বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

বাঙ্গালিনী বম্বেওয়ালি

ভদ্রলোক বিষম ডিসঅ্যাপয়েন্টেড হলেন। আমি জানি আপনি ইংরেজি পড়তে জানেন। কিন্তু পড়বেন কখন? বাস ছেড়ে চলে গেলে? ইংরেজিটা লেখা থাকে বাসের পিছনে। বাস ছেড়ে চলে গেলে তবেই দেখা যাবে।

বাসবদত্তা কদম

 

আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে, বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের এক কন্যে বম্বে যাওয়ার টিকিট কেটে বাড়িতে ঘোষণা করল— সামনের মাসে সে কলকাতা ছাড়ছে।
বাড়ির ভিত দুলে উঠল। দুলবে এটা সে জানত। তাই ইন্টারভিউ দিয়ে জানায়নি, টিকিট কেটে ঘোষণা করেছিল।
মা প্রথমে রাগলেন। পরে কাঁদলেন। দফায় দফায় মিটিংয়ে বসলেন মামা, মা, জেঠু, কাকু, বাবা। ইতিপূর্বে এক জেঠু ছাড়া কেউ বম্বেতে থাকেননি। সেই জেঠু বললেন, বম্বে মেয়েদের একা থাকার পক্ষে খুব একটা ভাল জায়গা নয়।
মামা বললেন, মেয়েমানুষ, তুই কিনা যাবি আরব সাগরের পাড়ে চাকরি করতে? ওখানে লোকজন কথায় কথায় সিনেমায় নেমে পড়ে শুনেছি।
আহা, মামা গো, এমন যদি সত্যি হত।
এই দ্যাখো, ঠিক বুঝেছি, সিনেমায় নামাই ওর আসল লক্ষ্য। কম্পিউটারের চাকরি-টাকরি বাজে কথা। না হলে কি আমাদের সেক্টর ফাইভ নেই! কাজ জানলে এখানেই ভাল চাকরি জুটে যেত।
এর পর বন্ধুমহলে আমার ক্লাস শুরু হল। বম্বে যাচ্ছিস, আগে হিন্দিটা ভাল করে শেখ। হ্যায় লাগালেই হিন্দি হয় না, এটা মনে রাখবি।
হিন্দি সিনেমার হিন্দি দিয়েও কাজ হবে না, জানিস তো!
মিনমিন করে বললাম, ইংরেজি?
আরে ছোঃ! ইংরেজি একটা ভাষা! ক-বে ওরা আমাদের ছেড়েছে আর তোরা এখনও ওদের ছাড়তে পারছিস না।
বম্বের একটা স্পেশাল হিন্দি আছে। ওটা তোকে শিখতেই হবে।
খোঁজ খোঁজ খোঁজ। অতঃপর এক বন্ধু বলল, টিঙ্কুদি শেখাবে। সে মাস্টার ও ভাষায়। বম্বেতে বারো বছর থেকেছে।
এক বন্ধুর দিদির ননদ সেই মহীয়সী টিঙ্কুদি আমার কেস শুনে দয়াপরবশ হয়ে আমাকে সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
টিউশন ফি কীরকম লাগবে? মায়ের এই প্রশ্নের উত্তরে বন্ধু বলল, না কাকিমা, টিউশন ফি কিছু লাগবে না। বম্বে থেকে পরে ওনার ফরমাইশ মতো দু-একটা জিনিস এনে দিলেই হবে।
মা বললেন, ওমা! কী ভাল! এখনও এত ভালমানুষ আছে!
মনে হল বলি, না। সব ভালমানুষেরা তোমাদের বড় করেই অন্য গ্রহে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে বলার সাহস হল না।
টিঙ্কুদি নাম্নী তিনি, আমার দায়িত্ব নিলেন। দায়িত্ব নিয়ে আমার নড়বড়ে হিন্দিতে আচ, উচ, লা (করেল্লা, খায়েল্লা) যুক্ত করে আমার ওয়ার্ডবুক ভরে, আমার হিন্দির বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিলেন।
এর পর এল লোকাল গার্জেনের প্রসঙ্গ।
আমি ছাড়া সবাই জানে দেখলাম, বম্বেতে লোকাল গার্জেন মাস্টো মাস্ট।

