বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ১

চোখ সরিয়ে নিল চন্দ্রা। দৃশ্যটির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছে না সে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। একরকম অপূর্ণতার জন্য তার ভেতরটা ছটফট করছিল। বুকের ভেতরে একটা পাখিও ডানা ঝটপট করছিল।

বিপুল দাস

খাদের একদম পাশে এসে যেন মন্ত্রবলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে পাথরটা। সর্বনাশের একদম শেষমুহূর্তে তাকে নিশ্চয়ই কোনও অলৌকিক শক্তি স্তব্ধ করে দিয়েছিল। নইলে, কে জানে কত উঁচু কোন উপত্যকা থেকে গড়াতে গড়াতে যার নিয়তি ছিল অবধারিত পতন, সেই বিশাল ভর কী অবিশ্বাস্যভাবে পতনের শেষমুহূর্তে ওখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
এইসব অলৌকিক দৃশ্য থেকে গ্রামেগঞ্জে অদ্ভুত সব গল্পের জন্ম হতে থাকে। বংশপরম্পরায় সে গল্প গড়াতে থাকে। ক্রমশ বরফের গোলার মতো সেটার গায়ে ছোট ছোট নতুন উপকথা জড়ায়। গাঁওবুড়োর মুখে সবাই গোল হয়ে বসে সেই পাথরের গল্প শোনে।
সে একবার, অনেক চাঁদ আগে, পুরো পৃথিবী খ্যাপার মতো মাথা নাড়া দিয়ে উঠেছিল। সে কী ভুঁইদোল। দুনিয়ার ঝুঁটি ধরে কেউ যেন প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকাচ্ছে। সব কিছু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের প্রাণী, দুনিয়ার মানুষ, যত ছোট-বড় গাছপালা, কেউ স্থির থাকতে পারছিল না। আর, কী ভীষণ শব্দে সামনে ওই পাহাড়ে ধস নামছিল। বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছিল। গড়িয়ে নামছিল, তার চলার পথে যা পেয়েছে, সব ভেঙেচুরে নেমে এসেছিল।
সবাই গাঁওবুড়োর কথাগুলো হা করে শোনে। চোখ, নাক, কান, সর্ব অঙ্গ দিয়ে গল্প ওদের শরীরে ঢোকে। সমস্ত রোমকূপ দিয়ে শুষে নেয় কত চাঁদ আগের ভূমিকম্প আর পাহাড় ধসে পড়ার গল্প। অনেকদিন বাদে সেই গল্পের শরীরে আবার উপকথার পরত জমে। নতুন এক গাঁওবুড়ো অবিশ্বাস্য এক পতনের গল্প শোনায় সবাইকে। সবাই গল্প শোনে আর খাদের কিনারায় জাদুমন্ত্রে হঠাৎ থমকে যাওয়া বিশাল সেই, যেন ছোটখাটো একটা পাহাড়ই বুঝি, পাথরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।
গড়াতে গড়াতে শেষে হয়তো উপত্যকার ঢাল কমে প্রায় সমতলে পৌঁছলে সেই ভরের গতিজাড্য কমে গিয়েছিল। খাদের একদম প্রান্তে এসে গতিজাড্য শূন্য হয়ে যায়। স্থিতিজাড্য প্রাধান্য পায়। তারপর, কে জানে কত হাজার বছর ধরে পতনের অপেক্ষায়, কারও হাতের সবল আঘাত পাবে বলে ওইভাবে স্থির হয়ে আছে পাষাণপ্রতিমা। আর, কে যে প্রথম ওর গায়ে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে কী মনোবাসনা জানিয়ে এসেছিল— সেও হয়তো অনেক চাঁদ আগের কথা— ভুলে গেছে সবাই।

