যে অরণ্যে নর-অধমদের যাতায়াত যত কম, সে ততই রম্য। প্রান্তিক গ্রামবাসীরা এ পথে কদাচিৎ যাতায়াত করেন। বাঁশ, ফার্ন, উত্তিশ, দেওদার ইত্যাদির বনানী। পথের ওপর ঝরাপাতা। ঝরার বুকে পাতার ছায়া। পথের ওপর জলধারা। খাদের ওপারে সবুজ গিরিশ্রেণি। তার বুকে প্রজাপতির মতো এসে বসা ছোট্ট ছোট্ট ঘরবাড়ি। সবুজের বুকে দড়ির মতো আঁকাবাঁকা পথ।
বিদ্যুৎ দে
বিনা মেঘে বজ্রপাত। এমনই এক অত্যাশ্চর্য প্রত্যক্ষ করলাম এ ভ্রমণে এসে। আপাদমস্তক পাইন কাঠের তৈরি এই নির্জন অরণ্য নিবাস। ডিনারের পর তাম্রকূটের জন্য ঠান্ডা উপেক্ষা করে বাইরে। পথের এপারে পেমু হোম স্টে। ওপারে মায়পোখরির ফটক। নব্বই একরের জলাভূমি।
আলোকবৃত্তের বাইরে কালো ভল্লুকের মতো জমাট অন্ধকার। হিংস্র শ্বাপদের নিশ্বাসের মতো হাওয়া। সিগারের ধূমটাও অদৃশ্য। হঠাৎ ছিটেফোঁটা পড়ল। ওপরে তাকিয়ে দেখি নির্মেঘ আকাশ। আকাশগঙ্গা ভাসছে। বিস্ময়! বিনা মেঘে বৃষ্টিপাত?
হোম স্টে-র হোস্ট নিম দোরজি শেরপা সরেজমিনে পরখ করে বললেন, আপনি ভাগ্যবান। মাতাজির আশীর্বাদ।
কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটা কী নিমজি?
এ এক বিরল প্রাকৃতিক ঘটনা। মাটির উষ্ণতা, বাতাসের তাপমাত্রা ও জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ইত্যাদির এক সংকটাচ্ছন্ন সমন্বয়ে গাছের পাতায় জলীয় বাষ্প বাঁধা পড়ে বিন্দু হয়ে ঝরে পড়ছে এখন। শীতকালে এই ২২০০ মিটার উচ্চতায় শিশিরকণাও জমে বরফ হয়। বেলা বাড়লে জল হয়ে ঝরে পড়ে বৃষ্টির মতো।
পরদিন সকালে এক লজ্ঝড়ে গাড়ি নিয়ে হাজির গণেশ গুরুং। তৈরি কিশোর গাইড গিয়াৎছো। এই হোম স্টে-র ভবিষ্যপ্রজন্ম। গন্তব্য টোরগে জলপ্রপাত। পথের সঙ্গে ফোর-ড্রাইভ হুইলের হুড়ুম-দুড়ুম কুস্তিগিরি চলছে। কে কাকে টপকাতে পারে। পার হয়ে যাচ্ছে পাহাড়তলির ঘরবাড়ি, জঙ্গল। পার হয়ে গেল দেওরালি গ্রাম। স্কুল, পোস্টঅফিস, ডেয়ারি ফার্ম, পঞ্চায়েত অফিস, বাজার। ভারসাম্য সামলাতে গিয়ে চোখ তুলে দেখাই হল না।
আমার কলজে, কলেজ-কন্যা লাবণ্য বসেছে সামনে। যদি পাশের দরজাটা বিট্রে করে তো কী হবে? আমার দেড়মণি গিন্নি চলকে উঠে আমার কোলে, পরক্ষণেই একধাক্কায় ওপাশের দরজায়। গতকাল ইলম থেকে মায়পোখরি আসার দুস্তর পথে বাক্যবাণের স্টক খতম, তাই বুলি বন্ধ।
