বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

বিয়ে

দেখাদেখির মধ্যে মেয়ে দেখাটাই দেখা। ছেলে দেখাদেখি কী! চাকরি করে, দুটো হাত-পা, একটা মাথা, আর কী চাই! দেখার কী আছে! ছেলে অষ্টাবক্র হোক, সামান্য তোতলা হোক, একটু ট্যারা হোক, মাথায় সামান্য টাক হোক, সব মানিয়ে যায়। ময়ূর ছাড়া কার্তিক পাবেন কোথায়!

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

বিয়ের ব্যাপারটা ক্রমশই ‘ট্যাকটিক্যাল ওয়ারফেয়ার’-এর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। দু’পক্ষের মেজর জেনারেলের বুদ্ধির লড়াই আর ক্রমান্বয়ে দর কষাকষি। পণপ্রথার বিরুদ্ধে সমাজে হিতৈষী মানুষের কষ্ট যতই সোচ্চার হচ্ছে, ছেলেদের পক্ষের মেজর জেনারেলদের ততই নতুন নতুন চাল ভাবতে হচ্ছে। যতই হোক, চক্ষুলজ্জা বলে একটা জিনিস এখনও তো একেবারেই উবে যায়নি। শিক্ষিত মানুষের একটা সমাজ আছে। অসামাজিক কিছু একটা করতে হলে সোজাসুজি করা যাবে না। কায়দা করে করতে হবে। ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের ব্যাপার।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, You can not choose your father but can choose your father in law। আগেকার দিনে প্রায় প্রকাশ্যেই ছেলেকে নিলামে তোলা হত। শাঁসালো শ্বশুরমশাইরা এগিয়ে আসতেন। টিপে টিপে, বাজিয়ে-বুজিয়ে দেখতেন। অনেকটা বাড়ি কেনার মতো। ভিত বেশ পোক্ত, গঠন বেশ ভাল, মালমশলা খারাপ নয়, নোনা ধরবে না, বনেদি জমি, মানে হাওয়া-বাতাস খেলে। ইচ্ছে হলে আরও গোটা দুই তলা ওপরে তোলা যায়। আচ্ছা, আমি এই দর দিলুম। দরদস্তুরের পর পিতা স্বত্ব বিকিয়ে দিলেন। তাতে নিজের লাভ না হলেও পুত্রের বরাত ফিরে গেল। শ্বশুরের পয়সায় বিলেত ঘুরে এল। শ্বশুরের ফার্মেই অ্যাটর্নি হয়ে বসল! কী জুনিয়র হয়ে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করল অথবা বিলিতি ডিগ্রিধারী সার্জেন হয়ে ফোঁড়াই সেলাই আরম্ভ করে দিল। জন্মদাতা পিতা তখন বহুদূরের মানুষ। ছেলে হলেই যে এমনটি হবে, তা নয়। ভাল ছেলে হতে হবে। ভাল চাকরির জন্যে শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা চাই, বড়লোক, মানী শ্বশুরের জন্যেও তেমনই কিছু পুঁজি থাকা চাই। স্লেভ মার্কেটেরই নিয়ম। চেন দিয়ে বাঁধা ক্রীতদাসরা দাঁড়িয়ে। আরব ব্যবসায়ীরা মোহরের তাড়া নিয়ে ঘুরছে। দরদাম করছে। ‘এ’ ক্লাসের এক দাম, ‘বি’ ক্লাসের আর এক দাম। গুণানুসারে কেউ যাবে নবাবের হারেমে, কেউ যাবে তেল ব্যবসায়ীর পিপে ঠেলতে। চাইলেই কি আর শ্বশুর পছন্দ করা যায়! তবে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখতে আপত্তি কী?

