ্যে উত্তরের অন্বেষণ করিয়া দেখে, তখনই দেখে দৈবের আত্মসম্বৃত সম্মোহন মূর্তি। আর সে বাহিরের নিষ্ঠুর শক্তিমাত্র নয়, অন্ধশক্তির নিৰ্মম পরিহাস নয়। জীবনে-জীবনে পুরুষকাররূপে, হৃদয়ে-হৃদয়ে অমোঘ প্রেরণারূপে, কালে-কালে জাগ্ৰতমঙ্গলরূপে, দেশে-দেশে প্রবুদ্ধ আত্মবিশ্বাসরূপে, সেই একই দৈবই আবির্ভূত। কোথাও দ্বন্দ্ব নাই, কোথাও বিরোধ নাই, ভিতরে বাহিরে একশক্তির জীবন্তলীলা প্রতি জীবনের বৈচিত্র্যের মধ্যে আপনার বিরাটরূপকে আপনি প্রকাশ করিতেছে। প্রতি-জীবনের বিচিত্র অনুভূতির মধ্যে আপনাকে আপনি সন্ধান করিতেছে, বিশ্বশক্তিকে আত্মশক্তিরূপে প্রত্যক্ষ করিতেছে।
যেকোনো দিক দিয়াই জীবনের পথকে উন্মুক্ত করি না কেন, জ্ঞানের অন্বেষণই হউক কি প্রেমের চরিতার্থতাই হউক জীবনের জাগ্ৰতবুদ্ধি যেখানে আপনার জীবন্ত প্রবাহকে স্পর্শ করে, সকল দ্বন্দ্বের সকল সন্দেহের মোহরূপ সেখানেই খসিয়া যায়। স্বভাবশঙ্কিত দুৰ্বল মন দৈবের স্পষ্টরূপকে না দেখিয়াই আপস করিতে চায়; জীবনকে বিশ্বজীবনের মধ্যে, আত্মশক্তিকে বিশ্বশক্তির মধ্যে বৃহত্তররূপে দর্শন করে না। পুরুষকারকে সে অবতীর্ণ দৈবশক্তিরূপে জানে না তাই দৈব সেই বাহিরের নিষ্ঠুর বিভীষিকাই থাকিয়া যায়। দৈব তাহার জীবনের সুখ-দুঃখ সংগ্রাম আর বহন করিতে চায় না, কেবল দুঃস্বপ্নের মতো নিদ্রিত জীবনকে আচ্ছন্ন করিয়া থাকে মাত্র। মিথ্যা ভয়ের মোহকল্পনা বিস্তার করিয়া মানুষ বলে, “আমার স্বাধীন বুদ্ধিকে দৈবশক্তির প্রকাশ বলিলে, আমার কর্তৃত্ববোধ থাকে কোথায়?’’ আমার দায়িত্বজ্ঞান টিকিবে কিরূপে? অতটা স্বীকার করিলে মানুষ যে নিরঙ্কুশ বেপরোয়া হইয়া পাপ-পুণ্যের বিচার ছাড়িয়া দিবে, বিধাতার উপর আপনার দুষ্কৃতভার চাপাইয়া নিশ্চিন্ত থাকিবে!”
