সুপারস্টারদের হলিউড অভিযানকে ছাপিয়েও পরিচালক হিসেবে হলিউডে ‘ভারতীয়’-দের অনুপ্রবেশ সেই আশির দশকের শেষাশেষি থেকেই শুরু হয়েছে। হলিউডকে বিশ্বজনীন করে তুলতে গিয়ে তাতে পা মিলিয়েছেন একাধিক ভারতীয় চিত্রপরিচালক।
ময়ূরীকা মুখোপাধ্যায়
ভারতবর্ষ হল বিপণনক্ষেত্র। অর্থাৎ কিনা এদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে ব্যবহার করে ব্যবসায় উন্নতি সম্ভব। সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই আমাদের দেশ বা দেশের এই বিপুল জনসংখ্যাকে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুরুরা মূলত এই দৃষ্টিতেই দেখে এসেছেন। এছাড়াও ভারতবর্ষের মানুষ গুরুবাদী, ইংরেজিতে বলতে গেলে হিরো-ওয়ারশিপিংয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আগ্রহী। যেজন্য এদেশের রাজনীতির আঙিনাতে মাঝেমধ্যেই চলচ্চিত্রের অথবা দূরদর্শনের পরিচিত-স্বল্পপরিচিত মুখগুলিকে বিনা ভূমিকায় ভেসে উঠতে দেখা যায়। মানুষজন এখানে রুপোলি পর্দার চরিত্রবিশেষকে নিজেদের আশপাশে ঘুরে বেড়াতে দেখলে রীতিমতো আপ্লুত হয়ে ওঠেন। এই প্রবৃত্তিকে অবশ্য একেবারে সরাসরি আমরা দোষারোপ করতে পারি না। কারণ, বিদেশেও যে এমনতরো প্রবৃত্তি একেবারেই লক্ষিত হয় না এমনটা নয়। কাজেই সে কথা বরং থাক।

বিপণনের কথা এল কারণ, আমাদের আলোচনার বিষয় চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের সঙ্গে শিল্পের যেমন সম্পর্ক আছে, তেমনই সম্পর্ক আছে বাণিজ্যের। ব্যবসা না করলে প্রযোজক কেন একটি ‘ছবি’-র পিছনে টাকা ঢালবেন। অনেক খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক (এমনকি যাঁদের আমরা আর্ট ফিল্মমেকার হিসেবে দেখতে ভালবাসি তাঁরাও) এই প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্নটি নেহাত অবান্তর নয়। আবার, গুরুবাদী এবং বিপণনক্ষেত্র হবার সুবাদে আমাদের দেশে এই চলচ্চিত্র-ব্যবসাটি বেশ ভালভাবেই সফল হতে পেরেছে। এক একটি বছরে আমাদের দেশে যে বিপুল পরিমাণ সিনেমা আমরা তৈরি হতে (নাকি বলব উৎপাদিত হতে?) দেখি, পৃথিবীর প্রায় কোনও দেশই সেই পরিমাণের দিক থেকে আমাদের ধারেকাছেও আসতে পারে না। আমাদের দেশের তারকারা ‘গণতান্ত্রিক’ভাবে বিশ্ববিখ্যাত। ‘গণতান্ত্রিক’ শব্দটা ব্যবহার করলাম কারণ, তাঁরা বিশেষভাবে ভক্তসংখ্যার দিক থেকে সারা পৃথিবীতে বন্দিত। গোটা পৃথিবী জুড়েই এখন ভারতীয়দের রমরমা। কাজেই অমিতাভ-শাহরুখ-জুহি-ক্যাটরিনার সিনেমা আপনি ব্রাসেলস থেকে বাগদাদ অবধি সমস্ত জায়গাতেই কোনও না কোনও বাড়িতে কোনও না কোনও সময়ে এখন মোবাইলে অথবা টিভিতে চলতে দেখবেন। সেই ছবিগুলির জাত আলাদা, সেই অভিনেতাদের অভিনয়শৈলীও বিশেষ একটি ঘরানার মধ্যে আবদ্ধ। তবু তাঁদের অভিনয়প্রতিভাকে কোনওভাবেই ছোট করা যাবে না। কারণ, সোয়াশো কোটি জনগণের ‘হার্টথ্রব’ হয়ে উঠতে গেলেও আর কিছু না হোক অমানুষিক পরিশ্রম লাগে।