কী মুশকিল, আমি চাকরি করতে যাচ্ছি। স্কুলে ভর্তি হতে না।
সে তুই যাই বল। লোকাল গার্জেন লাগবেই।
নিজেকে কীরকম মালিকবিহীন পার্সেল মনে হতে শুরু করল।
এর পর লোকাল গার্জেনের লিস্ট আসতে শুরু করল। কার দিদি থাকে জুহু। কার মাসি থাকে নালাসোপারা। কার পিসতুতো দাদা ভাসাই।
জানা গেল, এঁরা সকলেই আমার অভিভাবক হবার জন্য সবথেকে উপযুক্ত।
এত লোকের ঠিকানা আর ফোন নম্বর টুকতে টুকতে, নিজের এক মামা যে বম্বেতেই থাকেন সেটা ভুলেই গেছিলাম।
শেষ মুহূর্তে মায়ের মনে পড়ল মায়ের মাসতুতো ভাইয়ের কথা।
ফোন নম্বর ছিল ডায়েরিতে, কালেভদ্রে ফোনাফুনি হয়। মা ফোন করে ভয়ে ভয়ে বলতেই মামা অতি সহজেই ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করলেন— আমি দাদার স্টেশন থেকে নিয়ে আসব। পরে থাকার ব্যবস্থা যা হবে তা হবে। আগে অফিসটা জয়েন করুক।
এত নিরামিষভাবে এমন জাজ্বল্যমান সমস্যার সমাধানে জনতা জনার্দন মনে হল তেমন খুশি হল না।
ট্রেনে তুলতে এল বাবা, কাকা, মামা (থ্রি মাস্কেটিয়ার্স)।
আমি মানা করলাম, এতজন যাবার দরকার নেই, আর আমি যখন নিজে নিজেই ট্রেনে উঠতে পারি। সঙ্গে তো মোটে একখানা ব্যাগ।
শুনল না। আমার কথা কে আর কবে শুনেছে।
আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে বাবা আর মামা নেমে গেল। কাকা তখনও আশপাশ দেখছে। জল, বিস্কুট আছে কিনা পরীক্ষা করে নিল। ইতিমধ্যে ট্রেন তো দিয়েছে ছেড়ে। অতঃপর বলতে হল, কাকা, ট্রেন তো ছেড়ে দিয়েছে।
মজা করছিস!
না, সত্যি, দ্যাখো।
তাচ্ছিল্যভরে মুখ তুলে দেখল সত্যি প্ল্যাটফর্ম দুলছে। অ্যাঁ! সে কী রে!
ওদিকে ট্রেনের বাইরে বাবা আর মামা দৌড়চ্ছে। কাকা সিঁড়ি থেকে নামবার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এর পর খানিকটা পপাত প্ল্যাটফর্মতলে আর খানিকটা মামার হাতে।
ট্রেনের দরজায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমি আর কী-ই বা করতে পারি তখন।
একটু পরেই কোনও ফোন বুথ থেকে বাবার ফোন। বম্বে আসছি বলে মা জননীর কৃপায় আমি তখন দস্তুরমতো একখানা নোকিয়া ৩৩১০-এর মালকিন। বাবা জানাল, পা মচকেছে। বিপদ কিছু হয়নি। যাক। নিশ্চিন্তে ট্রেনের জানলায় গাল লাগিয়ে বসলাম।
এবার শেখা হিন্দির প্র্যাকটিস শুরু করতে হবে।
কিমাশ্চর্যম অতঃপরম। ভেন্ডার থেকে চা, প্যান্ট্রিবয় থেকে ঝাড়ুদার— সবাই দেখি আমার মাতৃভাষায় কথা বলে। আমি হিন্দি বললেও তারা বাংলায় উত্তর দেয়।
কী মুশকিল, এত কষ্ট করে শেখা ‘হায়’ ছাড়া হিন্দি মাঠে মারা যাবে!
রাত ফুরিয়ে দিন এল। ভিলাই ইত্যাদি পেরিয়ে শনশন চলেছে গীতাঞ্জলি।
দিদি, চায়ে লাগে গা?
এ কী! আপনি একটু আগে বাংলা বলছিলেন না!
হাঁ, অব নাগপুর আ রহা হ্যায় না দিদি।
ট্রেন মহারাষ্ট্র ছুঁতে না ছুঁতে বাঙালি হিন্দিতে কথাবার্তা শুরু করে দিল। পুলকিত ও রোমাঞ্চিত আমি! হিন্দি শেখা তাহলে বৃথা যাবে না!
নাসিক থেকে উঠল কিশমিশওয়ালা। হিন্দির ক্ষমতা পরীক্ষা করতেই কিনে ফেললাম দু’প্যাকেট। আশপাশে লোকজন প্রচুর দরদাম করে চলেছে কিন্তু কিনছে না।এত সস্তায় কিশমিশ পেয়েও এরা কেনে না কেন?
পরে আসা-যাওয়া করতে গিয়ে বুঝেছি, কেনার থেকে দরদামে এঁদের আগ্রহ ঢের ঢের বেশি।
আমার মাসির এক বন্ধু শুনেছি বাসে উঠে টিকিট নিয়েও কন্ডাক্টরের সঙ্গে দরাদরি করতেন। সে জমানায় টিকিট দশ বা বিশ পয়সা হত দূরত্ব অনুযায়ী। কিন্তু তিনি বিশের দূরত্বও দশেই যাবেন। বিশ পয়সা বললেই নাকি বলতেন, দাদা, একটু কম হবে না? পুরো রাস্তা তো যাচ্ছি না আমি। তর্ক করে করে কন্ডাক্টরই শোনা যায় হাল ছেড়ে দিতেন হামেশাই।
একটা বড় স্টেশনে ট্রেন থামতে অনেকেই উঠছে-নামছে দেখলাম। প্ল্যাটফর্মে লোভনীয় খাদ্য বিকোচ্ছে।