টোরগে যাওয়ার প্রাণান্তক মাউন্টেন র্যালি শেষ হল দেড় ঘণ্টা পর, বিশ কিলোমিটার পথের অন্তে। এখানে একটি পরিবারের কয়েকটি কুঁড়েঘর। একটা নতুন কাঠের কটেজ তৈরি হচ্ছে। অতিথিদের জন্যে। এ স্থানের নাম ফেমেগুড়া। সাংসারিক ভোগ ও ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি পেলে চুপিসারে এই ফেমেগুড়াতেই নির্বাসন নেব। কেন? রবিবালকের বুলি ধার করিয়া বলি, ‘এখানে আসিয়া যাহা জানিয়াছি তাহা না আসিয়াই জানিতে চান? সেটি হইবেক না।’

পা বাড়ালাম পাহাড়ি ঢালু পথে। হাঁটা মাত্র তিন কিলোমিটার। বাবার মতো ট্রেকিং করার ইচ্ছেয় মেয়ে গাইডের সঙ্গে তরতরিয়ে নেমে যাচ্ছে। ড্রাইভার গণেশ যে কেন মরতে এগিয়ে দিতে এল কে জানে? তুই তো বাপ কয়েক গ্যালন রক্সি গিলে নাক ডাকিয়ে ঘুম দিতে পারতিস অবলীলায়।
লাবণ্যর মায়ের ভয় শ্বাপদে আর বজ্রপাতে। এ বনে বাঘ, ভল্লুক আছে, এ সত্যিটা ফাঁস না হলে হয়তো আরও কিছুটা গড়াত। তাতে ফেঁসে যেত। টেঁসে যেত না হয়তো। উত্তরণের হ্যাপার দোহাই দিয়ে তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ, ‘নাও রিট্রিট টু ফেমেগুড়া।’ কিন্তু পৌনে ঘণ্টার ফেরার পথে চিতায় তাড়া করলে, ভল্লুকের মুখে পড়লে কী হবে? গাইড গিয়াৎছো হল গিন্নির ত্রাণকর্তা। গণেশের প্রমোশন ড্রাইভার টু গাইড।
যে অরণ্যে নর-অধমদের যাতায়াত যত কম, সে ততই রম্য। প্রান্তিক গ্রামবাসীরা এ পথে কদাচিৎ যাতায়াত করেন। বাঁশ, ফার্ন, উত্তিশ, দেওদার ইত্যাদির বনানী। পথের ওপর ঝরাপাতা। ঝরার বুকে পাতার ছায়া। পথের ওপর জলধারা। খাদের ওপারে সবুজ গিরিশ্রেণি। তার বুকে প্রজাপতির মতো এসে বসা ছোট্ট ছোট্ট ঘরবাড়ি। সবুজের বুকে দড়ির মতো আঁকাবাঁকা পথ। গণেশ দেখায়— ও গাঁওকা বগল মে বাঁইয়ে ঘুমনে কা বাদ টোরগে। আঁকাবাঁকা ঢালু পথ চলেছে সেই পানে।
এ হল নেপালের দক্ষিণ-পূর্বতম দিকের ইলম জেলা। ‘ইলম’ লিম্বু উপজাতীয় শব্দ। ‘ই’ প্যাঁচানো, ‘লম’ পথ। আমরা সোজা পথে এসেছি শিলিগুড়ি। তারপর বাগডোগরা ছুঁয়ে কাঁকরভিটা হয়ে প্যাঁচালো পথে পাক খেতে খেতে জেলা সদর ইলম হয়ে শেষবিকেলের আলোতে মায়পোখরি।

সেই শীর্ণ সর্পিল পথে যেতে যেতে দেখা হল এক অপূর্ব প্রপাতের সঙ্গে। সাদা কাছির মতো। বাঁধানো পথের প্রান্তে টোরগে পরিপূর্ণ দৃশ্যমান। পথরোধ করা পাহাড়টা যেখানে আকাশটাকে ছুঁয়েছে সেখান থেকে চলকে উঠছে টোরগে। শ্বেতশুভ্র পানি দমকে দমকে উগরে দিচ্ছে। কয়েকশো ফুট ফ্রি ফল। প্রচণ্ড অভিঘাতে প্রস্তর পরাজিত। শৈলস্তূপ ডিঙিয়ে প্রপাতের মুখোমুখি হওয়া সাহসে কুলালো না। ওপার থেকে ধেয়ে আসছে ধোঁয়ার মতো মেঘ। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জলকণায় সর্বাঙ্গ সিক্ত। লাবণ্য নির্বিবাদে এই অবগাহনকে দু’হাত তুলে বরণ করছে।
