বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

সহজ পাঠ-এর সমাজ

লোকা ধোবাকে বলব ‘তুমি’, আর শক্তি-মুক্তিকে বলব ‘আপনি’! কেন? কেন ধোবাটির সম্পত্তির মধ্যে একখানি গাধা আছে বলেই কি সে ‘তুমি’?
এই শিক্ষা শিশুপাঠ্যপুস্তক সহজ পাঠ কেন দেবে একটি মুক্তমনের ছোট্ট শিশুকে?

অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য

রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’। এই বইয়ের দুই ভাগ। প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ। দুটি ভাগই প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে নব্বই বছর আগে, ১৯৩০ সালে। বাংলাভাষার খুবই জনপ্রিয় শিশুপাঠ্যপুস্তক। এযাবৎ লক্ষ লক্ষ কপি বই বিক্রি হয়েছে। চোখ বুজলেই নন্দলাল বসুর আঁকা কাঠখোদাই অসামান্য ছবিগুলো মনে পড়ে। হামাগুড়ি দেওয়া ‘ছোটো খোকা’, ‘বড়ো বৌ’-এর ভাতরাঁধা কিংবা ‘শাল মুড়ি দিয়ে হ ক্ষ/ কোণে ব’সে কাশে খ ক্ষ।’ দ্বিতীয় ভাগেরও অনেক ছবি মনে পড়ে। ‘তিনটে শালিক ঝগড়া করে’— সেই কবিতার মাথায় নন্দলালের আঁকা দুটি শালিকের ছবি ভোলবার নয়। প্রথম ভাগে যেসব চরিত্র আছে তার মধ্যে ছোট খোকা, ছোট বউ, বড় বউ এদের কথা সহজেই মনে পড়ে। দ্বিতীয় ভাগে আদ্যনাথবাবু, রঙ্গলালবাবুদের কথা মনে পড়ে।

আচ্ছা, সহজ পাঠের সমাজে আমাদের কত মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে বলতে পারেন? দুটি ভাগ মিলিয়ে আমরা শতাধিক মানুষের সাক্ষাৎ পাই! ওইটুকু বই। দুটি খণ্ড বলতে গেলে ৫০ পাতা করে। ১৯৩০-এ যখন বই বেরোয় তখন সেই প্রথম সংস্করণে দুটি ভাগের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫৩ এবং ৫১। এই বইয়ের প্রিন্ট ম্যাটার তো যথেষ্ট কম। তাতে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বড় বড় ছবি; সমগ্র বইটি মুদ্রিতও হয়েছে বেশ বড় হরফে। আমাদের একালে তাকে ২২ পয়েন্ট বলা যেতে পারে। এই যে সচিত্র ছোট্ট বই, এর প্রতিটি ভাগের মধ্যে পঞ্চাশ মানুষের বিচরণ ভাবলে অবাক হতে হয়।
এইসব মানুষগুলোর পরিচয় জানতে আমার কৌতূহল। গত নব্বই বছরে তেমনভাবে এদের খোঁজ তো আমরা করিনি।
প্রথমে প্রথম ভাগের মানুষগুলিকে খুঁজি। প্রথম ভাগের শুরু ছোট খোকা দিয়ে হলেও সমস্ত প্রথম ভাগে ছোট খোকা বা ছোট খুকুদের সংখ্যা কিন্তু খুবই কম। ঞ-তে ‘খিদে পায়, খুকি ঞ/শুয়ে কাঁদে কিয়োঁ কিয়োঁ।’