এখন অবস্থা অন্যরকম। চাহিদা বাড়লে কানা বেগুন, পচা আলুও বাজারে বিকোয়। রং করা পটল আশি টাকা কিলো। দু’টাকায় একটা পাতিলেবু। রসা মাছই চারশো টাকা কিলো। ঘরে ঘরে মেয়ে। বাপ-মায়ের চোখে ঘুম নেই। পদ্মলোচনরা যে যা পারছে দাম হেঁকে বসছে। অনেকের আবার এই ভাব— কিছুই যখন করা যাচ্ছে না, তখন একটা বিয়ে করেই দেখা যাক।
ছেলের সংখ্যা কম না হলেও, বিয়ে করে সংসার পাতার মতো ছেলের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। বিয়ের বাজারে নামতে হলে সাকার হতে হবে। প্রেমের জগৎ বেকারদের হাতে থাকলেও তাতে হাত মিলিয়ে একটি মেয়েকে ঘরে আনতে হলে খোঁটার জোর থাকা চাই। খোঁটাটি হল জীবিকা। জীবিকার স্তরভেদ আছে— উচ্চ, মধ্য, নিম্ন, অতিনিম্ন।
ছেলে জীবিকায় প্রতিষ্ঠিত হলেই পিতার একটা তুরুপের তাস এসে গেল। আর একটি ক্যাশ সার্টিফিকেট। এবার একটি বউমা আনতে হবে। অবশ্যই দেখেশুনে। ছেলে বলবে, চাকুরে মেয়ে হলেই ভাল হয়। দু’জনের রোজগারে গড়গড়িয়ে সংসার চলবে। কর্তার প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট হলে গিন্নিরটা খোলা, গিন্নিরটায় ধর্মঘট হলে কর্তারটা খোলা। এতে ট্রেড ইউনিয়নের শক্তি বাড়বে। তার মানে, মেয়ের তরফে আর একটি মাত্রা যুক্ত হল। শিক্ষিতা, সুদর্শনা, গৃহকর্মে সুনিপুণা, সঙ্গীতজ্ঞা, নৃত্যপটিয়সী এবং চাকুরিরতা। মানে রম্ভা, তিলোত্তমা, কুন্তি, দ্রৌপদী, গার্গী, মৈত্রেয়ী সব একাধারে ফেলে ঢালাই করা অষ্টধাতুর দেবী।
ছেলের পছন্দ আর ছেলের পক্ষের দাবি, দুয়ে মিলে তৈরি হয় কন্যাপক্ষের বিভীষিকা। দেখাদেখির মধ্যে মেয়ে দেখাটাই দেখা। ছেলে দেখাদেখি কী! চাকরি করে, দুটো হাত-পা, একটা মাথা, আর কী চাই! দেখার কী আছে! ছেলে অষ্টাবক্র হোক, সামান্য তোতলা হোক, একটু ট্যারা হোক, মাথায় সামান্য টাক হোক, সব মানিয়ে যায়। ময়ূর ছাড়া কার্তিক পাবেন কোথায়! দেখতে হবে মেয়েকে। ভাল নাক চাই, টানা টানা চোখ চাই, এক আকাশ মেঘের মতো কালো চুল চাই, সুরেবাঁধা মিঠে গলা চাই, দুধে-আলতা রং চাই, গজেন্দ্রগামিনী হওয়া চাই। এর যে কোনও একটা কম হওয়া মানেই অন্য দিকে মিটার চড়তে থাকা।