এমন সময় এক অভাবিত ঘটনা ঘটল। ধীর লয়ে। প্রপাতের ভূমিসঙ্গমে সূর্যরশ্মির স্পর্শ পড়তেই সৃষ্টি হল প্রকৃতির এক অপূর্ব মায়াজাল। উড়ন্ত বাষ্পকণায় সাতরঙা উড়নি। একটা বৃষ্টিধনুর তোরণের মধ্যে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। টোরগেও এভাবেই আবাহন জানাল লাবণ্যকে। কয়েক পলকের মধ্যে দিবাকরের অবস্থান সরে যেতেই রঙিন বঙ্কিম সেতুবন্ধ অন্তর্হিত। এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের উপস্থিতিটা মিরাকলের মতো।
প্রচণ্ড যুদ্ধের পর চণ্ডাশোকের যেমন ধর্মাশোকে রূপান্তর, ঠিক তেমনি প্রপাতের জলস্রোত শান্তভাবে প্রবাহিত হচ্ছে সঙ্কীর্ণ সবুজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে সর্পিল পথে। লতাপাতা-ফুল-ফার্ণ-ঘাসেদের ছুঁয়ে ছুয়ে। এ বিরামহীন যাওয়ার আর ফেরা নেই। কিন্তু আমরা ফিরে চলি, যে পথে এসেছি।
কয়েক’শ মিটার দূরেই একটা রেস্টিং শেড। এখান থেকে ঝরনাটার হাফফাস্ট দৃশ্যমান। শেডের পিছনে একটা নির্মীয়মাণ কাঠামো। কাঠ আর বাঁশের দ্বিতল অতিথি আবাস। বুকিং রেজিস্টার পেলে এখনই অ্যাডভান্স বুকিং সেরে নিতাম। আপাতত আতিথ্যের কিন্তু অভাব হল না। গণেশের নেপালি বুলিতে দিনমজুররা চা বানিয়ে দিল। আর ওর ঝুলি থেকে বেরোল বিস্কুট আর ওয়াই ওয়াই-এর প্যাকেট। নেপালের জনপ্রিয় ড্রাই ফুড। মশলা আর তেলের পাউচ ছিঁড়ে মিশিয়ে সেওভাজার মতো কড়মড়ালেই পঁচাত্তর ক্যালরির সঞ্চয়।
ডাইনের খাতে চেন-লিঙ্ক রেলিংয়ে ঘেরা সরু সরু তক্তা পাতা প্রায় শ’মিটার লম্বা দোদুলদুল সেতু। ওপারে গাছপালার ফাঁকে কয়েকটা চালা। সেতুর মাঝামাঝি থেকে দেখি, একটা অনামী নালার সঙ্গে টোরগে ধারার সঙ্গম। এমন সুরম্য রঁদ্যেভু-তে বলিষ্ঠ টোরগের অন্তত একজন ফিঁয়াসে তো থাকবেই।

কষ্ট করলে কেষ্ট— এ প্রবাদটি উল্টে দিলেও যে তা সমান সত্যি হয় সেটা চড়াই উঠতে উঠতে মালুম হচ্ছিল। আমার ঘরণী অতি বুদ্ধিমতী। ভাবের ফাঁদে পা ফেলেননি। না হলে হেলিকপ্টারের বন্দোবস্ত করতে হত। মেয়ের হালও ভাল নয়। কাতর কণ্ঠে বলে, বাবাগো, আর পারছি না। এবার ঘোড়া ভাড়া করো।
এখন কোথা থেকে পাব?