প্রথম ভাগের দ্বিতীয় পাঠে যে রামটিকে পাই, সে শিশু না শিশুর দাদা নাকি জ্যাঠা, তা পরিষ্কার বলা যায় না। ‘ফুল তুলে রাম বাড়ি চলে। তার বাড়ি আজ পূজা।’ সে সেই পুজোর জন্য ফুল তুলে বাড়ি ফেরে। তাকে একটি কিশোর বালকই মনে হয়। এই দ্বিতীয় পাঠে দেখি ‘ছোটো খোকা দোলা চ’ড়ে দোলে।’ বুঝতে পারি এই ‘ছোটো খোকা’ ওই অ আ-রই ‘ছোটো খোকা’।
সহজ পাঠ প্রথম ভাগ বইয়ে এর বাইরে আর তেমন কোনও ছোট খোকা ছোট খুকিকে পাই না।
এবার একটি একটি পাতা উল্টে দেখা যাক।
স্বরবর্ণ পর্যায়ে বড়দের মধ্যে প্রথমেই পাই ‘বড়ো বৌ’টিকে। নন্দলালের ছবির সেই বড় বউ। জ্বলন্ত উনুনের উপরে ভাতের হাঁড়িতে চাল ফুটছে, সে উনুনের সামনে পিঁড়িতে অনেকটা উবু হয়ে বসে। কী সুন্দর গৃহস্থ বাড়ির বউটি। ডান হাতে ভাতের হাঁড়িতে কাঠি দিচ্ছে। কে ওই ‘ও ঔ’? সে কি শ্বশুর, না কি শাশুড়ি, না কি তার স্বামী? কীরকম একটা আদেশের ভঙ্গি! বউমার মুখে-চোখে ভাব— হ্যাঁ হয়ে গেছে হয়ে গেছে, ফ্যানটা গেলেই যাচ্ছি যাচ্ছি। সাদা-কালো ছবিতে তার কালো মুখে গভীর পরিশ্রম আর উদ্বেগের ছবি। এখানে কবিতার কথার চেয়ে চিত্রীর ছবিই বেশি কথা বলেছে।

ব্যঞ্জনবর্ণে এসে দেখি ‘ট ঠ ড ঢ করে গোল/কাঁধে নিয়ে ঢাক ঢোল।’
নন্দলালের আঁকা পাকা ঢুলির ঢোলবাদনের ছবিটি অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথের কবিতা তখন ঢোলের বোলে নেচে ওঠে।

‘প ফ ব ভ যায় মাঠে,/সারা দিন ধান কাটে।’ নন্দলাল এখানে এক কৃষ্ণকলির ছবি এঁকেছেন। ধানখেতে মেয়েটি ধান কেটে চলেছে, হাতে তার কাস্তে।

‘ম’-এ এক বৃদ্ধ গাড়োয়ানকে পাই; গোরুর গাড়ি চালিয়ে নিয়ে চলেছে।
আর ‘য র ল ব ব’সে ঘরে/এক-মনে পড়া করে।’ সেও শিশু নয়— সে কিশোর-বালক।
অন্যদিকে যে ‘শ ষ স বাদল দিনে/ঘরে যায় ছাতা কিনে।’ তারাও শিশুর পর্যায়ে পড়ে না। নিজেরা যারা বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করে তারা শিশু হবে কেন?

ব্যঞ্জনবর্ণে শেষে ‘শাল মুড়ি দিয়ে হ ক্ষ/কোণে ব’সে কাশে খ ক্ষ।’ সে সত্যিই বড় বুড়ো। আপনমনে সেই বৃদ্ধ শাল মুড়ি দিয়ে পুথি-পাঠ করছে।

প্রথম ভাগের প্রথম পাঠে অনেকগুলি মানুষকে পাই। দেখুন কাকে কাকে পাই। বুড়ি দাই, খুদিরাম, মধু রায়, জয়লাল, অবিনাশ, হরিহর, পাতু পাল, দীননাথ এবং শেষে ‘গুরুদাস/করে চাষ।’ এরা শিশুপাঠ্যপুস্তক বইটিতে কেউ কিন্তু শিশু নয়।
কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ জাম পাড়ছে, কেউ খেয়া বায়, কেউ হাল ধরে, কেউ ঘাস কাটে, কেউ ঘর বাঁধে, কেউ ভাত রাঁধে, কেউ চাষ করে।