মাঝরাস্তায় কিন্তু কোনও প্ল্যাটফর্মে নামবি না। মায়ের সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে নেমে পড়লাম এবং কিনে ফেললাম দু’প্লেট। মাত্র পনেরো টাকা। আহা, মহারাষ্ট্র তো কলকাতার চেয়েও ঢের সস্তা মনে হচ্ছে।
ট্রেনে এসে আয়েশ করে বসে সে খাদ্য মুখে দিলাম। চোখ বন্ধ করে চিবুচ্ছি। আহ্‌! ব্রহ্মতালু ছিটকে প্ল্যাটফর্মে ঝাঁপ দেবে মনে হল। কী ঝাল! কী ঝাল! এত ঝাল মানুষ খায়। আমার দু’চোখ দিয়ে অশ্রুনদী। কিন্তু চিবিয়ে চলেছি। আর জল দিয়ে ঝাল ব্যালান্স করছি।
সুখাদ্যটির নাম বড়াপাও। মাঝখানের লাল সুদৃশ্য চাটনিখানার মূল উপাদান লঙ্কার গুঁড়ো।
এর বেশ কয়েক বছর পর আমার পতিদেবতার কাছে শুনেছি, নাগপুরের লোক ঝাল কম খায়! ঝাল খায় আমাদের কোলাপুরের লোকেরা। সেদিন বুঝলাম, আমার আন্দাজ সঠিক ছিল। ঝাল খাওয়ার কম্পিটিশন এদেশে হয়ই হয়। ট্রেনে বসেই বুঝেছিলাম।
আমি বম্বে পৌঁছনোর মাস কয়েক আগেই আমার জনা তিনেক বন্ধু মায়ানগরীতে পৌঁছে গেছিল। সেই বন্ধুরা দায়িত্ব নিয়ে পরদিন আমাকে বম্বের সঙ্গে পরিচয় করাতে নিয়ে গেল। কোথা থেকে বাসে উঠব। বাসে পিছনের গেটে ছাড়া ওঠা যায় না। সামনের গেট শুধু নামবার জন্য। বাসের নম্বর দেখে স্টপে দাঁড়াতে হবে। একটা স্টপের তিনটে ভাগও থাকে বাস অনুযায়ী।
একটা বাসের তিনটে স্টপ! কেন?
আরে না, ওপরে দ্যাখ, নম্বর লেখা আছে। কোনটা কোথায় দাঁড়াবে।
পরে অবশ্য দেখেছি কোনও বাসই তার সঠিক জায়গায় দাঁড়ায় না। দাঁড়ায় ড্রাইভার সাহেবের মেজাজ-মর্জির ওপর। অর্থাৎ যেদিন তিনি বাড়িতে বা অফিসে ঝগড়া না করেই এসেছেন, সেদিন সুন্দরভাবে দাঁড়িয়ে যাবে স্টপে। অন্যদিন? থাক থাক।
প্রথম দিন অফিস পৌঁছলাম। সিভি, সার্টিফিকেট ইত্যাদি পর্ব চুকে যেতে বস আমাদের নতুনদের নিয়ে ক্যান্টিনে গেলেন কফি খাওয়াতে।
অফিস কীভাবে আসবে(ন)? বাসে না ট্রেনে?
ইংরেজিতেই বলেছিলেন, মারাঠি আর ইংরেজির তুই-তুমি-আপনির চক্করটা প্রায় একইরকম। তুলা আর তুমহালা। উচ্চারণে ফারাক অতি সূক্ষ্ম। আছে কী নেই খুঁজে দেখতে হয়।
বাসে আসবে(ন)! কী করে আসবেন(ন) মারাঠি পড়তে পারে(ন)?
যা ব্বাবা! এ শহরে মারাঠি না জানলে বাসে উঠতে দেয় না?
এক ধমকে আমাকে চুপ করিয়ে বললেন, এই কাগজটা ধরুন। এতে ইংরেজি আর মারাঠি সংস্করণ আছে।
ইংরেজি পড়তে পারি তো।
ভদ্রলোক বিষম ডিসঅ্যাপয়েন্টেড হলেন। আমি জানি আপনি ইংরেজি পড়তে জানেন। কিন্তু পড়বেন কখন? বাস ছেড়ে চলে গেলে? ইংরেজিটা লেখা থাকে বাসের পিছনে। বাস ছেড়ে চলে  গেলে তবেই দেখা যাবে।