চোখ সরিয়ে নিল চন্দ্রা। দৃশ্যটির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছে না সে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। একরকম অপূর্ণতার জন্য তার ভেতরটা ছটফট করছিল। বুকের ভেতরে একটা পাখিও ডানা ঝটপট করছিল। ডেকে উঠছিল বারবার— যা না বোকা মেয়ে, একবার ধাক্কা মেরে দ্যাখ। কীসের ভয়! ফিসফিস করে কানে কানে কুডাক দেবার মতো বলছিল— পূর্ণ কর অপূর্ণ বাসনা। পড়ো-পড়ো পাথর ফেলে রাখতে নেই। ফেলে দিতে হয়। নইলে সারাজীবন কষ্ট পেতে হয়।
চন্দ্রা আবার তাকাল সেই পাথরের দিকে। কতবার তাকাল, কতবার চোখ ফিরিয়ে নিল। কী ভীষণ প্রবল হয়ে উঠছে আকাঙ্ক্ষা। একবার শুধু ধাক্কা দিয়ে দেখবে কী হয়। অনন্তকাল ধরে পড়বে বলে খাদের কিনারায় অপেক্ষা করে আছে এক বিশাল ভর। কী বিরাট পাথরের চাঁই। কেউ এসে একবার শুধু ছুঁয়ে দিলেই পাথর গড়িয়ে যাবে খাদে। সেখান থেকে গড়াতে গড়াতে নদীর গর্ভে। তারপর কালের গর্ভে চূর্ণ হতে থাকবে। যা ছিল বিশাল এক শিলাখণ্ড, শেষপর্যন্ত ছোট হতে হতে উপলখণ্ড, তারপর আরও গড়াতে থাকে কালের স্রোতে। কোটি কোটি বালুকণা জমা হতে থাকে নদীর বুকে। পাহাড়ে ধস নামে। ঝাউ, পাইন, শিকড়-ওপড়ানো চা-গাছ— সব নিয়ে বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই গড়াতে থাকে সমতলের দিকে। অবশেষে সব নিয়ে নদীগর্ভে তার সমর্পণ। সেই সব ছোটবড় পাথর চূর্ণ হতে হতে একদিন বালুকণায় পরিণত হয়। সেখানেই যাবে বলে এই বিশাল বড় পাথর কিনারে এসে অপেক্ষা করছে।
আজ খুব ভোরে উঠবে বলে মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল চন্দ্রা। কালও উঠেছিল কিন্তু লাভ হয়নি। পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ মেঘে ঢাকা ছিল। রাতে ডাইনিং হলে শুনেছিল কলকাতার একদল ট্যুরিস্ট সাত দিন ধরে এখানে সানরাইজ দেখবে বলে অপেক্ষা করে আছে। দেখা পাচ্ছে না। মেঘে ঢাকা পড়ে আছে ক’দিন ধরে। বোঝা যায় এরা প্রকৃতই নিসর্গপ্রেমিক।