দ্বিতীয় পাঠে রামের কথা আগে বলেছি— গায়ে তার লাল শাল।
ওই পাঠে ‘ভোলা মালী’-কে পাই। সে ‘মালা নিয়ে ছোটে।’ ‘ভারী আনে ঘড়া ঘড়া জল।’ ‘মুটে আনে সরা খুরি কলাপাতা।’
তৃতীয় পাঠে মামা, দাদা, বাবা, কাকা অনেককে পাই। তৃতীয় পাঠ সংলগ্ন যে কবিতাটি আছে সেখানে দেখি ‘ডিঙি চ’ড়ে আসে চাষী’— সে ‘গাঁয়ে ফেরে গেয়ে সারিগান।’ আর ওই কবিতাতেই আছে ‘মোষ নিয়ে পার হয় রাখালের ছেলে,/বাঁশে বাঁধা জাল নিয়ে মাছ ধরে জেলে।’

চতুর্থ পাঠে একাধিক মহিলা ও দু-একটি পুরুষকে পাই। তারা হল: ‘বিনি পিসি’, ‘বামি’, ‘রাণীদিদি’, ‘বুড়ি দাসী’ এবং ‘নীলু’ ও ‘দীনু’।
চতুর্থ পাঠ সংলগ্ন যে কবিতা তার প্রথম চরণ: ‘ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি।’ এই কবিতায় হরি মুদিকে পাই; ‘চাল ডাল বেচে তেল নুন।’ আর পাই ‘বিধু গয়লানী’-কে। সে আর ছেলে দু’জনে মিলে ‘সকালবেলায় গোরু দোয়।’

আর কবিতার শেষ স্তবকে পাই ‘কানাই বলাই’ এবং সেইসঙ্গে পাই সেই ‘বড়ো বৌ’টিকে, যে উনুনের গোড়ায় বসে ভাত রাঁধছিল। পরে ‘বড়োবউ’-এর পাশে ‘মেজোবউ’-ও এসেছে। তবে দুই পাতার দুটি বড় বউয়ের মধ্যে তফাত— প্রথমজন ‘বড়ো বৌ’, আর দ্বিতীয়জন ‘বড়োবউ’। শিশুপাঠ্য বইতে দুই বৌ/বউ মোটেই ভাল কথা নয়।

পঞ্চম পাঠে ‘দুখী বুড়ি’, ‘গুপী’, ‘নুটু’, ‘উমা’, ‘উষা’, ‘চুনি মালী’— এদের পাই। ‘চুনি মালী কুয়ো থেকে জল তোলে।’
ষষ্ঠ পাঠে বিস্তর নাম। এত নাম কেন? ‘ঐ-যে আসে শচী সেন, মণি সেন, বংশী সেন, আর ঐ-যে আসে মধু শেঠ আর খেতু শেঠ।’ একটি সেন আর একটি শেঠ হলেই তো হত। সে জায়গায় দুই শেঠ, তিন সেন। এই সব শেঠেরা, সেনেরা ফুটবল খেলবে।
ষষ্ঠ পাঠে এ-কার, সপ্তমে ঐ, অষ্টমে ও-কার এবং নবম পাঠে ঔ-কারের উদাহরণ পাই।