পাত্রের পিতা ফোনে জানালেন, আপনার মেয়েটিকে আমাদের একমেটে পছন্দ হয়েছে। এবার দ্বিতীয় ব্যাচ যাবে, তারপর তৃতীয় ব্যাচে যাবে ছেলে আর ছেলের বন্ধুরা। ছেলের কোনও পছন্দ-অপছন্দ নেই। একটু সুন্দরী হলেই সে সন্তুষ্ট। তা ছাড়া সে নিজে গান বড় ভালবাসে। সর্বক্ষণই টুসকি মেরে আজকালকার গান গায়। প্রায় গানেরই এক লাইন করে তার জানা। ওরা দেখতে গেলে আপনার মেয়েকে আধুনিক কিছু গাইতে বলবেন, ওই সব মাথা নত-ফত যেন না গায়। বন্ধু হিসেবেই আপনাকে এই টিপ্‌সটুকু দিয়ে রাখলুম। অবশ্য আমরা যা বলব তাই হবে, তবু বোঝেন তো, আজকালকার ছেলে। আমরা আর ক’দিন আছি। সারাজীবন যার সঙ্গে ঘর করতে হবে তার যেন কোনও খুঁতখুঁতুনি না থাকে। পিতা হিসেবে আমাদের সেটুকু দেখা কর্তব্য।
পাত্রী পছন্দের পর কিঞ্চিৎ দরাদরি। কথায় বলে, সহস্র কথা খরচ না হলে বিবাহ হয় না। পাত্রপক্ষ খুবই উদার। শিক্ষিতের ফ্যামিলি তো। দাবি কিছু নেই। আমরা চামার নই, বুচার নই! মেয়ের বাপের চামড়ার ডুগডুগি বাজাতে চাই না। মেয়েটিই আসল। সম্পর্কটাই বড়। তবে হ্যাঁ, পাত্রীর পিতাকে আমরা ছোট করতে চাই না। তিনি যেন হীনমন্যতায় না ভোগেন। বাবা কিছুই দিতে পারলেন না বলে মেয়ে যেন শ্বশুরবাড়িতে এসে ভয়ে ভয়ে না থাকে। আত্মীয়স্বজনরা যখন বলবে, কী গো, ছেলের বিয়ে দিলে একেবারে হাঘরের সঙ্গে! তখন বউমা যেন শরমে না মরে যায়। এসব ব্যাপারে জ্ঞাতিগুষ্টির মুখ তো আর বন্ধ করা যাবে না। ছেলের বিয়ে দিয়েছি বলে তাদের মুখে তো আর সেলোটেপ আটকাতে পারব না। আমাদের কোনও দাবি নেই, যা দেবেন সন্তুষ্ট। ছেলেও আমার কিছু চায় না। বাপ কা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া। কিন্তু একটা আছে মশাই। ছেলের বন্ধুরা যখন বলবে, দেখি, শ্বশুর ঘড়িটা কেমন দিলে? সোনার বোতামে হিরে আছে কিনা, খাটটা খাঁটি সেগুনের পাক্কা সাত বাই সাড়ে সাত কিনা, আলমারিটা সেই বিখ্যাত কোম্পানির মার্কামারা কিনা, ড্রেসিংটেবলটা থ্রি ফোল্ড তো? ওয়ার্ডরোব দেয়নি? একটা ল্যাপটপ দেওয়া উচিত ছিল। চার চাকা না হোক, নিদেনপক্ষে একটা বাইক তো দেবে! এসব না পেলে ছেলের মুখটি যে আমসি হয়ে যাবে! শ্বশুরের গর্বে বুক যদি দশহাতই না হল, উভয় তরফেরই সম্মান গেল।

আমাদের কোনও দাবি নেই। আপনি দিতে চান দেবেন। বাধা দেব না। আপনার ক্ষমতাকে আমরা কখনওই ছোট করে দেখব না। সালঙ্কারে শ্বশুরালয়ে পাঠানোই এতকালের প্রথা। সোনা হল একটা মস্ত বড় সিকিউরিটি। বিপদে-আপদে সংসারী মানুষের মস্ত বড় বল। বেচো, বাঁধা দাও। দুর্দিনের ভরসা। সোনা চিরকাল মেয়ের বাড়ি থেকেই আসে। ছেলে জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতে পারে। ছেলের বাপ সর্বস্বান্ত হয়ে ছেলে মানুষ করতে পারে। কেঁদেকক্কে ঘ্যানঘেনে স্ত্রীর একটা নাকছাবি করিয়ে দিতে পারে। বউবাজারে গিয়ে ভরি ভরি সোনা কিনতে পারে না। সোনা আসে। মেয়েরা, মা লক্ষ্মীরা নিয়ে আসে। সোনা হল প্রেস্টিজ। আমার এত ভরি। ভাবতেও ভাল লাগে, বলতেও বুক দশহাত হয়। পাঁচজনে সমীহ করে। প্রতিবেশীর চোখ টাটায়। তা ছাড়া আজকাল লকার হয়েছে। বিশ-পঁচিশ ভরি যদি নাই দিলেন, বউমা কেমন করে লকারে রাখতে যাবেন! লকার, চার চাকা হল গিয়ে স্ট্যাটাস সিম্বল। বউমা ঠোঁট উলটে পাশের বাড়ির বউটিকে বলবেন, আমার ভাই সে ভয় নেই, ও লকার করে দিয়েছে, এই হাতের ক’টা রেখে সব সেফ ডিপোজিট ভল্টে ভরে দিয়েছি। মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসি। সোনাটা আপনি তিরিশ-পঁয়ত্রিশ ভরিতেও তুলতে পারেন। আপনার মেয়েরই থাকবে। মেয়ের যখন মেয়ে হবে তখন আপনার মতো আতঙ্কে হার্ট ফেল করতে হবে না। ছেলের বাপের পায়ের তলায় নিলডাউন হয়ে বসে মুখ কাঁচুমাচু করে বলতে হবে না, বড়ই দুঃস্থ, দয়া করে আমার মেয়েটিকে নিন।

