বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

মুক্তোর রঙে রং

স্কুলে ফাইনাল স্পোর্টসের দিন প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়কে একটা তিন ধাপের চৌকিতে দাঁড় করানো হত। তাতে দাঁড়ালেই বোঝা যেত কার অবস্থান কী। মুখে বলে দেখিয়ে দিতে হত না। আজ মজিদের মনে হচ্ছে সেরকম একটা চৌকির ওপর দাঁড়িয়েছে তারা। কোনও বিচার-বিবেচনা ছাড়াই বলা যায়, তার অবস্থান সবার নীচে।

জয়দীপ দে

এভাবে ভরপেটে খেয়ে নেওয়াটা ঠিক হয়নি। ভুলে গেলে চলবে না, বয়স হয়েছে। অবাধ্যতাই এখন শরীরের ধর্ম। খাবার টেবল থেকে ওঠার পরপরই বিদ্রোহের আলামত টের পাচ্ছে আবদুল মজিদ। কারা যেন তার কণ্ঠার ওপর রাবারের ছিপি বসিয়ে রোড ব্লক করে দিয়েছে। শ্বাস নিতে তাই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার ওপর কুলারের কেমন একটা পলিথিন পলিথিন বাতাস। ননী তুলে নেওয়া দুধের মতো আসল উপাদানটা সরিয়ে নিয়ে আছে শুধু টনসিল ফুলিয়ে দেওয়া ঠান্ডা বাতাস। এই বাতাস দিয়ে এখন কী করবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। তার দরকার প্রচুর অক্সিজেন। বিকট আলো আর শব্দে ডুবে থাকা বিয়েবাড়িটা দু’পায়ে ছুড়ে ফেলে তার ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে কালেক্টরের মাঠে গিয়ে দু’হাত ছড়িয়ে দম নিতে। তখনই একটা ভারী হাত তার পিঠের ওপর ভর ফেলে।
দোস্ত খানাদানা কেমন হইল?
আবদুল মজিদ উত্তর খুঁজে পায় না। ডাঙায় তোলা মাছের মতো তড়পায়। একসময় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অনেকটা লুঙ্গির কোঁচড় খুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। লজিক গেটের পাশ কেটে কথাগুলো বেরিয়ে যায়।
এত ভাল খানাদানা দোস্ত জীবনেও খাই নাই।
তার মুখ বলছে, কান শুনছে, অথচ কেউ কাউকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কথাটা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। এমন খাসির মাংসে ডুবানো বিরিয়ানি আর কাবাব টিকিয়া (আরও হেন তেন নাম না জানা খাবারদাবার) সে জীবনেও খায়নি। খাওয়া তো দূরে থাকে, এই গেঁয়ো ভূতের মফস্‌সলে থেকে এমন বিয়ের আয়োজন দেখেওনি সে জিন্দেগিতে। কী সুন্দর বড় বড় বেসিনের মতো তৈজসে সাজানো নানা পদের ব্যঞ্জন। যে যার মতো করে যা ইচ্ছে নিয়ে খাও। কেউ কিছু বলার নেই। গলব্লাডারের অপারেশনের পর মজিদের তেল-চর্বিতে নিষেধ। আর চতুষ্পদের মাংস তো রীতিমতো বিষসম। কিন্তু এই আয়োজন আর খাবারের সুঘ্রাণ দেখে মজিদ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। জীবনে বহুবার বাথরুমে যাওয়া যাবে কিন্তু এমন চিত্তহরা ব্যঞ্জন-সমাহার মিলবে না জীবনে। তাই খ্যাপাটে চিতার মতো খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আত্মাকে পুরোটা তৃপ্ত করার পর সে রণে ভঙ্গ দেয়। সবই ঠিক আছে, কিন্তু এরকম আলটপকা কথা বলে নিজের ওজন নামিয়ে দেওয়ার কী মানে, বুঝে উঠতে পারে না আবদুল মজিদ।