এ সত্ত্বেও কিন্তু ‘সিনেমার মক্কা’ হিসেবে যদি কখনও বিশেষ কোনও একটি দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের কথা উল্লেখ করতে হয় তাহলে একবাক্যে সকলেই হলিউডের নাম উচ্চারণ করবেন। লর্ডসের টেস্ট ম্যাচ অথবা হলিউডের বিশেষ কোনও একটি প্রযোজনা সংস্থার ছবিতে নিজের নাম বা মুখটুকুকে দেখতে পাওয়া কেবল ভারতীয় কেন, সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সমস্ত মানুষের কাছেই একটা স্বপ্নের মতো। সেই হলিউডের আঙিনাতে ভারতীয়দের ‘অনুপ্রবেশ’, ভারতীয়দের ‘দাপট’, ‘পারফরম্যান্স’ ইত্যাদি নিয়ে একটু চর্চা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। একেবারে গড়পড়তা সিনেমাপ্রেমী মানুষদের মতোই যদি আমরা হলিউডের ‘ভারতীয়ত্ব’-কে খুঁজতে চেষ্টা করি, দিনের শেষে তাহলে আমরা কী-ই বা পেতে পারি? শুধুই কি গতানুগতিকতা? বোধহয় তা নয়।

এ কথা ঠিক যে, সিনেমায় চরিত্রায়নের প্রয়োজনে এবং বিশেষভাবে ব্যবসার উদ্দেশ্যে যখন কোনও ভারতীয় অভিনেতা অথবা ভারতবর্ষের কোনও প্রেক্ষাপটকে কোনও হলিউডি ছবিতে আনা হয়েছে তখন তার মধ্যে একটা স্টিরিওটিপিক্যাল ব্যাপার সবসময়েই এসেছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা ধরতে পারি স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য টেম্পল অব ডুম’ (১৯৮৪) অথবা জন গ্লেনের পরিচালনায় জেমস বন্ড সিরিজের ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম ‘অক্টোপুসি’ (১৯৮৩) ছবিদুটিকে। এর মধ্যে প্রথম ছবিটি ৫৭তম অস্কারের মঞ্চে শ্রেষ্ঠতম ভিস্যুয়াল এফেক্টসের জন্য পুরস্কৃত হয়। প্রথম ছবিটিতে খলচরিত্রে অমরীশ পুরী এবং দ্বিতীয় ছবিটিতে একটি খলচরিত্রে কবীর বেদী ও একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের পার্শ্বচরিত্রে অন্যতম জনপ্রিয় ভারতীয় টেনিস খেলোয়াড় বিজয় অমৃতরাজকে অভিনয় করতে দেখা গেছে। দুটি ছবিতেই ভারতবর্ষ সম্পর্কে সেই একই রকমের একটা মিথিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। যেন ভারতবর্ষ মানেই হল রাজা, ফকির, মন্ত্রতন্ত্র-জাদুবিদ্যা, জঙ্গল-হাতি-সাপ, তলোয়ারযুদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে বেশ রূপকথা এবং অন্ধকারে ছেয়ে থাকা প্রায় আধিভৌতিক একটি দেশ।

একটি ছবিতে অমরীশ পুরীর অভিনীত চরিত্রের নাম ‘মওলা রাম’ এবং কবীর বেদীর চরিত্রটির নাম ‘গোবিন্দা’। খাস ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিজুলি করে রাখা একেবারে। এমনকি, এর অনেক পরে ২০১১-তে যখন টম ক্রুজের বিখ্যাত ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘মিশন ইমপসিবল’ সিরিজের চতুর্থ ছবিটিতে ভারতীয় তারকা অনিল কাপুর মুখ দেখাবেন, সেখানেও তাঁর নাম হবে বৃজনাথ এবং তাঁকে দেখানো হবে নারীলোলুপ এক টাকার কুমির ভারতীয় ব্যবসায়ী হিসেবে। ছবিটিতে অনিল কাপুরের উপস্থিতি (এবং উপস্থাপনা) নিয়ে যখন তাঁর ভক্তরা প্রশ্ন তুলবেন তখন তিনি আবার সাংবাদিকদের সামনে এমনটাও সাফাই দেবেন— ছবিটির ডিস্ট্রিবিউটর সংস্থা ‘প্যারামাউন্ট পিকচার্স’ নাকি কেবল অনিল কাপুরের অভিনয়েরই প্রায় বাইশ মিনিটের একটি অদেখা ফুটেজকে তাঁদের পক্ষ থেকে অভিনেতাকে নিজেদের উদ্যোগে পাঠিয়েছেন। এই ফুটেজের অংশগুলি মূল ছবিটিতে রাখা না গেলেও ফুটেজটি নাকি ‘বিশিষ্ট ভারতীয় অভিনেতাকে প্যারামাউন্টের তরফে একটি সামান্য উপহার!।