সপ্তমে ‘শৈল’ ‘কৈলাস’ ‘মৈনিমাসি’; অষ্টমে ‘লোকা ধোবা’, ‘মেজো মেসো’-কে পাই; আর নবমে পাই ‘গৌর’, ‘কৌলু’, ‘সৌরিদিদি’-কে।
আর শেষ পাঠ, দশম পাঠে আছে চন্দ্রবিন্দুর উদাহরণ। তবে চন্দ্রবিন্দুযুক্ত ‘খাঁদু’ ‘পাঁচু’-দের তো আর বেশি পাওয়া যায় না। খাঁদু ও পাঁচুর সঙ্গে বাঁদর, ভোঁদা কুকুর আর একঝাঁক হাঁসেরও সন্ধান কবিকে দিতে হয়েছে।
প্রথম ভাগে সাধারণ মানুষ ছাড়া নানা জীবিকার মানুষও পাওয়া গেছে। ‘ঢাকি’, ‘চাষী’, ‘ভারী’, ‘মুটে’, ‘রাখাল’, ‘জেলে’, ‘গয়লা’, ‘মালী’, ‘ধোবা’ ইত্যাদি।
‘ঢাকি’ কী করে? কাঁধে ঢাক নিয়ে ‘করে গোল’। চাষা বা ‘চাষী’ কী করে? না সে ‘সারা দিন ধান কাটে’।
‘ভোলা মালী’ কী করে? সে ‘মালা নিয়ে ছোটে’। আর ‘ভারী আনে ঘড়া ঘড়া জল’। আর ‘মুটে আনে সরা খুরি কলাপাতা’। আর একটি কবিতায় আছে ‘বল দেখি তুই মালী’।
সমাজে আমরা বিভেদ তৈরি করি। কাউকে ছোট বানাই, কাউকে বানাই বড়। জমিদার শ্রেণির মানুষরা হলেন মান্যগণ্য ব্যক্তি। ছোটদের আমরাই জন্ম থেকে শিক্ষা দিই সমাজের এইসব মানুষজনকে খাতির করতে হবে, সম্মান করতে হবে, আপনি-আজ্ঞে করতে হবে। এরা সব সমাজের বড় মাপের মানুষ, উঁচু মহলের মানুষ, এরা সব দেশের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। এদের যেন কখনও তুমি বা তুই-তুকারি করে বলা না হয়। কিন্তু আমাদের বাচ্চাদের আমরা শিখাই ধোবা মালী মুটে মজুর গাড়োয়ান— এরা বয়সে যতই বড় হোক না কেন, এদের আপনি-আজ্ঞে বলা চলবে না। এইসব ছিন্নবস্ত্র দরিদ্র অর্ধভুক্ত খেটেখাওয়া সামান্য ‘অশিক্ষিত’ মানুষ— এদের তুই বা তুমি করে কথা বলতে হবে। ‘আপনি’ সম্বোধন পাবার তাদের কোনও অধিকার নেই।
সহজ পাঠের সমাজেও ঠিক তেমনটাই দেখি। ‘ধোবা’, ‘মালী’, ‘মুটে’, ‘গাড়োয়ান’, ‘ভারী’— এঁরা সহজ পাঠ বইতে স্থান পেয়েছেন বটে, কিন্তু সম্মান পাননি।