ভাগ্য ভাল, আবদুল মজিদের ধরা-খাওয়া কথাটা শোনার সময় ছিল না কনের বাবার। পিঠ থেকে আলতো করে হাত নামিয়ে এগিয়ে গেল নতুন অভ্যাগতদের দিকে। এরা কেবল শহরের নয়, সারা দেশের গুণী-মানী মানুষ। আবদুল মজিদ এই অষ্টবজ্রসম্মিলনে নিজেকে অপাঙ্‌ক্তেয় বোধ করে। সে কোনও প্রকারে ভিড় ঠেলে একটু বেরিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজে। তখন মাজহারের ডাকে তার বুক কেঁপে ওঠে, এ আমার বন্ধু। ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল আবদুল মজিদ।
আবদুল মজিদ তার পরিচয় শুনে আরও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। সে ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল নয়। কিছুদিন প্রিন্সিপালের চার্জে ছিল, তাও বছর দুয়েক আগে। আদতে সে একজন সহকারী অধ্যাপক। পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ায়। আর ওপরে ওঠার কোনও পথঘাট নেই তার। উনষাট হলে গ্র্যাচুইটির কিছু টাকা নিয়ে চুপচাপ বাড়ি চলে যেতে হবে। এমন একটা পলকা মানুষকে বোধহয় বন্ধু মাজহার স্নেহবশত উচ্চপদে বসিয়ে উত্তোলিত করল। মনে মনে সে অপরাধটা ক্ষমা করে দিয়ে হাত বাড়ায়। বড় পরিচিত লোকটা।
চিনতে পারছিস? আরে আমাদের বারীভাই। স্টেইট মিনিস্টার, ওম্যান ওয়েলফেয়ার।
আবদুল মজিদের মনে পড়ে। টক শো-তে দেখেছে। এবার সে বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা নিয়ে বিপাকে পড়ে যায়। এটা কি অভদ্রতা হয়ে গেল? মিনিস্টার হাত না বাড়ানোর আগে সে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভদ্রলোক যদি এটাকে বেয়াদবি হিসেবে ধরেন। আচ্ছা, তার কি উচিত এখন তার আসলে পদবিটা প্রকাশ করা? পরে অসঙ্গতি ধরা পড়লে যদি কোনও সমস্যা হয়? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন ক্লান্ত হয়ে হাত-পা ছেড়ে দেওয়ার অবস্থা তখন মিনিস্টার তার হাত তুলে তাকে যেন সাইড লাইনে নিয়ে এল।
ভাল। তা দেশের অবস্থা কেমন বুঝতেচেন?

আবদুল মজিদ কথা সাজায়। সে নিজেই নিজেকে এখন বুঝতে পারছে না, দেশ নিয়ে কী বলবে। তখন একটা ছোটখাট হল্লা এসে মাজহার-সমেত মন্ত্রীকে উড়িয়ে নিয়ে গেল আর এক পাশে। আবদুল মজিদ মনে মনে ওপরয়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করে। চারদিকে তাকায় আর অবাক হয় সে। শহরের তিন মাথায় তিনটে প্যান্ডেল খাটিয়ে বিয়ের ভোজ চলছে। সবার জন্য দুয়ার খোলা। আর গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য টাউন হলে এই বিশেষ ব্যবস্থা। এখানে কেবল কার্ডওলারাই আহুত। দুলা ও দুলহান দুটি অস্থায়ী তাঁবুতে বসেছে। তাদের সামনে দুটো প্যান্ডেল। বড় টিভিতে একবার এই প্যান্ডেল, আর একবার ওই প্যান্ডেলের ছবি দেখানো হচ্ছে। বর-কনের ছবিগুলো কিছুক্ষণ পরপর নানা পদের ক্যারিকেচার করে হাজির করা হচ্ছে। বিশেষ করে বরাগমনের দৃশ্যটি দেখানো হচ্ছে গুরুত্ব সহকারে। কারণ এই আগমন এ শহরের ইতিহাস হয়ে রইল। এর আগে কেউ এখানে হেলিকপ্টারে চড়ে বিয়ে করতে আসেনি। তাই শুধু বরের মাটিতে পা ফেলা নয়, কিংবা নাগরা জুতোর নকশাই নয়, ফড়িঙের মতো বেখাপ্পা গড়নের ছোট্ট হেলিকপ্টারটার বাতাসে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য দেখানো হচ্ছে মিনিট দুয়েক ধরে। মজিদ পারে না ওই টিভি স্ক্রিনের ভেতরে ঢুকে যেতে। ঢুকে রাজপুত্রের চেহারাটা ভাল করে দেখতে। অবশ্য রাজপুত্র বলা ঠিক হল কিনা সে জানে না। লোকমুখে শুনেছে পাত্রের বাবা নাকি কিছুদিন আগেও এ অঞ্চলে আসত ঘরামির কাজ করতে। লোকে অবশ্য অতিরঞ্জনে মজা পায়। তাই কথাটাকে বিশেষ একটা গুরুত্ব দেয় না মজিদ। কাকে যেন জিজ্ঞেস করল এই ফাঁকে, পাত্র করে কী?
ভদ্রলোক সবিস্ময়ে তাকিয়ে বলল, জানেন না! ও উন্নয়ন মন্ত্রীর এপিএস ছিল।
ছিল তো বুঝলাম, এখন?
আপনার কি স্যার মাথা নষ্ট হইছে! বছর দুয়েক মন্ত্রী মিনিস্টারের এপিএস-গিরি করলে আর কিছু কি করা লাগে?