বড় বিব্রত লাগে। কারণ, এই ঘটনাগুলি ঘটছে এমন একটা সময়ে যখন অন্তত ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়র’ (২০০৮) ছবিটি অস্কার পেয়ে গিয়েছে এবং তাতে অনিল কাপুরের অভিনয়ও যথেষ্টই প্রশংসিত হয়েছে। এর পর অন্তত ‘মিশন ইমপসিবল’-এর ওই ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র চরিত্রটি করতে যাওয়া বা তার পরিপ্রেক্ষিতে আবার সাংবাদিকদের সামনে সাফাই দেওয়াটা বড় অস্বস্তির বলে মনে হয়।

চরিত্রের ছোট বা বড় হয় না, এ কথা ঠিক। তবুও ‘অক্টোপুসি’-তে বিজয় অমৃতরাজের চরিত্র, অথবা ‘মিশন ইমপসিবল’-এ অনিল কাপুরের চরিত্র, এমনকি লিওনার্ডো ডি’ক্যাপ্রিও, টোবি ম্যাগওয়্যার অভিনীত আরও একটি হলিউডি বিগ বাজেটের ছবি ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’-তে (২০১৩) সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চনের চরিত্র— এগুলি দৈর্ঘ্যের দিক থেকে তুলনীয় হলেও যে বিষয়টি আমাদের বেশি পরিমাণে বিব্রত করে সেটি হল, স্রেফ ভারতীয় বাজার ধরার প্রয়োজনে প্রযোজক সংস্থাগুলির তরফে এই সুপারস্টারেদের সবাইকে রীতিমতো ‘ইন্ডিয়ান ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ বানিয়ে দেওয়ার একটি কূট প্রচেষ্টা দেখা যায়। তাঁদের জন্য আলাদা করে ‘ভারতীয় দর্শকদের উদ্দেশে’ ট্রেলার তৈরি করা হয়, বিশেষ পোস্টার নকশা করা হয়। অথচ সিনেমাটি দেখতে গিয়ে যেন পর্বতের মূষিকপ্রসবের অভিজ্ঞতা ঘটে। পোস্টার অথবা ট্রেলারের কেরামতিতে লার্জার দ্যান লাইফ সেই প্রিয় চরিত্রটি হঠাৎ কখন যেন নামগোত্রহীন পার্শ্বচরিত্রে মিশে গিয়ে মুখটুকু দেখিয়ে কোনওমতে আবার আত্মগোপন করেন। কাজেই সুপারস্টার অভিনেতাদের বিগ বাজেটের হলিউড অভিযান আমাদের ঠিক তৃপ্ত করতে পারে না। আমরা বরং ক্যামেরার পিছনে গলা বাড়াই।

ভাল রান্নার কৃতিত্ব যেমন আদতে রাঁধুনিরই, মশলা বা সবজিপাতির নয়, ঠিক তেমনই সিনেমার ক্ষেত্রে অনেকটা আড়ালে থেকে যান ক্যামেরার পিছন দিকের মানুষগুলো। এখন সেই চলচ্চিত্র পরিচালকদের দুনিয়াতেই ঢুঁ দিতে ইচ্ছে করল। এই একটি ক্ষেত্রে অন্তত বেশ কয়েকটি মনে রাখার মতো নাম আপনাদের শোনাতে পারব বলে আশা রাখছি।

আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের তরফে ২০০৫ সালে একশো বছরের হলিউডি সিনেমার সেরা একশোটি সংলাপের একটি তালিকা প্রকাশিত হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী চুয়াল্লিশ নম্বরের বিখ্যাত সংলাপটি ছিল ‘আই সি ডেড পিপল’। সংলাপটি অনেকেরই হয়তো উল্লেখমাত্র মনে পড়ে গেছে এবং এবারে তাঁরা নড়েচড়ে বসেছেন। ১৯৯৯-তে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দ্য সিক্সথ সেন্স’-এর অন্যতম জনপ্রিয় সংলাপ হিসেবে এটি উঠে এসেছিল। ব্রুস উইলিস অভিনীত এই ছবিটি সর্বকালের সেরা হলিউডি ভয়ের ছবিগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। আবার, এরই সঙ্গে একই বছরে মুক্তি পেয়েছিল ছোটদের দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় ছবি ‘স্টুয়ার্ট লিটল’। অ্যানিমেশনের কারসাজিতে তৈরি এক ছোট্ট মিষ্টি সাদা ইঁদুরের ‘পরিবার’ খুঁজে পাওয়ার গল্প। ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন হিউ লরি, জিনা ডেভিসের মতো অভিনেতারা। স্টুয়ার্টের চরিত্রে গলা দিয়েছিলেন মাইকেল জে ফক্স। ছবিটি বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। এই দুটি ছবি, ‘দ্য সিক্সথ সেন্স’ এবং ‘স্টুয়ার্ট লিটল’— এদের মধ্যে ভারতীয়ত্বের দিক থেকে মিল কোথায়? উত্তর হল, এম নাইট শ্যামালান। পিতৃদত্ত নাম মনোজ নেলিয়াত্তু শ্যামালান। ‘দ্য সিক্সথ সেন্স’-এর তিনি পরিচালক এবং ‘স্টুয়ার্ট লিটল’-এর সহযোগী চিত্রনাট্যকার।

জন্মের তিন সপ্তাহ পরেই শ্যামালান পরিবার আমেরিকার পেনসিলভেনিয়াতে চলে যায়। সেখানেই এম নাইটের বড় হওয়া। ছোটবেলায় খুব কাছ থেকে দেখেছেন আমেরিকার ক্যাথলিক ধর্মীয় গোঁড়ামিকে। এমনকি ক্লাসে ভাল ফল করার পরেও তিনি যে ‘ক্যাথলিক নন, এটাই আশ্চর্যের বিষয়’ এমনটাও তাঁর শিক্ষক তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এই সব কিছু পেরিয়ে হলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় থ্রিলার পরিচালক হয়ে উঠতে পেরেছেন মনোজ নেলিয়াত্তু শ্যামালান। উপহার দিয়েছেন ‘আনব্রেকেবল’ (২০০০), ‘স্প্লিট’ (২০১৬), ‘গ্লাস’ (২০১৯) অথবা ‘ওল্ড’ (২০২১)-এর মতো এক একটি উল্লেখযোগ্য ছবি। এমনকি কেরিয়রের এক এক সময়ে ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ অথবা ‘হ্যারি পটার’-এর মতো এক একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিতেও শ্যামালানের কাজের সুযোগ এসেছে। যদিও সেগুলির কোনওটাই শেষ অবধি বাস্তবায়িত হয়নি, তবুও হলিউডি থ্রিলারের জগতে এম নাইট শ্যামালান নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। সীমানা পেরিয়ে ‘ভারতীয়’-দের জয়জয়কার আজকের নয়, বহুদিনের।

আমরা ১৯৮৩-৮৪ সালের ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ অথবা ‘জেমস বন্ড’ ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। এম নাইট শ্যামালান বিখ্যাত হয়েছেন ১৯৯৯-তে। আমরা সময়কে ধরে ধরে একটু একটু করে পিছোব। দেখাতে চাইব যে, সুপারস্টারদের হলিউড অভিযানকে ছাপিয়েও পরিচালক হিসেবে হলিউডে ‘ভারতীয়’-দের অনুপ্রবেশ সেই আশির দশকের শেষাশেষি থেকেই শুরু হয়েছে। হলিউডকে বিশ্বজনীন করে তুলতে গিয়ে তাতে পা মিলিয়েছেন একাধিক ভারতীয় চিত্রপরিচালক।

