যিশুর মহিমা, যিশুর করুণা, তাঁর বাণী প্রচার করার, ছড়িয়ে দেবার জন্য গ্রামবাংলার চেনা সুরের কীর্তন, বাউল প্রভৃতি লোকজ সুরের আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা।
অভিজিৎ বসু
বাংলার হাজার রকম মেলায় একটি উল্লেখযোগ্য মেলা বড়দিনে চাপড়ার খ্রিস্টীয় মেলা। উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, এই মেলা আসলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেরই একটি লোকায়ত স্তর যা একে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
কলকাতা থেকে বেশি দূরে নয়। ট্রেনে করে কৃষ্ণনগর রেলস্টেশন, সেখান থেকে বাসে করে কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের পথ চাপড়া মোড়। এই চাপড়া মোড়ের কাছেই রয়েছে দুটি গির্জা। একটি রোমান ক্যাথলিক, অপরটি প্রোটেস্ট্যান্ট; যেটি অধিক পরিচিত সিএনআই চার্চ হিসেবে। সিএনআই-এর পুরো অর্থ চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া। এটি উত্তর ভারতের প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চগুলির একটি সংগঠন। উনিশ শতকের মধ্যভাগে খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে এই চার্চ তৈরি হয় ১৮৪১ সালে।
যিশুখ্রিস্টকে লোকায়ত গানে, বঙ্গজ লোকাচারে, বাউল, ভাটিয়ালি, পদাবলি কীর্তনে বেঁধেছেন প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা। যিশুখ্রিস্টের মেলা আর সেই মেলার একটি গান আমাদের বহুশ্রুত প্রভাতী কীর্তন—
“প্রভাত সময়ে/শচীর আঙিনা মাঝে
গৌরচাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে।”
একেবারে হুবহু এই সুরে গৌরচাঁদ এখানে যিশু হয়ে গেছেন।
‘‘ভোর হইল/ভানু প্রকাশিল
উঠ সবে/যিশু গুণ গাও রে
ঝরে পড়ে/যিশু পদ ’পরে
সঙ্গীতে/পূজ গো তাহারে।
মধুর স্বরে/পাখি শাখি ’পরে
আনন্দে/বিভু গুণ গাও রে।
উঠ উঠ সব/অলস মানব
স্তব করো প্রাণনাথ যিশুরে।’’
এটি গগনচন্দ্র দত্তের ১৮৯৯ সালের রচনা।
যিশুখ্রিস্টের মেলা আর সেই মেলার গানে কীর্তন, বাউল, ফকিরি, ভাটিয়ালি, রামপ্রসাদী সুরে খ্রিস্টভজনা। কিন্তু কেন? একটু পিছনে ফিরে তাকানো যাক। চার্চ মিশনারি সোসাইটি, সংক্ষেপে সিএমএস-এর তথ্যসূত্রে আমাদের যেতে হবে। যেখানে বলা হচ্ছে, ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের এক জার্মান মিশনারি ডব্লিউ জে ডিয়ার নদিয়ায় আসেন। তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মভিটে পরিদর্শন করেন। তার পর তিনি আর এক প্রাচীন শহর কৃষ্ণনগরে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে কৃষ্ণনগরের সংলগ্ন গ্রামগুলিতে তিনি মূলত কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রান্তিক মানুষজনের সঙ্গে পরিচিত হন। অত্যাচারিত, অপমানিত, অবহেলিত উচ্চবর্ণের দ্বারা শোষিত এইসব মানুষ ব্যাপটাইজড হন, অর্থাৎ সেই আর্থ-সামাজিক অবস্থায় এই মিশনারিদের কাছে তাঁরা ধর্মান্তরিত হন।
ধর্মান্তরিত কিন্তু নামকরণের মধ্যে তার বাঙালিয়ানা যেমন রেভারেন্ড প্রিয়নাথ বৈরাগী, রাইট রেভারেন্ড নীরদকুমার বিশ্বাস প্রমুখ।

যিশুর গান বা গির্জার গান বলতেই যে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ঝংকার, অর্গান, কোরাল ভয়েস, এইসব শব্দচিত্রকল্প মনের মাঝে ভেসে ওঠে, যিশুখ্রিস্টের মেলায় তা কিন্তু শোনা যায় না। তেমনটা হয়তো গির্জার আনুষ্ঠানিক সঙ্গীতে বা খ্রিস্টের সকাল-সন্ধ্যার প্রার্থনায় উপস্থিত।
ইতিহাস বলে, বহুদিন আগে রেভারেন্ড মতিলাল মল্লিক, যিনি অধিক পরিচিত মতিলাল পাদরি হিসেবে, তিনি নবদ্বীপে গিয়ে বহুবছর ধরে নবদ্বীপের কীর্তনের নানারকম গান, পদাবলি শিখে এসেছিলেন। এর পর তিনি কীর্তন, পদাবলি ও নানারকম গানে বাইবেলের গসপেলের কথা, উপদেশ, বাণী বসিয়ে গান বাঁধতে থাকেন। আখড়ার বাউলদের মতো এক একটি খ্রিস্ট গানের দল, কখনও খ্রিস্ট কীর্তনীয়ার দল, এমনকি খ্রিস্ট বাউলের দল গড়ে উঠেছে। আসলে যিশুর মহিমা, যিশুর করুণা, তাঁর বাণী প্রচার করার, ছড়িয়ে দেবার জন্য গ্রামবাংলার চেনা সুরের কীর্তন, বাউল প্রভৃতি লোকজ সুরের আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। যেমন, আমাদের অতিপরিচিত রামপ্রসাদী গান—