উত্তর সিকিমের এই গ্রামের বিশেষ একটা জায়গা থেকে সূর্যোদয় দেখতে পাওয়া বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার। সে নাকি এক স্বর্গীয় দৃশ্য। কিন্তু দৈবাৎ সেই সৌভাগ্য ঘটে কারও কপালে। কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রায় প্রতিটি পিক প্রথমে কমলা, একটু বাদে লাল, শেষে একদম সোনালি হয়ে ওঠে। নিঃশব্দে এই রংবদল ঘটে যেতে থাকে। কমলা যে কখন লাল হয়ে উঠল, লাল হল সোনালি— এই রংবদলের খেলা সে এখন তার গোপন জীবনযাপনে স্পষ্টই বুঝতে পারছে। কী অসম্ভব নেশা ধরেছে তার। ঝিলমিল কাচপোকার রংবাহারের সামনে আরশোলা যেমন অবশ হয়ে যায়, তেমনি রাত গড়ালেই তার রক্তের ভেতরে নেশা জেগে ওঠে। তখন সব ভুলে যায় চন্দ্রা। তার নামডাকওয়ালা স্বামীর কথা, তার সংসার, তার কৃতী সন্তানদের কথা, আপাতভাবে তার তো কোনও জীবনে কোনও অপূর্ণতা নেই। তবু কেন মনে গোপন এই বাসনা আড়ালে ছিল। কেন কখনও মনে হয় কী যেন পাওয়া হল না এ জীবনে। কার সঙ্গে যেন দেখা হওয়ার কথা ছিল। কে যেন ফোন করে বলেছিল খুব দরকারি একটা কথা আছে। সত্যি নয় এসব। শুধু কখনও মনে হয়। কী আশ্চর্য আর জটিল মানুষের এই মন। সব দিক দিয়ে পূর্ণ জীবনও কখনও অশান্ত হয়ে ওঠে। এত মসৃণ যাপন মনে হয় বড় যান্ত্রিক। কিছু একটা খুঁত না থাকলে যেন স্বাভাবিক হয় না বেঁচে থাকা।
অনিকেত আর তার ভেতরে তো ভীষণ ভালবাসা। তবু কোনওদিন অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তার ব্যালকনিতে এসে বসে। তখন কেন যেন খুব কষ্ট হয় চন্দ্রার। ঠিক বোঝা যায় না। মনে হয় কী যেন, কার সঙ্গে যেন একটা নির্জন পথে দেখা হওয়ার কথা ছিল। কাকে যেন কী বলতে হবে। কে যেন ফোন নাম্বার চেয়েছিল, দেওয়া হয়নি। সব ভোররাতের স্বপ্নের মতো মনে হয়। তখন হঠাৎ মনে হয় তার সঙ্গে বুঝি এ জীবনে দেখা হবে না। মনে হয় এ জীবন বোধহয় অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল। ছায়ার মতো নাম না জানা একটা কষ্ট… কার সঙ্গে যেন দেখা হওয়ার কথা ছিল। তার সঙ্গে ভোরবেলায় সমুদ্রের পারে হাঁটবে। ঝাউবনের ওদিক থেকে দীর্ঘশ্বাসের মতো বাতাস বয়ে যাবে। পুব আকাশে তখন একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র… না অনিকেত, তুমি নও, তুমি নও। কিন্তু তোমার মতো কেউ। কিন্তু তোমার মতো হয়তো। তার সঙ্গে দেখা হবে না আমার। তাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। কে জানে, শরীর মনকে চালায়, না কি মনই শরীরকে। মনে হয় ছুঁয়ে দিলে তাকে বুঝি একরত্তি পেলাম।
অনিকেত, কেন এ রকম হয় বলো তো। সব কিছু পূর্ণ, তবু মনে হয় এ জীবন পূর্ণ হল না।