মজিদ তার জ্ঞানে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখে নিজেই লজ্জায় পড়ে যায়। কথা থামিয়ে সে আবার বড় পর্দায় লোকজনের ছবি দেখতে শুরু করে। দেশের ও শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যারা কিনা এই আয়োজনকে আলোকিত করতে উপস্থিত হয়েছেন, তাদের খুব নিবিড়ভাবে দেখানো হচ্ছে। আবদুল মজিদ এক একজনের ছবি দেখে আর অবাক হয়। ইন্টার ফেল মাজহার ডালপালায় কতদূর বিস্তৃত হয়েছে। কত ওপরের লোকজনের সঙ্গে তার সখ্য। ক্লাসের মেধাবী ছেলে হিসেবে নিজের যে পরিচয় ছিল সেটা স্মরণ করতে গিয়ে শরমিন্দায় পড়ে যায় আবদুল মজিদ। মনে মনে নিজেকে ‘বলদ’ বলে গাল পাড়ে। গতবছর তার বড়মেয়ের বিয়ে হল। এই বিয়ের অনুষ্ঠান দেখে তার মনে হচ্ছে আসলে সেটা বিয়ে হয়নি। হয়েছে কন্যা-বিদায়। বড় আদরের মেয়েটার জন্য এখন তার মায়া হচ্ছে। খরচ বাঁচানোর জন্য কত না চালাকি করেছে সে। ছেলের পরিবার দেখতে এসে পছন্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজি ডেকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। সবাইকে বলেছে, কী করব, পাত্রপক্ষ পীড়াপীড়ি করল। আসলে তো সব কিছু প্রি-প্ল্যান্‌ড। পরে অবশ্য বাড়ির উঠানে প্যান্ডেল করে শ’দেড়েক মানুষ খাইয়ে দিয়েছে।
যা হয়েছে, হয়েছে। এর চেয়ে বেশি করার সাধ্য আমার ছিল না। আরও একটা মেয়ে তো আছে। তাকেও বিয়ে দিতে হবে। মনে মনে বলতে না বলতে ছোট মেয়ের ফোন।
আব্বা, তুমি হ্যাবলার মতো দাঁড়াই আছ ক্যান? সুন্দর কইরা হাসো। তোমারে তো টিভিতে দেখা যাইতেছে। পুরা শহরের লোক ক্যাবলে দেখতাছে। আর শোনো, তোমার তো সব কিছুতেই তাইশ। বিয়াবাড়িতে গেলে কেমনে পারো ছুইটা আইবা। তাড়াতাড়ি আসবা না কিন্তু। টিভিতে কইতাছে লাখ টাকার নাকি বাজি পুড়াইব। দেইখ্যা আসবা। আর আমরা ছাদে উঠতাছি।