এই তো তত্ত্বতন্ত্রের জুজু! এই বিশ্বজীবন যদি এমন নিয়মেই গঠিত হয় যে সত্যকে সত্যরূপে দেখিতে গেলে মানুষের পৌরুষবুদ্ধিকে খোয়াইতে হয়, তবে সে সত্যবঞ্চিত অক্ষম পৌরুষ আমার কোন কর্মে লাগিবে? আর কোন পৌরুষকে আশ্রয় করিয়া মানুষ সত্যের অনশ্বর শাস্ত্রকে বিলুপ্ত করিবে? দৈবকে ফাঁকি দিয়া এড়াইবার কল্পনা পুরুষকারের গোড়া কাটিয়া আগায় জল ঢালিবারই চেষ্টা মাত্র। দৈবের বিশ্ববিস্তৃত শাসনতন্ত্র জীবনের ভিতরে-বাহিরে জাগ্রত রহিয়াছে, সে আমার অনুমতির অপেক্ষা রাখে নাই। দৈব যদি সহায় না থাকে, তবে দৈবের কবল হইতে কে মানুষকে উদ্ধার করিবে? পুরুষকারকে যখন আশ্রয় করিতে যাই, তখন দৈবের উপরেই আস্থা রাখি, নতুবা পুরুষকার দাঁড়ায় কোথায়? দৈব আমার অদৃষ্ট কল্যাণ, দৈব আমার পুরুষকার, দৈব আমার সাধন-বল, দৈব আমার কৃপাসম্বল। দৈবকে যখন পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করিতে পারি না তখন পুরুষকারকেও বিশ্বাস করিতে জানি না। মিথ্যাসংস্কার ও অন্ধ অভ্যাসের মোহ ভাঙিয়া দেখি, দৈবের শাসন কি অপূৰ্ব বিধান। বাহিরের প্রাকৃতিক নিয়মশৃঙ্খলরূপে যে দৈব, সমাজের বিধিবিধানরূপে সেই দৈব, জীবনের সম্পর্কবন্ধনরূপে সেই দৈব। দেশের যুগসঞ্চিত কলঙ্কভার ও অবসাদের মধ্যে যে দৈব, সুপ্তোত্থিত জাতির জীবনপিপাসার মধ্যে সেই দৈব। পরমাণুর তাণ্ডবের মধ্যে সংহত শক্তিরূপে যে দৈব, জীবনের উদ্দাম চাঞ্চল্যের মধ্যে প্রশান্ত সংযমরূপে সেই দৈব। যে দৈব হতভাগ্যের সহস্রকণ্ঠে বলাইতে থাকে, “মানুষের কোনো কর্তৃত্ব নাই, আত্মার কোনো স্বাধীনতা নাই’’, সেই দৈবই ক্ষুধার তাড়নায়, দারিদ্র্যের তাড়নায়, দয়ার তাড়নায়, প্রেমের তাড়নায় মানুষের পুরুষকারকে ও দায়িত্ববোধকে অজস্রভাবে উদ্বুদ্ধ করিয়া রাখে।
মিথ্যাদৈবের অন্ধসংস্কারে মানুষ ডুবিয়া আছে, আগে তাহার মোহসংস্কার ভাঙিয়া দেখ, আগে জীবনকে এই অন্ধকূপ হইতে উদ্ধার কর, তারপর জিজ্ঞাসা করিও, কে তাহার আচ্ছন্ন জীবনকে বন্ধন-বিমুক্ত করিবে, বিকৃত দৈবের কবল হইতে কে মানুষের পুরুষকারকে জাগাইয়া তুলিবে?
দৈবের অভয়মূর্তি যে প্রত্যক্ষ করিয়াছে, দৈব যাহার মধ্যে আত্মশক্তির সার্থক বিরাট রূপে অনুভূত হইয়াছে, দৈবের জীবন্ত প্রেরণা যাহার পুরুষকারকে জাগ্রতরূপে আশ্রয় করিয়াছে, তাহারই অন্তর্নিহিত দৈবশক্তি মুক্তির মোহনমন্ত্রে তাহার কণ্ঠের বাণী হইতে, তাহার সেবার অক্লাস্তি হইতে, তাহার জীবনের পরিপূর্ণ গাম্ভীর্য হইতে, মুক্তপবনরূপে অবতীর্ণ হইবে। যুগে-যুগে দৈবের আহ্বান বহন করিয়া দৈবের প্রতিনিধি সেইসব মানুষ আসিয়াছে, সেইসব মানুষ আসিতেছে, আরো আসিবে, যাহারা দৈবকেই পুরুষকারের সাক্ষী করিয়া, দ্বিধাহীন পরিপূর্ণ সাহসের অভয় বাণী শুনাইয়া বলিবে, ‘‘দৈবেন দেয়ম্’’।
(রচনাটি ১৯১৮ সালের ৮ এপ্রিল মণ্ডা ক্লাবের বৈঠকে পঠিত। পরবর্তীকালে বাংলা ১৩২৫ সনে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত। বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত।)