সহজ পাঠের দ্বিতীয় ভাগে এই ব্যাপারটা আরও প্রকট হয়েছে।
সহজ পাঠ দ্বিতীয় ভাগে প্রথমে দেখা যাক ক’টি চরিত্র আছে এবং কী কী চরিত্র আছে? দ্বিতীয় ভাগের প্রথম পাঠ শুরু হয়েছে পৃষ্ঠা ৫ থেকে। এবার না হয় পৃষ্ঠাসংখ্যার উল্লেখ করে যাই, পাঠক-শ্রোতার হয়তো বই ধরে দেখতে বেশি সুবিধা হবে।
পৃষ্ঠা ৫— বংশু, সংসার-বাবু, মহারাজ হংসরাজ সিংহ।
পৃ. ৬— কাংলা, সংসার-বাবুর মা।
পৃ. ৭— আদ্যনাথবাবু, আদ্যনাথবাবুর মেয়ে শ্যামা, বর বৈদ্যনাথ, বরের ভাই সৌম্য, ধৌম্যনাথ, রম্যনাথ।
পৃ. ৮— চাষী, ছেলেরা, নিত্যশরণ।
পৃ. ৯— গাড়ি চালায় বংশীবদন, ভাগ্নে মদন।
পৃ. ১০— গ্রামের মানুষ, চাষীর মেয়ে, অন্ধ কানাই।
পৃ. ১১— রঙ্গলাল-বাবু, দাদা বঙ্গ-বাবু, সিঙ্গি, অনঙ্গদাদা।
পৃ. ১২— ভিঙ্গি মেথর, ক্ষিতিবাবু, অক্ষয়-বাবু, ঈশান-বাবু।
পৃ. ১৩— আনন্দ-বাবু, ইন্দু।
পৃ. ১৪— বেহারা, দীনবন্ধু, সিন্ধু-বাবু, বিন্দু, নন্দী, অন্ধ গায়ক।
পৃ. ১৫— দুর্গানাথ।
পৃ. ১৬— চাষী, কর্তাবাবু, আর্দালি তুর্কি মিঞা, মা।
পৃ. ১৯— অনন্ত, কলেজের ছাত্রেরা, শান্তা।
পৃ. ২০— মিশ্রদের বাড়ি, কান্ত চাকর, বোন ক্ষান্তমণি।
পৃ. ২১— শ্রীশ, বসন্ত।
পৃ. ২২— তমিজ মিঞা, ছাত-পিটুনি।
পৃ. ২৩— বাসনওয়ালা, আতাওয়ালা, ছেলেরা।
পৃ. ২৫— ঠাকুর (রান্নার), বঙ্কিম, কঙ্কা।
পৃ. ২৬— সৃষ্টিধর, কেষ্ট, সঞ্জীব।
পৃ. ২৭— রঞ্জন, কাঞ্জিলাল, তুষ্টু, বোষ্টমী।
পৃ. ২৮— ছোট্ট মেয়ে।
পৃ. ৩০— উল্লাস।
পৃ. ৩১— ভজ্জু, খুকি, বাঞ্ছা।
পৃ. ৩২— মন্টু, রেভারেণ্ড এণ্ডার্‌সন, পণ্ডিত-মশায়।
পৃ. ৩৪— ভক্তরাম, শক্তিনাথ-বাবু, মুক্তিনাথ, শক্তু সিং, আক্রম মিশ্র।
পৃ. ৩৫— অক্রুর (চাকর), বিক্রম।
পৃ. ৩৮— কাঠুরিয়া।
পৃ. ৩৯— সর্দার, বিনু।
পৃ. ৪১— বিশ্বম্ভর-বাবু, শম্ভু চাকর।
পৃ. ৪৩— মধু বিশ্বাস, রাখাল।
পৃ. ৪৫— বুদ্ধু (বেহারাদের সর্দার), বল্গু, পল্লু, বক্সি, বিষ্ণু, ডাকাতরা।
পৃ. ৫২— উদ্ধব মণ্ডল, নিস্তারিণী, বটকৃষ্ণ, দুর্লভবাবু (ভূস্বামী)।
পৃ. ৫৩— বৃন্দাবন জেলে, কৃত্তিবাস (কর্মচারী)।
পৃ. ৫৪— ধনঞ্জয় পেয়াদা।
পৃ. ৫৫— কাত্যয়নী, মোক্ষদা।
পৃ. ৫৮— কুঞ্জবিহারী, সঞ্জয় সেন, সাতকড়ি ভঞ্জ।
সমগ্র বইটি লক্ষ করলে দেখা যায় শিশুপাঠ্য বই, কিন্তু শিশুই মুখ্যত অনুপস্থিত।
প্রথম ভাগের জন্যও দু-একটা প্রশ্ন দ্বিতীয় ভাগের কথা বলতে বলতে মনে এসে যাচ্ছে।
আচ্ছা সহজ পরিবারের বাড়ির বউদের কাজ কি কেবল রান্না করা আর ভাত বাড়া? ‘বড়োবউ মেজোবউ মিলে/ঘুঁটে দেয় ঘরের পাঁচিলে।’ কেন? সহজ পাঠের বউয়েরা মেয়েরা শুধু গোশালা আর পাকশালাতেই কাটাবে? তারা পাঠশালাতে যাবে না? তারা পড়াশোনা করবে না? লেখাপড়া শিখে তারা শিক্ষিত হবে না, বড় হবে না? চোখের সামনে কেন ছোটরা দেখবে তাদের মা-মাসিরা শুধু গোবর তুলবে আর ঘুঁটে দেবে? ‘ভাত আনো বড়ো বৌ’; এর মধ্যে তো পুরুষশাসিত সমাজের কণ্ঠস্বরই শোনা যাচ্ছে।

প্রথম ভাগের অষ্টম পাঠে লোকা ধোবা ‘আসে’। ‘ওর’ খোকা খুব মোটা।
পরের অনুচ্ছেদে ‘ঐ-যে ওর পোষা গাধা। ওর পিঠে বোঝা।’ দেখা যাচ্ছে গাধা আর মানুষে তফাত নেই। গাধাকেও ‘ওর’ বলছি, আবার গাধার মালিক লোকা ধোবাকেও ‘ওর’ বলছি। ‘ওর’ খোকা, ‘ওর’ গাধা।