ফোন করে ডেকে নাও না।
ভাগ্যিস ওলা-উবের বলেনি!
গণেশের রুক্ষ-কঠিন মুখে করুণার আভাস। বেটি, সোচো মাত। হাম তো হ্যায় না। পিঠ মে উঠা লেঙ্গে।
তারপর কীসব বকবক করতে করতে একসময় ফেমেগুড়ার টিনের চালাটা দেখা গেল। পাহাড়তলির বৈঠকখানায় খানাঘর, রসুইখানা, বৈঠকখানা— সব অল-ইন-ওয়ান। একজন মধ্যবয়েসি মহিলা লোহার কড়াইয়ে ভুট্টা-কড়াই ভাজছেন। গণেশ চালকুমড়োর মতো শসার ছাল ছাড়াচ্ছে। জ্বালানি গোঁজার আর্চের পাশে বিড়ালটা আগুন পোহাচ্ছে। আর নিচু ভাঙাচোরা মোড়ায় একজন নোনাজারিয়ান নিশ্চুপ। বোবা দৃষ্টির জীবন্ত উদাহরণ হয়ে।
স্টিলের থালায় ঠান্ডা শসার চাকতি আর জ্বলন্ত ভুট্টার খই। ইচ্ছে হল পুড়িয়ে খেতে। সেই মহিলা হারিয়ে গেলেন দালানের ওপাশে ভুট্টা-বাগিচায়। বুনো চা-পাতার রোদ পোহানোর পাশে লাবণ্য বসে রোদ্দুর মাখছে আর সেলফি তুলছে। গ্রামীণ চা-পাতা দেওয়া জল টগবগিয়ে উঠল। ভুট্টার পাত্তা নেই। পাত্তা নেই তেনারও। গেল কই রে গণেশ, দেক দিকিনি। এবার গাইড ও প্রক্সি গাইড দুজনেই স্পিকটি নট। কী চলছে কে জানে?
তবে ভুট্টার ক্ষেত্রে কোনও ষড়যন্ত্র ছিল না। তিনটে ভুট্টাকে ছালসুদ্ধু ফেলা হল চুলায়। তন্দুর ভুট্টার এমন স্বাদ, গন্ধ অনাস্বাদিত। আরও চাই যে। এ দাবিতে ভাবিজি শুকনো মুখে বলেন, সারা খেত ছানমিন করে এই তিনটেই মাত্র কচি মকাই পেয়েছি। আর সব আটা ভাঙানোর মতো শক্ত হয়ে গেছে। এবার বুঝলাম দেরির কারণ। গিয়াৎছোকে বলি, যা, একটা ভাবিজিকে দিয়ে আয় তো। ওর ইশারায় দেখি বপু দুলিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে তিনি আসছেন উঠোনের ওপর দিয়ে।
ওহ! ওদের পাটভাঙা লেপ-কম্বলে যা একখান ঘুম হল না…!