পাহাড়ি এই পথগুলোকে এখানকার স্থানীয় ভাষায় বলে চোরবাটো। আসলে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে ঝোপজঙ্গলের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা শর্টকাট পথ। বাইরের লোকের পক্ষে এ পথে ওঠানামা বেশ কষ্টের। অথচ পিঠে লকড়ির বোঝা চাপিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে ঊঠে আসে স্থানীয় মানুষজন।
সিকিম নির্বাণের চিরকালের পছন্দের জায়গা। বিশেষ করে নর্থ সিকিম। সমতল হলে উত্তরের ডুয়ার্স, পাহাড় হলে নর্থ সিকিম। চুংথাম থেকে লাচুং-এর দিকে কিছুটা যাওয়ার পথে বাঁদিকে বেশ কিছুটা নেমে যাওয়ার পরে অসম্ভব নির্জন একটা ছোট্ট গ্রাম। সেখানেও একটা হোম স্টে-র ব্যবস্থা রয়েছে। এবার সেখানে সাত দিনের জন্য বুক করেছে। একা একা সে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। কোনও পাহাড়ি বাঁকে চৌপতিয়ায় বিশাল ফার্নের পাশে বসে থাকে। কাঞ্চনজঙ্ঘা কখনও থাকে মেঘে ঢাকা, কখনও পরিষ্কার দেখা যায় চূড়াগুলো। এই নির্জনতা উপভোগ করে নির্বাণ। আরও নির্জন কোনও দূরের পাহাড়ি গ্রামের খোঁজখবর নেয়। মানুষের থেকে দূরে থাকার এই প্রবণতা তাকে ক্রমশ আরও নির্জন করে দিচ্ছিল। নির্বাণ বুঝতে পারছিল সভ্য সমাজের মানুষের সেই একই মিছিল সে আর কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারবে না। প্রতিটি মানুষের মুখশ্রী শুধু আলাদা, আর সব— কাম, ক্রোধ, লোভ, ঘৃণা, হিংসা, ভালবাসা— সবই হাজার হাজার বছরের পুরনো দাসত্ব। এর থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি নেই।
গত সাত দিন ধরে রোজ ভোরে উঠে ভিউ পয়েন্টে এসে বসে থাকছে নির্বাণ। ঘন কুয়াশা আর দূরে পাহাড়ের খাঁজে আটকে থাকা মেঘ দেখে সময় কেটে যায় রোজ। এমন নয় যে সে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাচ্ছে না বলে খুব আফসোস হচ্ছে। সমস্ত বিখ্যাত ভিউপয়েন্ট থেকেই তার সানরাইজ দেখা হয়ে গেছে। আর সেই সব সোনালি মুহূর্তগুলো কখনই সে লেন্সবন্দি করে না। অথচ প্রতিটি দৃশ্য হুবহু তার মনে আছে।
নামেই ভিউ পয়েন্ট। আসলে ঝরনাটা যেখানে প্রায় অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁক নিয়েছে, সেখানে জলের ভেতরে বিশাল সাইজের পাথরগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। খরস্রোতা সবুজ জলের ধারা পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে ফেনিল হয়ে উঠছে। আর, বিরামহীন শব্দ। কিন্তু এই শব্দের নির্দিষ্ট কোনও ছন্দ নেই। ব্যাকরণের বন্ধনহীন মুক্তছন্দে কলনাদিনী হয়ে উঠেছে ঝরনা। ঝরনার বাঁদিকে সামান্য উঁচু একটা টিলা। মাথাটা প্রায় সমতল। পাথর পেতে পেতে সিঁড়ির মতো বানানো হয়েছে টিলার মাথায় ওঠার জন্য। সেখানে মাথার ওপরে কোনও আচ্ছাদন নেই, বসার জন্য কোনও ব্যবস্থাও নেই। নামেই ভিউ পয়েন্ট। দুর্গম এই জায়গায় ট্যুরিস্ট আসেই কম। তাদের জন্য কে আর সাজানোগোছানো ভিউপয়েন্ট বানিয়ে রাখবে!