ইংল্যান্ডে ১৯৯৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘ভাজি অন দ্য বিচ’ ছবিটি। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টরেন্টোর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি প্রথম প্রদর্শিত হয়। একাধিক পুরস্কারে ভূষিত এই ছবিটির পরিচালকের নাম গুরিন্দর চাড্ডা। পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রকার হিসেবে এই ছবিটির মাধ্যমেই তাঁর আত্মপ্রকাশ। এই আত্মপ্রকাশের আরও একটি গুরুত্ব হল, ছবিটি ইতিহাসের নিরিখে প্রথম কোনও এশীয়-বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকের বানানো পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। নাইরোবিতে জন্ম, পরে ইংলন্ডের নাগরিক গুরিন্দর চাড্ডা অবশ্য এর আগে দূরদর্শন মাধ্যমেও কাজ করেছেন। কিন্তু এই ‘ভাজি অন দ্য বিচ’ ছবিটির মাধ্যমেই পূর্ণদৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্মের দুনিয়ায় তাঁর আবির্ভাব। ব্রিটিশ নাগরিক এবং একইসঙ্গে ভারতীয় বংশোদ্ভূত হবার কারণে তাঁর ছবিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে প্রবাসী ভারতীয়দের চালচলন, জীবনযাপন। সেখানে পাশ্চাত্যের আধুনিকতার সঙ্গে ‘সনাতন ভারতীয়ত্ব’-কে মেলাতে গিয়ে অনেক সময়ই যে হাস্যকর বিড়ম্বনার দৃশ্যগুলি উঠে আসে সেগুলিকেই খুব সুন্দরভাবে চাড্ডার পরিচালিত এই ছবিগুলিতে আমরা দেখতে পাই। যেমন কিনা, চাড্ডার ‘ভাজি অন দ্য বিচ’ ছবিটিরই একটি দৃশ্যে দেখা যায়, একটি চরিত্র ভারতীয় পোশাকের ওপরে একটি বিদেশি চামড়ার জ্যাকেটকে চাপিয়ে নিয়ে ‘আধুনিক’ হবার প্রচেষ্টায় রত। এই দৃশ্যকল্পটি সত্যিই ভাবিয়ে দিয়ে যায়। ছবিটির সময়কাল যদিও, আরও একবার মনে করিয়ে দিই, ১৯৯৩। ফিউশন সংস্কৃতি তখনও তেমনভাবে গেঁড়ে বসতে পারেনি।

চাড্ডার পরবর্তী বড় ছবি ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’ (২০০২) এবং ‘ব্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ (২০০৪) একইসঙ্গে বক্স অফিসে সাফল্য এবং সমালোচক মহলে কৃতিত্ব পায়। কেবল প্রবাসে ‘ভারতীয়ত্ব’-ই নয়, সমাজের অনেক ছোটখাটো, সূক্ষ্মতর বিষয়ও— অভিবাসী ভারতীয়দের প্রতি শ্বেতাঙ্গ স্বদেশীয়দের মনোভাব, আধুনিকতা এবং সনাতনের দ্বন্দ্বে অগ্রজ এবং অনুজ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, এমনকি আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কালোদের প্রতি ভারতীয়দের তরফেও যে পরোক্ষ বর্ণবিদ্বেষ— এই সব কিছুই চাড্ডার ছবিতে উঠে আসে। উঠে আসে পুরুষতন্ত্র, গার্হস্থ্য হিংসা এবং নারী স্বাধীনতার বিষয়ে সমাজের নানাবিধ দ্বিচারিতার ঘটনা। এছাড়াও, ব্যবসায়িক দিক থেকে দেখলে ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়র’-এর বিশ্বজোড়া সাফল্যের আগে অবধিও গুরিন্দর চাড্ডার ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’ ব্রিটিশ দ্বীপরাষ্ট্রে সর্বাধিক বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখেছিল। জেন অস্টেনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’-এর অনুপ্রেরণায় দুর্দান্ত এক ব্রিটিশ-ভারতীয় মিশেলের উদাহরণ হল ‘ব্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ (২০০৪)। এই ছবিটি ভারতীয় দর্শকমহলেও বিপুল সাড়া ফেলে।

গুরিন্দর চাড্ডার শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ২০১৭ সালে, ‘ভাইসরয়েস হাউজ’। দমিনিক লাপিয়ের এবং ল্যারি কলিন্সের বিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থ ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’-এর বর্ণনার ওপরে নির্ভর উপমহাদেশীয় দেশভাগের ওপরে নির্মিত সুন্দর এক চিত্রকল্প। এই ছবিটিতে অভিনয় করেন হুমা কুরেশি, সঙ্গীত পরিচালনা করেন এ আর রহমান। সীমানা পেরিয়ে ‘ভারতীয়ত্ব’-কে এভাবেই আমরা ক্রমশ গুরিন্দর চাড্ডা বা শ্যামালানদের মতো এক একজনের মাধ্যমে ক্রমশ বিস্তৃত হতে দেখেছি।

এর পরেও যদি আমরা কিছুটা ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ গোত্রের ছবি করেন অথবা ‘ফেস্টিভ্যালের জন্য ছবি বানান’ এমন কাউকে খুঁজতে চাই? বাণিজ্য ছাপিয়েও যে চত্বরে শিল্পের দর বেশি। সেখানেও কিন্তু আমরা দেখতে পাব দুই প্রতিভাময়ীকে। আশির দশকের শেষ ভাগ থেকেই যাঁদের শিল্প বিশ্বের দরবারে আমাদের বারে বারেই মুগ্ধ করে এসেছে। মীরা নায়ার এবং দীপা মেহতা। মোটামুটি সমসাময়িক দু’জন মানুষ, যাঁদের সৃষ্টি চিরকালীন।