এমন কিছু মধুর ঘুম আছে যা মনে হয় না ভাঙলেই ভাল হত। সমস্ত স্বপ্নের একটা উৎস থাকে। যা বাস্তব ও অবাস্তবের মিশ্রণ। তা হারিয়ে যায় স্মরণ ও বিস্মরণের মায়ার কুহেলিকায়।

ফিরে এসেছি টোরগে ট্রেকিং সেরে। ফুলের টবে সাজানো চৌকাঠে দাঁড়িয়ে নিম দোরজি শেরপা। কফি আর চিকেন পকৌড়া দিয়েই আর রুমে যাওয়ার অবসর দিলেন না। দোরজি ম্যাডাম যে প্রতিদিনের মতো এখনই ইভনিং ওয়াকে পোখরি পরিক্রমায় যাচ্ছেন। আমার ম্যাডাম উষ্ণ আশ্রয়ে থিতু হলেন। ছটফটে পোষ্য লোমশ স্প্যানিয়ালটা আমাদের সঙ্গী। তার লাগাম লাবণ্যের হাতে। ও নাম দিয়েছে কুট্টুস। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল আদুরেটা।
পাথরে বাঁধানো পথ। ঝরাপাতার আভরণে সাজানো। প্রাচীন বৃক্ষরাজি সটান দণ্ডায়মান। মস, ফার্ন আর অর্কিডের নিরাপদ আশ্রয়। অরণ্য এখানে খুব সুখে আছে। রামসার জলাভূমির আন্তর্জাতিক তকমার ছত্রছায়ায়। কোথাও বনানী এতটাই গভীর যে তার ছায়া ছিঁড়ে অর্কের প্রবেশ নিষেধ। পথের ওপর কাঠের সাঁকো। বাঁয়ে উঠে গেছে পাহাড়। ডাইনে সবুজের ফাঁকে ফাঁকে আকাশের আয়না। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক শুঁড়ি পথ গুঁড়ি মেরে ঢুকেছে অরণ্যের অন্তরালে। নিম ম্যাডাম শুধু নেপালি ভাষাই জানেন। তাই হয়তো অল্পই মুখ খোলেন। ভাষার ব্যবধানে এইসব পাকদণ্ডীর শেষ প্রান্তে কী আছে তা অজানা থাকল। সন্ধে গড়িয়ে যাচ্ছে রাতের আঙিনায়। পরিক্রমার দৈর্ঘ্য তিন কিলোমিটারেরও বেশি। তাই উৎসাহকে দমন করি।
উৎসাহের স্পন্দন কুট্টুসের নেটওয়ার্কে পৌঁছে ছিল বলেই মালকিনের আপত্তি না মেনে বাঁক নিল বাঁদিকে। ছোট্ট একটা চড়াই বেয়ে পাহাড়ের পিঠে। মেঘলা আকাশের প্রেক্ষাপটে গুম্ফার তোরণ। লম্বালম্বি নিশানে উড়ছে বুদ্ধের বাণী। নির্বান্ধব এই উপাসনালয়ের বন্ধ দ্বারে এক প্যাকেট বিস্কুট বেঁধে গেছে খাদা দিয়ে। কুট্টুসের এক বাদামি বান্ধবী ছুটে এল। খোলা মাঠে ছোটাছুটি, ঝুটোপাটি খুনসুটি। টিপটিপ বৃষ্টি। মালকিনের ধমকে কুট্টুস ফিরমুখো হল নিমরাজি হয়ে। ওর গার্লফ্রেন্ড তোরণ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।
জঙ্গলের মধ্যে ঘুম-ঘুম অন্ধকারে একটা ভগ্নপ্রায় পাথরের বাড়ি। দেওয়াল ফেটে চৌচির। টিনের চারচালাটা হুড়মুড়িয়ে পড়তে বাকি। জঙ্গলের দিকে চওড়া বারান্দা। ডানপাশে একটা দোচালা আউটহাউস। কাঠের খড়খড়ি দেওয়া জানলা-দরজাগুলো এখনও কেউ হাতিয়ে নেয়নি। আঙিনায় খোলা গোলঘর। বসার মাচা। একসময় যে পরিচর্যাময় উদ্যান ছিল তারই আভাস ইতস্তত ছড়ানো। এত সুন্দর অবস্থানে এই অবস্থায় বাংলোটা কেন পড়ে আছে?