“মন রে কৃষিকাজ জানো না
এমন মানবজমিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা।”
এই গানটি অবলম্বন করে রচিত হয়েছে—
“না ঘুচিলে/মনের ময়লা/সেই সত্য পথে/যায় না চলা।
মন পরিষ্কার/করো আগে/অন্তর বাহির/হোক খোলা।”
এই গানটি ১৮৭৮ সালে মধুসূদন সরকারের রচনা।
প্রায় ৯৩ বছর আগে অবিভক্ত বাংলার বল্লভপুর, এখন যেটি বাংলাদেশে, সেখানে এই খ্রিস্টীয় মেলার পত্তন হয়। সেখানে বিভিন্ন খ্রিস্টীয় গানের দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা হত। সুগায়ক ও ভাল গানের দল পুরস্কৃত হত। এখন আর এর প্রচলন নেই। আচারে, আচরণে, বাঙালিয়ানায় এই বড়দিনের উৎসব খ্রিস্টীয় মেলার সূচনা হয় ২৫ ডিসেম্বর থেকে, শেষ হয় ২ জানুয়ারিতে। মেলার চেহারা-চরিত্রে অগ্রদ্বীপের মেলা, কল্যাণী ঘোষপাড়ার মেলা, সতীমায়ের মেলা, সত্যপিরের মেলা, কোচবিহারের রাসমেলা— এই সমস্ত মেলার বৈশিষ্ট্য বড়দিনের খ্রিস্টীয় মেলায় বর্তমান। মেলায় হরেক রকমের দোকান-পসরা নানা বয়েসি ছেলেমেয়েদের পছন্দের সামগ্রী এবং বড়দিনের এই খ্রিস্টীয় মেলাকে ঘিরে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের সমাগম দুর্গোৎসবকে মনে করায়।
মেলায় রাসের ঝুলনের মতো মূর্তি গড়ে যিশুর জন্ম উপাখ্যান ও মাহাত্ম্য প্রচার, নাগরদোলা, ফুলের প্রদর্শনী, নানারকম সবজি ও বনসাই প্রতিযোগিতা, ম্যাজিক শো, বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানো, ফুচকার স্টল ইত্যাদি বাঙালির গ্রামীণ মেলার বৈশিষ্ট্য যিশুখ্রিস্টের মেলায় উপস্থিত।
চাপড়ার যেখানে এই মেলা বসে তা হল ডব্লিউ জে ডিয়ারের গড়া কিং এডোয়ার্ড হাইস্কুলের মাঠ। মেলার সংগঠনে বা পরিচালনায় কেবলমাত্র চাপড়া অঞ্চলের দেড়-দুই হাজার বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের আধিপত্যই যে রয়েছে তা কিন্তু নয়। মেলা কমিটিতে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সকলেই রয়েছেন। তাঁরা এই মেলার সংগঠক ও আয়োজক। যেন এই মেলা তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে বাৎসরিক উৎসবের দায়িত্ব। যেমনটি হয় দুর্গোৎসব বা অন্যান্য উৎসবে।
কয়েক বছর আগেও এই মেলাকে ঘিরে ক’দিন ধরে চলত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খ্রিস্টীয় কীর্তন, খ্রিস্টীয় পালাগান, খ্রিস্টীয় জন্মবৃত্তান্ত, বাণী ও মহিমা নিয়ে যাত্রা-নাটক। এখন নতুন প্রজন্মের কাছে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলির আকর্ষণ ও আগ্রহ লোপ পেয়েছে। তার স্থান নিয়েছে বিরাট বিরাট সাউন্ড বক্স বা মাইকে অত্যাধুনিক হিন্দি, বাংলা সিনেমার গান।
শামিয়েল মণ্ডল, যিনি অধিক পরিচিত খ্রিস্ট বাউল হিসেবে, তাঁর রচিত খ্রিস্টভজনার একটি বাউল গান উল্লেখযোগ্য।
“যিশুখ্রিস্ট নামের ফুল ফুটেছে
বেথেলহেম গোশালায়
ফুলের গৌরবেতে জগৎ আলো
সুগন্ধেতে মন মাতায়।”
এই গানটির উল্লেখ এইজন্য করলাম যে, যিশুখ্রিস্টকে নিয়ে গানে লোকগান, কীর্তন গান ও বাউল গানের সুরের প্রভাব যেমন রয়েছে তেমনই তার রচনাশৈলী বা শব্দচয়নে রয়েছে একেবারে প্রচলিত কুবের গোসাঁই, যাদুবিন্দু, রামপ্রসাদী, লালন ফকির, পাণ্ডু শাহের গানের আদল।
শামিয়েল মণ্ডলের এই গান শুনে মনে হবে লালনের গানের চলন ও বলন। লালনের গানটি হল—
“দেহের মাঝে বাগান আছে
তাতে নানা জাতির ফুল ফুটেছে
সৌরভে জগৎ মজেছে
লালনের মন মজল না।”
তথ্যসূত্র
১) উৎসবে মেলায় ইতিহাসে : সুধীর চক্রবর্তী।
২) খ্রিস্টীয় মেলা : সুব্রত পাল।
Comments are closed.