মজিদ কিছুই বলার সুযোগ পেল না। মেয়েটা একনিশ্বাসে তাকে শাসিয়ে লাইন কেটে দিল। মনে মনে হাসে মজিদ। তারপর দাঁড়া টানটান করে পা বাড়ায়। এমন সময় কে যেন তার নাম ধরে ডাকে। মজিদ আর পারে না। এই জৌলুসের গুরুভারে সে ক্লান্ত হয়ে চারদিকে তাকায়।
আরে করিম, তুমি! কতদিন পর। কবে আইলা?
কবে মানে, এই দশ মিনিট হইল। এহন ঢাহা থেইকা এইহানে আওন একটা ব্যাপার। তা তোমার খবর কী?
কী খবর দেবে তার। দুটো মেয়ে একটা ছেলে— এটা কোনও খবরই না তাদের কাছে। কলেজের চাকরি; সেটাও না। তাহলে কী দেওয়া যায়? মজিদ খবর খুঁজতে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে। শেষমেশ ভাবে ‘ভাল’ বলে এড়িয়ে যাবে। কিন্তু তার সেই কষ্ট আর করার প্রয়োজন পড়ে না। করিম তার খবর পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
তুমি তো বন্ধু আর আইলা না ঢাকায়, মাজহার তো মাঝে মাঝেই যায়, গুলশানে নতুন একটা ফ্যালেট নিছি। সাড়ে চার হাজার স্কয়ার ফিট। ডবল গেস্টরুম। আইলে হাত-পা ছড়াইয়া থাকতে পারবা।
মজিদ সাড়ে চার হাজার স্কোয়ার ফিটের হিসেব মেলাবে, না হাত-পা ছড়াবে, ভেবে পায় না। শেষমেশ সিদ্ধান্তে আসে, সে একটা কবন্ধ মানুষ, তাই হাত-পা ছড়ানোই উত্তম। তার সত্যিকারের একটা মাথা থাকলে সারাজীবন এই কলেজের মাস্টারি করে শেষবয়সে এসে সকলের সাফল্যের শ্রোতা হতে হত না।
নিশ্চয়ই যাব দোস্ত। তা ভাবি, বাচ্চারা কেমন আছে?
কী কইরা কমু বন্ধু, তারা তো সব স্টেইটসে। প্রতিদিন অবশ্য দুইবেলা কথা হয়। বেবাগ ব্যস্ত। হ্যালো কইয়াই পারলে লাইনটা কাইটা দেয়। করিমের মুখটা কালো হয়ে যায়।
আরে শফিক— এক হাতে শক্ত করে মজিদকে ধরে আর এক হাতে ইশারা করে ছোটে করিম।

শফিক, আমিরুল, খোদাবক্স, সেন্টু— তাদের স্কুল ও কলেজের বন্ধুরা সব বরের প্যান্ডেলের পশ্চিম কোনায় এক হয়ে গুলজার করছে। করিম ও মজিদকে পেয়ে তারা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেল বয়স পঞ্চাশের ঘরে। মজিদও ভুলে গেল ঘণ্টাখানেক ধরে দানা বাঁধা অস্বস্তিগুলো। মনে হল স্কুলের বকুলতলার নীচে দাঁড়িয়ে অ্যাসেম্বলির আগে সবাই আড্ডা পিটছে। সেই প্রগলভ বালক খোদাবক্স এখন পরিণত আমলা। ইনফরমেশন সার্ভিসের ওপর পদের কর্মকর্তা। যে সেন্টুর কাজই ছিল পেছন থেকে টান মেরে প্যান্ট খুলে দেওয়া, সে এখন বিশিষ্ট শিল্পপতি। অবশ্য ব্যবসাটা এখনও তার পোশাককেই ঘিরে। শফিক এই শহরেই আছে। ডিপ্লোমা করে পি ডব্লু ইউ-তে ঢুকেছিল। এখন মাঝ কাতারের ইঞ্জিনিয়ার। আমিরুল শাহ জালাল ভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্টার। স্কুলে ফাইনাল স্পোর্টসের দিন প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়কে একটা তিন ধাপের চৌকিতে দাঁড় করানো হত। তাতে দাঁড়ালেই বোঝা যেত কার অবস্থান কী। মুখে বলে দেখিয়ে দিতে হত না। আজ মজিদের মনে হচ্ছে সেরকম একটা চৌকির ওপর দাঁড়িয়েছে তারা। কোনও বিচার-বিবেচনা ছাড়াই বলা যায়, তার অবস্থান সবার নীচে। কিন্তু এখন এ নিয়ে আফসোস করা অর্থহীন। বরং সব মেনে নিয়ে জীবনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
জমিয়ে একটা আড্ডা হল। আরও দু-তিনজন পরে এসে যোগ দিল। ঢাকা থেকে আসা বন্ধুদের তাড়া, বেশি রাত করা যাবে না। ব্রিজের গোড়ায় নাকি গাছ ফেলে ডাকাতি হয়। জিনিসপত্র সব লুট করার পর গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায় ডাকাতরা।
মাজহার এগিয়ে এল ভিড় ঠেলে। দোস্তরা, তোমরা যাইতেছ গা। থাকলে খুব ভাল হইত। আইছ যে তাতে আমি খুব খুশি। যাইও মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। মেয়ে তো তোমগো সবারই।
করিম এর মধ্যে একটা বাজে গন্ধ বের করে আদিরসে সবাইকে ভিজিয়ে দিল।