কিন্তু দ্বিতীয় ভাগের চতুর্থ পাঠে আনন্দবাবু এসে উপস্থিত হলে বলা হল ‘চন্দননগর থেকে আনন্দ-বাবু আসবেন।… তাঁর আতিথ্যে যেন খুঁত না থাকে।’

একাদশ পাঠ দেখুন। ‘শক্তিনাথ আর মুক্তিনাথ দুই ভাই। যে পাড়ায় থাকেন তার নাম জেলেবস্তি। তাঁর বাড়ি খুব মস্ত।’ এঁদের ঘরবাড়ি মস্ত বড়, এঁরা মস্ত ধনী বলেই কি এঁদের আপনি-আজ্ঞে করতে হবে! লোকা ধোবাকে বলব ‘তুমি’, আর শক্তি-মুক্তিকে বলব ‘আপনি’! কেন? কেন ধোবাটির সম্পত্তির মধ্যে একখানি গাধা আছে বলেই কি সে ‘তুমি’?
এই শিক্ষা শিশুপাঠ্যপুস্তক সহজ পাঠ কেন দেবে একটি মুক্তমনের ছোট্ট শিশুকে? কেন শিশুকে শেখাব এ গরিব এ দরিদ্র— একে তোমার অত সম্মান করতে হবে না; পয়সাঅলা লোকদেরই কেবল খাতিরযত্ন আপ্যায়ন করতে হবে!

আর দ্বিতীয় ভাগের ত্রয়োদশ পাঠে ভূস্বামী নিষ্ঠুর অত্যাচারী দুর্লভবাবুকে মনে পড়ে? গরিব উদ্ধবের ‘উপরে তাঁর বিষম ক্রোধ। বললেন’— কী ‘বললেন’ তা তো সহজ পাঠেই লেখা আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, এই দুর্লভদের সহজ পাঠের সমাজ আপনি-আজ্ঞে করবে। যেহেতু সে সাধারণ গরিব খেটেখাওয়া মানুষ নয়— তিনি ধনী, তিনি জমিদার, তিনি ভূস্বামী।

আমি দুটি বালক-বালিকাকে সহজ পাঠ পড়াই। তাদের শিখিয়েছি সব মানুষ সমান। লোকা ধোবাকে যদি ‘তুমি’ বলো তো ওই অত্যাচারী অসৎ মনুষ্যত্ববর্জিত দুর্লভকে কখনওই ‘আপনি’ বলবে না। এরা আমাদের সমাজ থেকে যত দ্রুত দুর্লভ হবে ততই আমাদের লাভ। দুর্লভবাবুমশাইরা, তোমরা এই সমাজ থেকে দূর হটো দূর হটো।

৫১৬ Comments
  1. Nayan Kumar Bhattacharyya says

    প্রশংসনীয় উদ্যোগ / ভালো লাগলো

    1. Rajarsi Ray says

      এতকাল সহজ পাঠ আমাদের চোখের সামনে, কিন্তু এত গভীর বিশ্লেষণ তো মনে আসে নি। আমরা কৃতজ্ঞ অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যর কাছে।

  2. Sumanta Bhaumik says

    চমৎকার লেখা শ্রী ভট্টাচার্যের। আমরা তাঁর লেখার সাথে পরিচিত। সহজপাঠ কে এভাবে দেখার কথা ভাবিনি আমরা। অন্ততঃ আমি ভেবে দেখিনি। এতই স্বাভাবিক ভাবে এসব আমাদের মনের গহীনে ঢুকে রয়েছে যে এই সম্মানের তারতম্য চোখে পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ হয়ত তখনকার সমাজের প্রচলিত সম্বোধন রীতিকেই মান্যতা দিয়েছেন। নইলে অভিভাবকরা হয়ত সহজপাঠ কে সহজ ভাবে নিতেন না। শিশুকে স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ এর পাঠ দিতে গিয়ে সমাজ চলতি পথের সাহায্যই নিয়েছেন তিনি। অন্যরকম করলে একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার হতে পারত ১৯৩০ এর বাংলাদেশে। সেটা কেমন হত কে জানে।