এর সদুত্তর পেলাম নিমজির সঙ্গে ‘নাইট ইজ স্টিল ইয়ং’-এর আড্ডায়। সুসজ্জিত বৈঠকখানায় কাঠের সেন্টার টেবিলে কাটিং গ্লাসে শ্যাম্পেন। সন্ধের অবসরে এটাই মালিকের একমাত্র বিলাস। নেপালের প্রায় সমস্তরকম সুরা-সহ বিদেশের কিছু অ্যান্টিক ওয়াইনও সাজানো আছে কাউন্টারে। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঠোঁট মুছলেন।
নেপালের রাজা বীরেন্দ্রর তখন কিশোর বয়স। দার্জিলিঙের বোর্ডিং স্কুলে পড়েন। ছুটিছাটায় রাজধানী ফেরার দীর্ঘ পথে একটা রাতের আশ্রয় ও বিশ্রামের জন্য রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেবের এই অতিথিনিবাস নির্মাণ। অন্য সময় অতিথি অভ্যাগতরা আসতেন জঙ্গল বিলাসের জন্যে। ২০১৫-এর ভূমিকম্পের পর পরিত্যক্ত। রাজসম্পত্তি বলেই কারও কুনজর পড়েনি আজও।
এছাড়াও এই হোম স্টে-র অতীত-ভবিষ্যৎ, পূর্ব নেপালের অন্যান্য অপরিচিত সব দ্রষ্টব্য স্থান, নানা হাঁটাপথের দিশা, মহার্ঘ জড়িবুটি, ভল্লুকের পিত্তরসে হাঁপানির নিরাময়তা, ট্যুরিজম, মিথ— কতকিছুর সন্ধান পেলাম তিন তিনটে প্রলম্বিত রাতের আসরে। তার মধ্যে শুধুমাত্র অবিশ্বাস্য সংযোগের গল্পটাই বলি।
মায়পোখরি হল মায়ের পোখরি। সদাজাগ্রত। চারদিকে নানা ধর্মের পূজাস্থল ছাড়াও বোটানিক্যাল নার্সারি, ভেষজ উদ্যান ইত্যাদির নিরালা সহাবস্থান। এসবের একটি হল নাগদেবতার আশ্রম। প্রতিদিনের রীতি মেনে পাখির ঘুম ভাঙার আগে পরিমার্জনার কাজ সারতে হয়।
নিমজির চোখ প্রদীপের শিখার মতো উসকে ওঠে সেই ভয়ংকর ভোরের স্মৃতিচারণায়।
অন্ধকারে আর্তচিৎকার শুনে দৌড়ে গেলাম। নাগমন্দির ঘাটে পৌঁছে দেখি পূজারি থরথর করে কাঁপছেন। দেখলাম কালো জলে ভেসে যাচ্ছে উপাচার। তেলের প্রদীপ নিয়ে ফিরে এসে পূজারি দেখেন সব ভেসে গেছে। দেবতা কি ক্রুব্ধ হলেন? আয়নার মতো স্থির জলতলে তখন তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে। দূরদূরান্তে যত দূর সে আর্তচিৎকার পৌঁছেছিল তারা সকালে এসে ভিড় জমালো। দেখা গেল পাড়ের গুঁড়ির গায়ে সাত মিটার ওপরে জলের দাগ।
বেলা বাড়তে খবর এল জেলা সদর থেকে। ২০০৪-এর ২৬ ডিসেম্বর। ইন্দোনেশিয়া-সহ উপকূলের দেশগুলোতে সুনামি আছড়ে পড়ছে। ভারত মহাসাগরের গভীরে যখন চলছে টেকনিক প্লেটের সংঘর্ষ, ঠিক তখনই এই চার হাজার কিলোমিটার দূরের চিরশান্ত সরোবর উত্তাল হয়ে উঠল। কেন? এর উত্তর কে দেবে?