পার্কিং লটের সামনে এসে সেই হাসির দমক কিছুটা থামল।
কী করিম, নতুন নিলা না কি?
হ রে, শোরুমে গিয়া পছন্দ হয়া গেল। নিয়া ফেললাম। একটু এক্সপেনসিভ হইছে কিন্তু কী করমু, জানোই তো, আমি একটু শৌখিন মানুষ।
তা কোনটা তোমার?
ওই যে, ওইটা।
সবাই মিলে ‘ওইটা’-কে খোঁজে। আবদুল মজিদ পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া ছেলে। সে অনুসন্ধানে এগিয়ে থাকতে বলে, সাদা গাড়িটা?
হুঁ। তয় ওইটা সাদা না, পার্ল কালার। মুক্তার রঙে রং।
সামনে গিয়ে আবদুল মজিদ দেখল, আসলেই সাদা নয়। কেমন একটা দ্যুতি আছে এই সাদার মধ্যে। গাড়িটা দেখে, গায়ে হাত বুলিয়ে আবদুল মজিদের ভাল লেগে যায়।
শফিক, আমিরুল, সেন্টু যে যার গাড়িতে উঠে পড়ে। আবদুল মজিদ দাঁড়িয়ে থাকে করিমের গাড়ির পাশে। এই গাড়ি নিয়ে তার বিভ্রাটের অন্ত নেই। ইদানীং রাস্তাঘাটে নামলে প্রেস্টিজ নিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। তার সমবয়েসি প্রায় সবারই গাড়ি, বাড়ি হয়ে গেছে। এমনকি অনেক কনিষ্ঠেরও। রাস্তায় পায়ে হেঁটে চললে হঠাৎ শোনা যায় পেছন থেকে গাড়ির হর্ন। ঘাড় ফেরালে দেখা যায় কেউ একজন ডাকছে তার গাড়িতে চড়বার জন্য। আসলে তো গাড়ি চড়ানো নয়, যার যার বিত্তের ঝলক দেখানো। তাই আহ্বান পেলেও সুকৌশলে তা সে এড়িয়ে যায়। মধ্যে গাড়ি কেনার একটা পাগলামিতে নেমেছিল। পরিচিত দু-চারজনের সঙ্গে কথা বলে দেখল, গাড়ি কেনা যায় কিন্তু পোষাটা বড় দুরূহ তার জন্য। তেল-মোবিল, ড্রাইভারের বেতন সব মিলে অসম্ভব। শকট-বিভ্রাট এড়াতে সে এখন অল্প দূরত্বের পথেও রিকশা নেয়। কেউ তো আর রিকশা থেকে নামিয়ে বলবে না, আমার গাড়িতে উঠুন। রিকশায় বসে বন্ধুবান্ধবদের গাড়ি দেখে বুকটায় যেন হিংসার অ্যাসিডিটি হয়। নিজেকে গাল পাড়ে ‘বলদ’ বলে।
করিমের গাড়ির ইঞ্জিন তর্জন করে উঠল। আয়, তোরে বাসায় নামাইয়া দিমু নে।
না না, এখন বাসায় যামু না; পরে। ভাল থাকিস। মাঝে মাঝে আসিস নিজের শহরে।
আমু নে। বাই।