  3. Mousumi Chakraborty Ghosh says

    সাহসী লেখা। সহজ ভাষায়।

  4. Susmita Banerjee says

    প্রাবন্ধিকের সরস গদ্য ভাষা মন কাড়ল। কোথাও হোঁচট না খেয়ে পড়ার আনন্দে পড়লাম – – – বুঝলাম ।আগে বইটি নিয়ে এভাবে তলিয়ে দেখার ভাবনার উদ্রেক হয় নি। প্রাবন্ধিকের সাহসী লেখাকে শ্রদ্ধা জানাই।

  5. Biplab Biswas says

    পরোক্ষে রবীন্দ্রসান্নিধ্যে থাকা অমিত্রসূদনবাবুর ‘ সহজ পাঠ ‘ নিয়ে এই অলীক তথা অপাঙ্গদর্শন আমাকে শুধু মুগ্ধই করল না, এক শাশ্বত প্রশ্নচিহ্নের সামনেও দাঁড় করিয়ে দিল – এতকাল সহজ বয়ানের মাঝে এই জটিল সমাজ – বিভাজন রেখাটা কারও কি চোখে পড়েনি!? আজ যদি ‘ তিনি ‘ বেঁচে থাকতেন!…

  6. PRADIP DEY says

    প্রাবন্ধিক সহজ পাঠ নিয়ে সহজেই সঠিক দিকটির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন।

  7. Sayan Das says

    প্রয়োজনীয় সামাজিক বিশ্লেষণ।

  8. Ujjal Roy says

    অসাধারণ বিশ্লেষণ। একটা নতুন দিক উন্মোচিত হল। আগামী কালকে নিশ্চয়ই ভাবাবে এই প্রবন্ধ। নমষ্কার শ্রী ভটাচার্যকে।

  9. Bibhuti Bhushan Debnath says

    আমি বাচ্চাদের সহজপাঠ পড়াই।না, ঠিক প
    ড়াই না ওদের সাথে পড়ি।প্রাবন্ধিক যে বিষয়টি এ প্রবন্ধে অবতারণা করেছেন তা গোচরে এসেছিল ঠিকই কিন্তু এভাবে ভাবিনি।আর এখানেই আমার মতো সাধারনের সাথে ওনাদের তফাৎ।
    তবে সহজপাঠ বইটিতে যে সামাজিক বিভেদের বিষয়টি প্রাবন্ধিক পাঠকের দৃষ্টিগোচর করেছেন তার জন‍্য রবিকবি একেবারে দায়ী একথা বলতে পারিনা।প্রথমত সেসময় সামাজিক ব‍্যবস্থা এরকমই ছিল।দ্বিতীয়ত কবির পারিবারিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান।এসবই কবিকে এরকম বিভেদমূলক অবস্থা সৃষ্টিতে চালিত করেছে।আর সেসময় দরিদ্র নিম্নবর্গের মানুষগুলোর কোন সম্মান ছিলনা।এমনকি কমিউনিস্ট দল বাংলায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এ চেনা ছবিটা পাল্টাতে থাকে।এদের জন‍্যই একটা সামান‍্য রিকশাওয়ালাকেও আজ আমরা সম্মান দিয়ে কথা বলি।সেই সময় যদি কমিউনিস্টরা এত ব‍্যাপকভাবে থাকত তবে লোকো ধোবারা ঠিক ‘আপনি’ গোত্রভুক্ত হয়ে যেতেন স্বাভাবিক নিয়মে।
    তবে ক্ষেদ একটাই-বিশ্বকবির সুদূরপ্রসারী দৃষ্টতে এ বিষয়টি গোচরে আসা উচিত ছিল।

  10. Malay Bhattacharya says

    অসামান্য।এই অবকাশে আমাদের ক্ষিদে আরও বেড়ে গেল। যদি এবার প্রথম,দ্বিতীয় ভাগ,আবোল তাবোল,ক্ষিরের পুতুল এগুলো নিয়েও কিছু পাওয়া যেত।

মতামত জানান

Your email address will not be published.