বয়সের দিক থেকে সামান্য কিছুটা এগিয়ে থাকা দীপা মেহতাকে দিয়েই শুরু করি, যাঁর ফায়ার-আর্থ-ওয়াটার ট্রিলজি ইতিমধ্যেই বিশ্ববন্দিত। তবে সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দীপা মেহতার বিবর্তন নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা জরুরি। দীপা মেহতা এবং মীরা নায়ার, দু’জনেরই চলচ্চিত্রজগতে হাতেখড়ি ডকুমেন্টারি ছবির মাধ্যমে। যে কারণে তাঁদের ছবিতে তথ্য এবং কল্পনার এক সুন্দর ভারসাম্য দেখা যায়। গল্পের মধ্যে তথ্য এসে যেমন গল্পকে ভারাক্রান্ত করে তোলে না, তেমনই আবার তথ্যের অনুপস্থিতি গল্পকে পুরোপুরি কল্পনানির্ভর অথবা অবাস্তব অভিজ্ঞতাও হয়ে উঠতে দেয় না। দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা এক উদ্বাস্তু শিখ পরিবারে দীপা মেহতার জন্ম, দিল্লিতে উচ্চশিক্ষা। পরবর্তীতে কানাডিয়ান ডকুমেন্টারি পরিচালক পল সলজম্যানের সঙ্গে বিবাহসূত্রে কানাডায় অভিবাসন। সেখানেই দীপার পরিচালক জীবনের সূত্রপাত।

তথ্যচিত্র পরিচালনার পাশাপাশি ১৯৯১ সালে মেহতার প্রথম পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ‘স্যাম অ্যান্ড মি’ (ওম পুরী অভিনীত) কান চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। এই সময়, এর পাশাপাশি টেলিভিশনের জন্য জর্জ লুকাসের প্রযোজনায় ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ ফ্র্যাঞ্চাইজির দুটি টেলি-এপিসোডও দীপা মেহতা পরিচালনা করেন। ১৯৯৩ সালে এই দুটি এপিসোড সম্প্রচারিত হয়। ২০০৮ সালে বলিউডের বিশিষ্ট অভিনেত্রী প্রীতি জিন্টাকে মূল চরিত্রে রেখে তিনি ‘হেভেন অন আর্থ’ নামের একটি ছবি করেন। ছবিটি টরেন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ২০২০ সালে দীপা মেহতার ছবি ‘ফানি বয়’ কানাডার তরফে অস্কার পুরস্কারের জন্য অফিসিয়াল এন্ট্রি হিসেবে পাঠানো হয়। কাজেই দীপা মেহতার দীর্ঘ কেরিয়ারে তিনি যে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিশেষ একটি জায়গা করে নিয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আলাদা করে যা বলতেই হয় তা তাঁর এলিমেন্টস ট্রিলজির বিষয়ে। ১৯৯৬, ১৯৯৮ এবং ২০০৫ সালে দীপা মেহতার তিনটি ছবি মুক্তি পায়। যথাক্রমে ‘ফায়ার’, ‘আর্থ’ এবং ‘ওয়াটার’। এর মধ্যে ‘ফায়ার’ ছবিটি ভারতের তরফে এবং ‘ওয়াটার’ ছবিটি কানাডার তরফে সেই সেই বছরের অস্কারে ‘বিদেশি ভাষার শ্রেষ্ঠ ছবি’-র বিভাগে বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল।

