গাঙ্গেয় ডলফিনদের চোখ থাকে না। তারা আদতে অন্ধ। কিন্তু আমরা মানুষেরা চক্ষুষ্মান, আমাদের সেই দেখার চোখ গেল কোথায়? ভারতের ‘ন্যাশনাল অ্যাকোয়াটিক অ্যানিম্যাল’-এর এহেন দশা নিয়ে সকলে নির্বাক কেন?
গণেশ চৌধুরী
ইন্দ্রসভার নর্তকীরা গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল। তাদের ফিরতে দেরি হওয়ায় কুপিত দেবরাজ অভিশাপ দেন— তোমরা যেখানে ছিলে সেখানেই থাকো। সেই নির্বাসনে তারা জলপরির রূপ পায়। ক্রমে তারাই নাকি শুশুকে পরিণত হয়। এসবই গল্পকথা বা পুরাণকথা। কিন্তু বাস্তবের কথা হল, আমাদের এখানে স্থানীয়ভাবে যাদের শুশুক বলা হয়, সেই ডলফিনরা যেন অভিশপ্ত। দেবতাদের নয়, মানুষদের বিচারবুদ্ধির অভাবে, তাদের কার্যকলাপের দায়ভার মাথায় নিয়ে ক্রমে ডলফিনরা নদী থেকে চিরতরে লুপ্ত হতে চলেছে। সে নদীও নেই, সে ডলফিনও নেই। অথচ একদা দেশের বহু নদী ডলফিনদের খাসতালুক ছিল। নদীজীবনে তাদের যথেষ্ট প্রভাবও ছিল। নানা অঞ্চলে নানা লোককথা, কাহিনি, উপকাহিনি ছড়িয়ে ছিল এই আশ্চর্য জলজ প্রাণীটিকে নিয়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাদের সেই সুদিন গিয়েছে।
মানুষেরই আগ্রাসন আর বিরুদ্ধাচরণের ফলে প্রকৃতি সংকটে। আমাদের চারপাশে তাকালেই মনুষ্যসৃষ্ট নানা অনাচার ধরা পড়বে। মানুষের ক্ষমাহীন মন, সীমাহীন লোভ আর অপরিণামদর্শিতার কারণে প্রকৃতির অন্য ন্যায্য অংশীদাররা কোণঠাসা। জলে, স্থলে, আকাশে নিজের প্রভুত্ব কায়েম করে ফেলেছে মানুষ। পৃথিবী বিপন্ন। সেই বিপন্নতা ছুঁয়ে ফেলেছে ডলফিনদেরও। সেই বিপন্ন জগতের এক আদি বাসিন্দা গাঙ্গেয় ডলফিনদের কথাই আজ বলছি। অনেক বছর ধরে এই ডলফিনদের ভালমন্দ নিয়ে কাজের সুবাদে তাদের নিয়ে ক’টি কথা বলার প্রয়োজন আছে বলেই মনে হয়।
গঙ্গাপারের বাসিন্দা বলে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি গাঙ্গেয় ডলফিনদের। আগেই বলেছি, তাদের স্থানীয়ভাবে শুশুক বলে ডাকা হয়। হঠাৎ হঠাৎ নদীতে জলের ওপর লাফিয়ে উঠে জলেই হারিয়ে যেত তারা। কখনও কখনও নৌকার পাশ দিয়ে সাঁতার কাটত মহানন্দে। অপার কৌতূহল নিয়ে চেয়ে থাকতাম। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলাম আর দেখতে থাকলাম কীভাবে এই ডলফিনরা ক্রমশ বিরল হয়ে পড়তে লাগল। প্রকৃতির প্রতি আজন্ম ভালবাসার টানে একসময় পাখি, সাপ ও অন্য বন্যপ্রাণীর পাশাপাশি এই ডলফিনদের নিয়ে ভাবনা শুরু হল। কোথায় হারিয়ে গেল তারা? খানিক পড়াশোনা করে এবং অনেকটা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানতে চেষ্টা করলাম এদের জীবনযাপন, বাঁচা-মরার কাহিনি। দেখলাম, জলদূষণ ছাড়াও বেপরোয়া শিকার, মৎস্যজীবী মানুষের সঙ্গে অসম সংঘাত, জালে জড়িয়ে অপমৃত্যু ডলফিনদের বিপদ ডেকে আনছে।
আমার বাবা একটা শোনা কথা বলতেন, ডলফিনদের নাকি সোনার চোখ হয় আর তাদের ধরলে সেই চোখ খসে যায়। এটা অবশ্য ঠিক নয়। গাঙ্গেয় ডলফিনদের চোখ থাকে না। তারা আদতে অন্ধ। কিন্তু আমরা মানুষেরা চক্ষুষ্মান, আমাদের সেই দেখার চোখ গেল কোথায়? ভারতের ‘ন্যাশনাল অ্যাকোয়াটিক অ্যানিম্যাল’-এর এহেন দশা নিয়ে সকলে নির্বাক কেন? তাদের দিকে চোখ তুলে দেখা কি জরুরি কর্তব্য নয়? না কি বিলুপ্তিই ভবিতব্য তাদের?