তার ব্যাগের ভেতরে বড় একটা প্লাস্টিক থাকে। সেটা পেতে নীচেই বসে থাকে নির্বাণ। আজ আর পুবে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। আজ একটু বেশি ঘন কুয়াশা। ওপর থেকে তাকিয়ে নিচের সিঁড়িগুলোর শেষ ধাপ আর দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় রহস্যময় কোনও সর্পিল পথ অনন্ত এক খাদের দিকে নেমে গেছে। ঘুরে বসল নির্বাণ। জলস্রোতের দিকে তাকিয়ে রইল। তীব্র স্রোত এসে পাথরগুলোয় আছড়ে পড়ছে প্রতিমুহূর্তে। ফেনা তৈরি হচ্ছে। সাদা ফেনা পাথর ঘিরে পাক খেতে খেতেই মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও নতুন আবর্ত তৈরি হচ্ছে। ছোট ছোট ঘুর্ণিপাক। এখানে জলের গভীরতা বেশি নয়, কিন্তু স্রোতের তীব্রতা খুব বেশি। নির্বাণ জানে, ওখানে হাঁটুজলেও স্থির দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। শরীরের ভারসাম্য টলে যাবে। পায়ের নীচে নুড়িপাথরগুলো সরে সরে যাবে। দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব। আর ক্রমাগত জলের শব্দ। মৃদু কলকল নয়, বরং মৃদু গর্জন বলা যায়।
নির্বাণ চাইছিল তার দৃষ্টি একটা পাথরে স্থির ধরে রাখতে। পারছিল না। চঞ্চল ঢেউ, জলাবর্ত, পুঞ্জীভূত ফেনা— সব মিলে দৃশ্যে যে বহমানতা রয়েছে, সেই গতি তার দৃষ্টিকে স্থির হতে দিচ্ছিল না। কখনও বিভিন্ন পাথর, কখনও স্রোতকে অনুসরণ করছিল তার দৃষ্টি। তবু সে একটা খেলার মতো একটা পাথরেই শুধু নজর করতে চেষ্টা করতে চাইছিল।
হঠাৎ তার মাথার ভেতরে কেমন করে উঠল। তার মনে হল সমস্ত পাথরসহ স্রোত রয়েছে স্থির, আর সে ভিউপয়েন্ট-সহ উজানের দিকে ছুটে চলেছে অবিশ্বাস্য গতিতে। কিছুতেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারছে না। অথচ, অস্বাভাবিক এই অবস্থা খারাপও লাগছে না। মনে হচ্ছে মহাসাগরের মাঝে ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর তাকে নিয়ে সেই ছোট্ট দ্বীপ ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে, অনির্দেশ্য পথে। সব স্তব্ধ। জলের গর্জন নেই, তীব্র স্রোতের চলমানতা নেই, কোথাও পাখির ডাক নেই, সমস্ত চরাচর হয়েছে নীরব, স্তব্ধ। সে শুধু চলেছে এক অলৌকিক ভ্রমণে।
হঠাৎ তার কানে এল মৃদু ঘণ্টার শব্দ। রাখাল ছেলে যেমন তার গোরুর গলায় ঘণ্টা বেঁধে দেয়, জঙ্গলে হারিয়ে গেলে যেন ওই শব্দে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনই দলছাড়া কোনও গোরু হয়তো জঙ্গলের পথে সন্ধ্যাবেলায় ফিরছে, দূরাগত সেই মৃদু ঘণ্টাধ্বনির মতো খুব মৃদু টং টং শুনতে পেল নির্বাণ। কান দিয়ে নয়, শব্দটা সে সরাসরি মাথার ভেতরে শুনতে পাচ্ছিল।
এই শব্দে তার সম্বিত ফিরল। স্রোত আবার আগের মতো বইছে তুমুল গর্জনে, কোথাও পাখি ডাকল, দূরে কেউ চিৎকার করে কিছু বলছে, একটা কুকুরের গম্ভীর ডাক শোনা যাচ্ছে। উষ্ণ, প্রাণময় জগতে ফিরে এল নির্বাণ। এখন কুয়াশা কিছুটা হালকা হয়েছে। সে একটা প্লাস্টিকের ওপর বসে রয়েছে, স্থির। জলের স্রোত বইছে। আবার চরাচর জেগে উঠেছে। স্থবির ঝরনা আবার গতিশীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু সত্যিই কি কোথাও ঘণ্টা বেজেছে? তখনই নির্বাণ দেখতে পেল কাষায় বস্ত্রপরা একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হালকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে পাকদণ্ডী বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ওপরে তাহলে কোথাও বৌদ্ধমন্দির আছে। হয়তো সেখানেই ঘণ্টা বেজেছে।

অঙ্কন: শুভ্রনীল ঘোষ

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ২

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ৩

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ৪

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ৫

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ৬

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ৭

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ৮

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ৯

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ১০

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ১১

মহানিষ্ক্রমণ পর্ব ১২

৫১৬ Comments
  1. বিদ্যুৎ দে says

    বেশ ভাল লাগছে । সিনেমার মত দেখতে পাচ্ছি আবার আবছায়া তেও অনুভব করছি । অদ্ভুত অনুভূতি ।

  2. Abhishek Dasgupta says

    মনোরম পরিবেশ।

  3. সৌম্যজিৎ says

    বেশ সুন্দর। অন্যরকম।

  4. সই সঙ্গীতা says

    এ লেখা মনোযোগ দাবী করে, এবং আমি মনযোগী …

মতামত জানান

Your email address will not be published.