‘ফায়ার’ (১৯৯৬) ছবিটিতে দীপা মেহতা সেই সময়ে দাঁড়িয়েও দুটি মেয়ের মধ্যে সমকামী সম্পর্কের গল্প নিয়ে ছবি করেছিলেন। বৈবাহিক জীবনে যৌন অতৃপ্তির ফলস্বরূপ একই পরিবারের দুটি নারীচরিত্র কীভাবে তাদের শরীর ও মনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে কাছাকাছি আসে এবং একটি সম্পর্কের জন্ম দেয়— সেটিই এই ছবির মূল উপজীব্য। স্বভাবতই ছবিটি ভারতে তৎকালীন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির চরম রোষের মুখে পড়ে। যার জের চলে ২০০৫ সালে ‘ওয়াটার’ ছবিটির শ্যুটিং অবধি। মাঝে ‘আর্থ’ ছবিটির প্রধান উপজীব্য হিসেবে উপমহাদেশীয় দেশভাগকে তুলে ধরা হয়েছে। ‘ওয়াটার’ ছবিটিতে এক বাল্যবিধবার জীবনের কাহিনি নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন পরিচালক। প্রবাসী হয়েও ভারতের গূঢ়তর সমস্যাগুলিকেই বারে বারে দীপা মেহতা তাঁর ছবিগুলির মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ‘ওয়াটার’ ছবিটির শ্যুটিংয়ে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার সব রকমের সহযোগিতা করলেও রাজ্য সরকারের তরফে অসহযোগিতার কারণে দীপা মেহতা উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে ছবিটির শ্যুটিং করতে পারেননি। এলিমেন্টস ট্রিলজির কারণেই সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দীপা মেহতা নিজস্ব একটি জায়গা করে নিতে পেরেছেন। তথ্য, শিল্প এবং সামাজিক দায়ভার— এই তিনটি বিষয়কে চূড়ান্ত ভারসাম্যের সঙ্গে কীভাবে নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে তুলে ধরা যায় বা তুলে ধরা উচিত তা এই তিনটি ছবিতে পরিচালক তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে বিবৃত করেছেন। পরবর্তীতে দীপা মেহতা সলমন রুশদির সঙ্গে যৌথভাবে রুশদির ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ উপন্যাসটির চিত্রনাট্য লেখেন। ২০১২ সালে টরেন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি প্রদর্শিত হয়।

মীরা নায়ারকে এই আলোচনার শেষতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে রাখতে চেয়েছিলাম। তার কারণ একান্তই ব্যক্তিগত। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে যখন আমরা অভিনেতা ইরফান খানের মৃত্যুর খবর পেলাম তখন সেই ইরফানের কাজ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই মীরা নায়ারের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। ‘সালাম বম্বে!’ (১৯৮৮) ইরফান খানের অভিনেতা হিসেবে প্রথম কাজ। মীরা নায়ারের মীরা নায়ার হয়ে ওঠা। ‘সালাম বম্বে!’ যে কেবল শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কারের মঞ্চে মনোনীত হয়েছিল তাই নয়, কান চলচ্চিত্র উৎসবের বিশেষ মনোনয়ন-সহ সর্বমোট ২৩টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ছবিটি ভূষিত হয়েছিল। মুম্বই শহরের পথশিশুদের জীবন নিয়ে এ যেন এক আশ্চর্য সিনেমাটিক দলিল। ক্যামেরার প্রতিটি ফ্রেম, প্রতিটি রং, প্রতিটি অ্যাঙ্গল, প্রতিটি সৃষ্টিকেই কেবল মন্ত্রমুগ্ধের মতোই একনিশ্বাসে উপভোগ করতে হয়। আন্তর্জাতিক ভঙ্গিতে ভারতবর্ষের এমন বাস্তবিক একটি উপস্থাপনা এর আগে বোধকরি কখনও হয়নি।

মীরা নায়ার বাদল সরকারের নাটক দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। এর আগে মীরা নায়ার দিল্লির জামা মসজিদের সেই বিখ্যাত গলিটিকে নিয়েও তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। নিউ ইয়র্কের প্রবাসী কাগজ-বিক্রেতার জীবন সেলুলয়েডে তুলে এনেছেন। উগান্ডা থেকে অভিবাসী ভারতীয়দের জীবন নিয়ে ‘সালাম বম্বে!’-র পরবর্তীতে তিনি ‘মিসিসিপি মশালা’-র রেসিপি উপহার দিয়েছেন। ১৯৮৪-তে যখন ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য টেম্পল অব ডুম’-এর ভারতবর্ষকে দেখেছে পৃথিবী, ঠিক সেই বছরই মীরা নায়ার বম্বের ক্যাবারে নর্তকীদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। ভারতীয় সমাজ তাঁর ক্যামেরার লেন্সে প্রতিফলিত হয়ে যেন এক আন্তর্জাতিক ক্যানভাস হয়ে উঠেছে। যেখানে রং আছে, গান আছে, ভারতীয়ত্ব আছে, পরিমিতি আছে। সব কিছুকে ছাপিয়ে শিল্প আছে। মানুষের চোখে মানুষের জীবনকে তুলে ধরা আছে। মীরা নায়ার এমনই একজন চিত্রপরিচালক।