মুক্তোর রঙের গাড়িটা অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে চলে যায়। আবদুল মজিদ চারদিকে তাকায়। পরিচিত কেউ আর নেই এদিকে। সে গুটিগুটি পায়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। চোখের মণিতে লেপ্টে থাকে মুক্তোর রঙের গাড়িটা। এসির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বেশ গরমই লাগছে। চারদিকে বাতাসের কোনও নামগন্ধ নেই। সুনশান চরাচর। রাস্তায় একটা রিকশাও নেই। আসলেই অনেক রাত হয়ে গেছে। এ সময় দেখে, নিস্তেজ কমলা আলো ছড়িয়ে একটা রিকশা এদিকে এগিয়ে আসছে। একটু অপেক্ষায় পেয়ে গেল রিকশাটা। ছোট্ট শহর। তাই দরাদরির বালাই নেই। শহরের ভেতরে যেখানেই যান, ফিক্সড রেট দশ টাকা। কোনও কথা না বলেই মজিদ উঠে গেল।
বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা যেন অনিচ্ছায় প্যাডেল মারছে। রিকশা যায় তো যায় না।
মজিদের একবার ধমক দেওয়ার ইচ্ছা হল, পরে ভাবল থাক, বৃদ্ধ মানুষ।
স্যার, বিয়া খাইয়া আইলেন?
হুঁ।
আমিও খাইছি কালেক্টরের মাঠের কোনায় বইয়া।
ভাল। একটু তাড়াতাড়ি চালাও।
স্যার, আমারে চিনতে পারছেন?
তোমারে কি চেনার কথা ছিল!
জে না।
তাইলে কথা না বাড়াইয়া চালাও।
আমি স্যার জয়নাল।
কোন জয়নাল?
গাড়িয়াল ভাই জয়নাল।

আবদুল মজিদ একটা ধাক্কা খায়। বিস্মৃতির অতল থেকে উঠে আসে একটা ভাঙাচোরা মুখ। ক্লাসের সবচেয়ে শক্তপোক্ত ছেলেটা। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকত অপুষ্টির দাগ। এক বছরের জন্যই পেয়েছিল তাকে। বছর বছর ফেল করার কারণে স্কুলের উঁচু ক্লাসের প্রায় সকলের কোনও না কোনও সময়ের সহপাঠী ছিল সে। একটু বোকাসোকা টাইপের ছেলেটার প্রতি একধরনের মায়াই জমে গিয়েছিল তার। স্যাররা ক্লাসে এসে প্রথমে তাকেই পড়া ধরতেন। স্বাভাবিক, সে পারত না আর মার খেত। মজিদ এই কাজটার যুক্তি খুঁজে পেত না। এ তো একধরনের ইয়ার্কি। তবে এতকিছুর মধ্যেও একটা গুণের জন্য বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিল জয়নাল। তা তার দরাজ গলায় গাওয়া ভাওয়াইয়া গান। স্কুলের প্রতিটি ফাংশনে দ্বিধাহীনভাবে হাত-পা ছুড়ে ‘ও কী ও গাড়িয়ালভাই কত রব আমি পন্থের পানে চাহিয়া রে…’ গানটি গাইত। আর সেই গানে পুরো অনুষ্ঠানে আনন্দের তরঙ্গ উঠত। কবে কীভাবে যেন এ কারণে তার নাম হয়ে যায় ‘গাড়িয়াল ভাই’। তার অন্য যে একটা নাম থাকতে পারে সেটা অনেকের জানাই ছিল না। গাড়িয়াল ভাই ঠিক ঠিক বড় হয়ে গাড়িয়াল হয়েছে। তবে গাড়িতে বলদ জুততে না পেরে নিজেই একটা ‘পশু’ হয়ে গেছে।
আবদুল মজিদের মনটা মুহূর্তে ভাল হয়ে গেল। কোত্থেকে একটা চোরা মিষ্টি বাতাস এসে তাকে ছুঁয়ে গেল। পেছনে বাজি পোড়ার আওয়াজ হচ্ছে। আতশের রঙে সারা আকাশ রঙিন হয়ে উঠেছে। মজিদ মনে মনে ভাবে, তার সব বন্ধুবান্ধবই গাড়িওয়ালা, এমনকি মূল রাস্তা থেকে ছিটকে পড়া জয়নালও, কিন্তু অনেকেই তো তার মতো সুখী নয়।

অঙ্কন: মৃণাল শীল
৫১৬ Comments
  1. Somnath Chakraborty says

    গাড়িয়াল ভাই জয়নালকে আমার খুউব ভালো লেগেছে । আপনি আরো লিখুন ।

    1. জয়দীপ দে says

      ধন্যবাদ

  2. Mita Datta says

    একটি গল্প, তার ভেতরে ধরা সমসাময়িক বাংলাদেশের হঠাৎ উচ্চবিত্ত হয়ে ওঠা প্রভাবশালী শ্রেণি। একটি গভীরতাহীন, দেখনদারি সমাজ। গাড়িয়াল ভাইয়ের গান এই সমাজের কর্ণগোচর হয় না।

    1. জয়দীপ দে says

      ধন্যবাদ

মতামত জানান

Your email address will not be published.