পরদিন তিব্বতি পরোটা দিয়ে প্রাতরাশের মহাভোজ সেরে সপরিবারে পোখরি পরিক্রমা। মূল ফটকের পর সুসজ্জিত রক গার্ডেন। ভিউ টাওয়ার। রেস্টিং শেড। অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপিং গার্ডেন। এসব তো মালির হাতের কারিকুরি। এরপর প্রকৃতির আপন খেয়ালে গড়ে ওঠা নন্দনকানন। চতুষ্পার্শ্বের চারটে ঘাট থেকে সরোবরের চার রকমের নিসর্গ। যেখানটা সবচেয়ে উন্মুক্ত সেই বাঁধানো রেলিং দেওয়া পাটাতনে বসলাম। ওপারের জলতল থেকে ঠাসবুনোট বনজঙ্গল উঠে গেছে আকাশের দিকে। পাহাড়ি তালাও থেকে নাকি ঝরাপাতা তুলে নেয় পাখিরা। তুলতে দেখিনি কখনও। তবু বিস্ময় জাগে, অরণ্যের ঝরাপাতারা যায় কোথায়! জলের রং ঘন সবুজ। আকাশের নীলও তো আছে। তবে শুধু সবুজ কেন? উত্তরটা এল তার রংবদলের ভাষায়।
ঝুলন্ত পাটাতনের নীচে রঙিন মাছের আনাগোনায় নজর নিবদ্ধ ছিল। দেখলাম জলের বর্ণ পাল্টে যাচ্ছে। ডানদিকের পাহাড়ের মাথায় মেঘের হানাদারি। হঠাৎই এক গলিপথ গলে জলদের দল হামলে পড়ল সরোবরের বুকে। ধীরে ধীরে চারপাশটা ঘোলাটে। জলধরেরা পালকের মতো নরম আদরে ভরিয়ে দিল জলতল। সমস্তটা হয়ে গেল আকাশের দোসর। ঘনাচ্ছন্নতা সরে যাওয়ার পর আবার রোদঝিলমিল। যেন স্বপ্নের মতো পার হয়ে গেল মুহূর্তটা। এই যে নীরদের দল এল, আবার চলেও গেল। কেন? পশুরা যেমন তৃষ্ণা মেটাতে ও স্নান করতে আসে তেমনই কি?
চক্রাকার পরিক্রমার শেষ অংশে একটি আশ্রম। কয়েকটি পর্ণকুটির। একটি বৃত্তাকার দোর-বন্ধ প্রাচীন দেবালয়। এর ঠিক নীচেই বড় রাস্তার ওপারে আমাদের অস্থায়ী আস্তানা।
তিন দিনে তিনবার তিনরকম সময়ে পরিক্রমা করেও অপূর্ণতা রয়ে গেল। একবার রাতে যেতে চেয়েছিলাম একলা।
যাবেন না।
কেন নিমজি? কীসের ভয়?
ভয়? ভয় তো বাইরে নয়, মনের ভেতরে থাকে।
তবে কেন মানা করছেন?
অরণ্যের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে যে। তবুও যদি চান, তো যান।
বারণকে বরণ করে নিয়েছিলাম।

শেষদিন। সন্ধে হয়ে আসছে। লাবণ্য আবার যেতে চাইল কাছের আশ্রমটায়। হয়তো টেলিপ্যাথির টান। নয়তো এতকিছুর থেকে ওটাই ওকে শেষ মুহূর্তে ডাকবে কেন? টুংটাং শব্দ। সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম আশ্রমের চাতালে। কেউ কোত্থাও নেই। শুধু শব্দটা আছে। এখন বৃত্তাকার মন্দিরের দরজাটা হাট। ভেতরে ঘৃতদীপ জ্বলছে। ভেষজ ধূপের অদ্ভুত গন্ধ। মুহূর্তে যেন কয়েক যুগ পিছিয়ে গেলাম। ঘণ্টাধ্বনি দূর থেকে নিকটবর্তী হচ্ছে। অদ্ভুত রোমাঞ্চ। একজন নোনাজারিয়ান পূজারি প্রবেশ করলেন গর্ভগৃহে। দুর্বোধ্য শব্দে মন্ত্রোচ্চারণ-সহ আরতি। কাজ সেরে নিঃশব্দে চলে যাচ্ছিলেন। লাবণ্যর ডাকে যেন ধ্যান ভঙ্গ হল তাঁর। দু’জনের কথোপকথন চলল কিছুক্ষণ। ভাষার বোধগম্যতা না থাকা সত্ত্বেও। তারপর পদস্পর্শবিরোধী জেডজেন কন্যা তাঁর চরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করল। অস্থিচর্মসার করতল কন্যার মস্তকে।