অত্যন্ত স্বল্প বাজেটে তৈরি মীরা নায়ারের ছবি ‘মনসুন ওয়েডিং’ ২০০১ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লায়ন খেতাব লাভ করে। ২০০৭ সালে হ্যারি পটার সিরিজের পঞ্চম ছবিটিকে পরিচালনার জন্য নায়ারের নাম ভাবা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। পরিবর্তে তিনি পরিচালনা করেন ‘দ্য নেমসেক’। ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্প, ইরফান খানের অনবদ্য অভিনয়। সীমানা ছাড়িয়ে ‘ভারতীয়ত্ব’-এর উদযাপন যেন সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়েছে। ২০১২-তে তাঁর পরিচালিত ছবি ‘দ্য রেলুকট্যান্ট ফান্ডামেন্টালিস্ট’ ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে উদ্বোধনী ছবি হিসেবে প্রদর্শিত হয়।

দীপা মেহতার মতোই নায়ারের সামাজিক ভাবমূর্তিকে আমরা বারে বারেই অন্যায়ের প্রতিবাদে এবং সামাজিক প্রয়োজনেও উঠে আসতে দেখেছি। ১৯৯৮ সালে ‘সালাম বম্বে!’ ছবিটির অত্যাশ্চর্য সাফল্যের কথা মনে রেখে মীরা নায়ার মুম্বইয়ে ‘সালাম বালক ট্রাস্ট’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। মুম্বইয়ের পথশিশুদের উন্নতিকল্পে এই সংগঠনটি আজও কাজ করে চলেছে। ২০১৩-তে প্যালেস্টাইনের ওপরে ইজরায়েলের আগ্রাসনের প্রতিবাদে তিনি হাইফা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মাননীয় অতিথি হওয়ার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। ছবির ভাষা, কবিতার ভাষা, সাহিত্যের ভাষাই যে কখন প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে, সমাজের ভাষা হয়ে ওঠে, রাষ্ট্রগুরুরা সেই বিষয়টিকে খেয়ালে রাখেন না। তাই ‘ফায়ার’, ‘ওয়াটার’ অথবা ‘সালাম বম্বে!’-র মতো এক একটি সিনেমা আমাদের জীবনে কাল্ট হয়ে থেকে যায়। মীরা নায়ার বা দীপা মেহতাদের এক একটি জীবনদর্শন আমাদের অনুপ্রাণিত করে।

সীমানা পেরিয়ে ‘ভারতীয়’ সিনেমার এই উদযাপন ফুরোনোর নয়। ক’জন আমরা জানতাম যে বিশ্ববন্দিত অভিনেত্রী কেট ব্ল্যাঞ্চেত তাঁর জীবনে প্রথম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জন্য অস্কার নমিনেশনটি পেয়েছিলেন এক ভারতীয় চিত্রপরিচালকের সঙ্গে কাজ করে, যাঁর নাম শেখর কাপুর? ১৯৯৮ সালে শেখর কাপুরের ‘এলিজাবেথ’ ছবিটিতে অভিনয়ের জন্য কেট ব্ল্যাঞ্চেত জীবনে প্রথম বারের জন্য সেই নমিনেশন পেয়েছিলেন। ‘জুরাসিক পার্ক’ অথবা ‘লস্ট সিম্বল’-এ সুযোগ পাওয়ার আগেই ২০০১ সালে ‘দ্য ওয়ারিয়র’ ছবিটির মাধ্যমে প্রথম বারের জন্য হলিউডে ডাক পেয়েছিলেন ইরফান খান। ছবির পরিচালক ছিলেন আসিফ কাপাডিয়া। এই আসিফ কাপাডিয়াই অ্যামি ওয়াইনহাউজের জীবনের ওপর নির্ভর করে তৈরি করেছিলেন তথ্যচিত্র ‘অ্যামি’, যা সেরা তথ্যচিত্রের জন্য অস্কার পুরস্কারে ভূষিত হয়।

শিল্পের কোনও সীমানা হয় না, কোনও গণ্ডীবদ্ধ যাপন হয় না। তবু, ‘দেশ’-এর পরিধিকে ছাপিয়ে এক একটি পরিচিত নাম, পরিচিত মুখকে যখন বিশ্বের দরবারে বন্দিত হতে দেখি, শিল্পী হিসেবে, শিল্পের অনুরাগী হিসেবে বুকটা ফুলে ওঠে। এ জীবনে এখনও তো টিকে আছি কেবল শিল্পের প্রয়োজনেই, সৃষ্টির অনুরাগেই। সেখানে থেকেই বুঝতে পারি, মনুষ্যত্বের চেয়ে বড় আর কিছুই নয়।
সহযোগী লেখক : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়