আমি প্রথমে একলা, পরে দলবেঁধে ডলফিনদের বাঁচাতে কাজে নেমেছিলাম। কোথাও ডলফিন ধরা পড়েছে শুনলেই ছুটে যেতে লাগলাম। তাদের মারতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। প্রবল বাধা এল মৎস্যজীবীদের একাংশের কাছ থেকে। এদের জন্য কেন বাপু তোমার প্রাণ কাঁদছে! ভেবে দেখলাম, সত্যিই আমার প্রাণ কাঁদছে। তাই বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ডলফিনদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। সেই ডলফিনগুলোকে, যারা অনেককাল আগেই ফরাক্কার কাছে বাঁধ দেওয়ায় ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক বছর ধরে।
আমাদের নদীগুলো যেমন ইংরেজ আমল থেকেই বড় বড় ব্রিজ তৈরিই ফলে মরতে বসেছে, তেমনই ফরাক্কার বাঁধের ফলে এই গাঙ্গেয় ডলফিনরা একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে আটকে যাওয়ায় তাদের বিলুপ্তির আশঙ্কা ত্বরান্বিত হয়েছে। তাদের দীর্ঘ বিচরণ পথের পরিধি ছোট হয়ে গিয়েছে। এই ডলফিনগুলোর চলাফেরা আপাতত বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দেশের অন্য প্রান্তে থাকা তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে সম্ভবত আর কোনওদিনই তারা মিলতে পারবে না। বিহারের দিকে ভাগলপুরে অনেক গাঙ্গেয় ডলফিনের দেখা মেলে। তারাও এই বিভাজনের শিকার হয়ে একইরকম অসুবিধেয় রয়েছে। দেশভাগ কি এমন হা-হুতাশ দেয়নি মানুষকে? বিশেষ করে বাঙালি আর পাঞ্জাবিরা যেমন দেশভাগের চিরস্থায়ী দুঃখ সয়ে বেঁচে রয়েছে।
গাঙ্গেয় ডলফিনদের দেশ কোথায়? মোটামুটি কয়েক ধরনের ডলফিন দেখা যায় আমাদের দেশে। তাদের মধ্যে এই গাঙ্গেয় ডলফিনরা একটু অন্যরকম। একেবারেই দক্ষিণ এশিয়ার নদীর ডলফিন এরা। ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েকটি দেশে একসময় প্রচুর পরিমাণে এদের দেখা মিলত। ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপালের নদীতেও তারা ঘুরে বেড়াত। আমাদের দেশের মূলত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এবং এই দুই বিশাল জলধারার সঙ্গে যুক্ত নদীগুলিই ছিল এদের প্রধান বিচরণক্ষেত্র। ভারত ও বাংলাদেশে বয়ে চলা ইছামতি ও তার শাখানদী যমুনাতেও একসময় শুশুকের দেখা মিলত। এখানে বলে রাখা ভাল, এই শুশুককে কোথাও কোথাও হুসুক এবং তালভোস নামেও ডাকা হয়। এদের মুখের সামনেটা অনেকখানি লম্বা। তাতে পরিপাটি করে সাজানো দাঁত আছে। চোখে একেবারেই দেখে না তারা। ফলে জলের মধ্যে একধরনের তরঙ্গ ছড়িয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। অদ্ভুতভাবে ডাকে, নানা সুর তোলে, নিজেদের ভাল-মন্দর খবর আদানপ্রদান করে।