খাবার ঘরে চকচকে কাঁসার থালা সাজানো হয়েছে। আমরা ফিরতেই খাবার গরম করা শুরু হল। আজ শেষ রাত। গ্র্যান্ড ডিনার। প্রতিদিন একডজন পদ থাকত। আজ যুক্ত হবে আরও নতুন তিনটে পদ। এইসব পদ নিয়ে গদ্য শানালে আরও একটা আর্টিকেল হতেই পারে। নিমজি প্রথম সম্ভাষণে বলেছিলেন, ইয়ে মকান সমঝ লো আপনাই হ্যায়। প্রতিশ্রুতি ছিল একই মেনু রিপিট হবে না। তবে হয়েছিল লোকাল মাশরুমের আইটেমটার। আমাদের রিকোয়েস্টে। তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টাতে কাঠের সিঁড়িতে পা দিতেই দেখি ওদের ছানাটা হামাগুড়ি দিয়ে উঠছে। তাহলে ওয়াশরুমের কাজটা সেরে নিই বরং।
জুতো খটমটিয়ে দোতলায় উঠে দেখলাম কমন বাথরুমের মেঝেতে মগ নিয়ে জল ঢালছে ছানাটা। ধুয়ে দিচ্ছে আমার ফেলে আসা জুতোর দাগ। কেউ তো বলেনি ওকে সাফ করতে। হোম স্টে-র হোস্টের সম্ভাষণের কথাটা ফিরে এল বিদ্যুৎচমকের মতো। নিজের ঘরের বাথরুম এভাবে ভুলেও কি মাড়িয়েছি কোনওদিন? আমার শিক্ষাদীক্ষা নতজানু হল প্রকৃতির স্তন্যপান করে বড় হওয়া এই শিশুটির কাছে।
পরদিন কন্যমে চা-বাগানের হোম স্টে-তে থেকে তার পরদিন শ্রীঅন্তু লেকের পাড়ে। পরদিন রাতে জলপাইগুড়ি থেকে ঘরে ফেরার তাড়া।
ঘুমন্ত ট্রেনের জানলায় আলোর মালা সরে যেতেই অন্ধকার। মনের অন্তর থেকে উচ্চারিত হচ্ছে রবিঠাকুরের বাণী— ‘ঘরেতে এল না সে তো মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া।’ ঠিক এই শব্দবন্ধের মায়াজালে থমকে গেলাম। দু’বছর পার করেও সেই মায়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারিনি। চাইও না।
বিদ্যুৎ দে’র ‘ মায়পোখরি ‘ পড়ে সুবোধবাবুর ‘রম্যাণি বীক্ষ্য ‘ মনে পড়ে যায়। শাদামাটা বেড়ানো – কথা নয়, সাহিত্যরসে জারিত এই বর্ণনা।
আপ্লুত প্রশংসায় এবং লজ্জিত সুবোধ বাবু র তুলনায়।
না ভাই, এ অতিরেক নয়। ভালোলাগার অনাবিল প্রকাশ।
ভ্রমণ কাহিনী এমন সুন্দর করে লিখলে পাঠকের ও অর্ধভ্রমণ হয়ে যায়।
প্রকৃতির ভেষজ ঘ্রাণে বুক ভরে নিলাম । পরের দিনগুলোয় একটু একটু করে খরচ করবো বলে ।
ততদিন, যতদিন না আপনার আর একটি অপরূপ ভ্রমণকাহিনী হাতে পাই । আশায় রইলাম ।