এই উদার সমাজে পাত্রপক্ষের কোনও দাবি নেই। তবু একটি কন্যাকে ভাল ঘরে পাত্রস্থ করতে বিশ-পঁচিশ লাখ লাগতে পারে, তিরিশ-পঁয়ত্রিশেও হয়তো থই পাওয়া যাবে না, সান ইন ল-কে সাজিয়ে দিতে হবে। তিনি যেন পরে নিজের কোর্টে পেয়ে কন্যাকে তুলোধনা না করেন। দেখো বাবাজি! বছর বছর তত্ত্ব পাবে। শীতে স্যুট, কাশ্মীরি শাল, ষষ্ঠীতে আর একপ্রস্থ। সান না পেলে, ইন ল পাবে। পেলে না বলে আমার মেয়েটিকে ধামসো না। প্রথমে বাক্যবাণ, পরে অন্তরটিপ্পনী, তারপর কম্বল ধোলাই, তারপর আড়ং ধোলাই। সবশেষে কেরোসিন তেল, দেশলাই কাঠি কিংবা চ্যাংদোলা করে ওপর থেকে নীচে নিক্ষেপ।
সমাজে প্রগতির জোয়ার এসেছে, শিক্ষার আলো ফেটে পড়ছে। মানুষ আর বনমানুষ নয়। তবে বিবাহ তো একটা দ্রাবিড় প্রথা। মা বললেন, এবার তোর জন্যে একটা দাসী আনতে হবে বাছা। ভদ্র, নিরীহ মেয়েরা সংসারে মুখ বুজে মার খাবে আর তেমন ডাকাবুকো জাঁহাবাজরা মার দেবে। যিনি আজকের দজ্জাল শাশুড়ি তিনিও একদা ঠোনাখাওয়া বউ ছিলেন। অকারণ র‌্যাগিং চলেছে, ঘরে ঘরে। সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যাও করছেন। মানুষ শুধু চাঁদ নয় মঙ্গলগ্রহে যাবে, আণবিক বিস্ফোরণ ঘটাবে, কম্পিউটারে প্রগতির ইতিহাস লেখা হবে নতুন করে। তবু নারী নির্যাতন বন্ধ হবে না। অথচ নারী ছাড়া সংসার অচল। পুরুষ হার্মাফ্রোডাইট নয় যে, নিজেই নিজেতে সন্তান উৎপাদন করে সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখবে! স্ত্রীবিয়োগে নাকে কাঁদবে। ইয়া ছবি বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে মালা পরিয়ে, ধূপ জ্বেলে ‘আজ তুমি নেই, তুমি নেই’ করবে। অথচ যতদিন সেই দুর্ভাগা জীবিত ছিল ততদিন পরমানন্দে তাকে সাইকোলজিক্যাল, ফিজিক্যাল টর্চার করে মেয়ে-মদ্দ সবাই আনন্দ পেয়েছে। এই বিচিত্র সমাজে কন্যার পিতাদের চোখে তাই ঘুম নেই। ঘরে ঘরে আতঙ্ক— মেয়ে বড় হচ্ছে। লাখ, নিযুত, কোটি— কোথায় ঠেকবে কে জানে। অবশেষে কী হবে? সুখী হবে তো!

অঙ্কন: রাজ রায়
৫১৬ Comments
  1. soumya21192 says

    খুব সুন্দর লেখা। ব্যঙ্গটা যথোপযুক্ত

  2. Biplab Biswas says

    বর্তমানে ঠাকুরে মজে থাকা সঞ্জীববাবু হয়তো অনেকদিন পর এমন রম্যগদ্য লিখলেন। এই বয়সেও ধার যায়নি, মনে হচ্ছে। পাত্রপক্ষীয় ‘একমেটে ‘ দেখা – যথাযথ শব্দচয়ন। তবে ‘হীনমন্যতা ‘ বানানটা কি তিনি লিখেছেন?

  3. Arnob Roy says

    বয়স হলেও সঞ্জীববাবুর কলমের ধার যে কমেনি তা আবার প্রমাণিত হলো। অসাধারণ লেখা।

  4. Tanmay Mandal says

    একদম যথার্থ লিখেছেন সঞ্জীব বাবু।ওনার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

  5. jayanta das says

    akdom right

মতামত জানান

Your email address will not be published.