গাঙ্গেয় ডলফিনরা বছরে একবারই বাচ্চা প্রসব করতে পারে। মানুষের জীবনের মতো মনে হচ্ছে না? হ্যাঁ, এরাও পরিবার অন্তপ্রাণ। একসঙ্গে থাকা, পরিবারের সদস্যদের আগলে রাখা, বিপদে ছুটে যাওয়া, ছোটদের খাবার যোগানো— সব দায়িত্ব পালন করে তারা। সামাজিক সম্পর্ক মেনে চলে। মা-বোনের সঙ্গে প্রণয় বা যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয় না। ধরা যাক, একটি পরিবারের কোনও তরুণীকে মন দিয়ে ফেলেছে অন্য পরিবারের কোনও তরুণ। দুই পরিবার তখন আত্মীয়তার বন্ধনে জুড়ে যাবে। যেন মিলন উৎসব। এসবই মানুষের বিবাহরীতির কথা মনে পড়ায়। আজীবন সম্পর্কের শুরুতে ডলফিনরা সকলে মিলে যুগলকে দেবে একান্তে সময়যাপনের অধিকার। জীবনসঙ্গীর প্রতি খুবই বিশ্বস্ত থাকে তারা।
মাছই তাদের একমাত্র খাবার। বোয়াল, আড়, পাঙাস প্রভৃতি নানা ধরনের ‘রাক্ষুসে’ মাছ খেয়ে তারা নদীতে মাছের ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলে নিরীহ ডলফিনদের ওপর মৎস্যজীবীদের একাংশের রাগ অকারণ বলেই মনে হয়। ডলফিনদের তেল ব্যথানাশক বলেও একরকমের অপপ্রচার আছে। একধরনের স্বার্থান্বেষী মানুষ তাদের ‘তেল’ বের করে বাজারে বাতবেদনা, হাড়ের ব্যথার উপশমের নামে বিক্রি করে মুনাফা করে। ব্যথা কমাতে এই তেলের কার্যকারিতার কোনও বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ নেই। উল্টে তাতে মানুষের শরীরে ক্ষতি হতে পারে। তবু কিছু মানুষের লোভের জন্য অসংখ্য ডলফিন মারা পড়ে। তাদের মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। শরীর চুঁইয়ে পড়া দেহরস, গলিত চর্বি বড় বড় পাত্রে ধরা হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক ডলফিনের শরীর থেকে কয়েক টিন পর্যন্ত ‘তেল’ বেরোতে পারে। এই চোরাশিকার ও ব্যবসার জন্য ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে গাঙ্গেয় ডলফিনরা।
কয়েক দশক আগেও এপার বাংলায় এদের সংখ্যা হাজারের ধারেকাছে ছিল। সেই সংখ্যা কমতে কমতে মাত্র ৬৫ থেকে ৭০-এ এসে ঠেকেছে। গাঙ্গেয় ডলফিনদের জীবনযাপনের ধরন, বুদ্ধিশুদ্ধিও মানুষের অনেকখানি কাছাকাছি। তারাও মানুষের কাছে আসতে চায় কিন্তু মানুষ এতটাই একলষেঁড়ে আর আত্মকেন্দ্রিক যে সে শুধু নিজের সুবিধের জন্য জগতের বাকি সব কিছুকে শেষ করে ফেলতে পিছপা নয়।
মানুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সত্যিকারের ‘মানুষ’-রা এগিয়ে না এলে গল্পগাথার ‘সোনার চোখ’ ডলফিনদের বিলুপ্তি আটকানো যাবে না। ডলফিনদের যাতে ধরা না হয় সেজন্যই হয়তো কোনওদিন ওই ‘সোনার চোখ’-এর গল্প তৈরি হয়েছিল। যদিও তাতে মানুষের অপকর্ম আটকানো যায়নি। সোনার চোখ না থাকুক প্রকৃতির এই নিরীহ, সুন্দর, কোমল প্রাণীটি কম মূল্যবান নয়। এভাবে তারা লুপ্ত হয়ে যেতে থাকলে ডোডো পাখির মতো তাদের কথাও লেখা থাকবে শুধু গল্পকাহিনিতে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না কোনওদিন।