তাহলে লেখার দরকার কী!
সেটা সরকার বাহাদুর জানে। দেখা হলে জিজ্ঞেস করব। আপনি আপাতত মারাঠি সংখ্যা শিখুন।
অফিস চলছে। তাই আমারও চলা-ফেরা অব্যাহত। বিভিন্ন বাঁক থেকে বম্বে শহরকে চেনা চলছে। বম্বের বিখ্যাত লোকাল ট্রেন তখনও আমার অধরা। অফিস, হোস্টেল, মামাবাড়ি— সবেতেই বেস্ট (বম্বের লোকাল বাস) ভরসা।
হঠাৎ আসা এক ইন্টারভিউ সুযোগ করে দিল ট্রেন চড়বার। যেতে হবে ভান্ডুপ নামক এক জায়গায়।
অফিস থেকে খানিক দূরে কুরলা স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে ভান্ডুপ।
সদাশয় কলিগরা শেখাল, ট্রেনে তো ওঠনি, জান না। লোকাল ট্রেনে উঠতে গেলে ভিড়ের ঠিক মাঝখানে দাঁড়ালেই হবে। ভিড় ধাক্কা মেরে তুলে দেবে ট্রেনে।
দাঁড়ালাম। সত্যি। আমি উঠে পড়েছি ট্রেনে। ট্রেন চলছে। আমি ভীষণ পুলকিত নিজের কৃতিত্বে। সামনে থেকে এক মহিলা ধাক্কা মারছেন। এ কী, ফেলে দেবে নাকি!
তার পর চিৎকার চেঁচামেচিতে উদ্ধার হল, আমার স্টেশন আসছে আর সেটা উল্টো গেটে। আমি অন্যের রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি।
অতঃপর ‘বেরি আহে কায়’ অর্থাৎ আমি পাগল কিনা ইত্যাদি প্রিয় সম্ভাষণে ভূষিত করে ট্রেনের মহিলাকুল দায়িত্ব নিলেন আমাকে ট্রেন থেকে নামানোর।
হাতের ঘড়ি এবং পায়ের এক পাটি চপ্পল ট্রেনের ভেতরেই পড়ে রইল। প্রায় লি-কারের মতো ডিগবাজি খেতে খেতে আমার অবতরণ হল স্টেশনে।
অফিস যাতায়াতের পথে এক ফলওয়ালা ভাই জুটেছিল আমার। প্রায় রোজই তার থেকে কিছু না কিছু কিনতাম। সে হঠাৎ একদিন উৎসাহিত হয়ে উঠল আমাকে ‘হাপুস’ আম খাওয়ানোর জন্য।
হাপুস-হুপুস করে আম খেতে হয় সে তো আমাদের রবি কবি কবেই বলে গেছেন কিন্তু এই মারাঠি তনয় সে কবিতা পড়ল কবে।
আমি যত বলি হাপুস ওকে, লেকিন আমকা নাম বাতাও।
হাপুস আম দিদি।
নধরকান্তি সে আম দেখেও খুব একটা সাহস হয় না। জোর-জবরদস্তিতে একখানা নিই। হস্টেলে ফিরে ছুরি দিয়ে কেটে খেলাম। বাহ্‌, বেশ তো খেতে। তবে একটু শক্ত।
পরদিন অফিসে গিয়ে বললাম। ওদের সে কী হাসি। আরে ভাই, উও আলফানসো হ্যায়।
বলল যে হাপুস!
উও লোকাল নাম!
আমেরও নিক নেম!
মাস ছয়েক পেরিয়ে গেল বম্বে শহরে। অনেক রকমের জ্ঞান লাভ করে চলেছি…।

গরম তো ভয়ংকর গরম কিন্তু তা পেরিয়ে নামল এমন ভয়ংকর বৃষ্টি যে সাবওয়ে পর্যন্ত জলের তলায়। বাসের চাকা ডুবে যাচ্ছে অর্ধেকের বেশি, ট্রেন বন্ধ। রেললাইন বেঁকে গেছে। কোমর ডোবানো জলে রেললাইন ধরে এগারো নম্বর ছাড়া গতি নেই। অমন বৃষ্টিতেও লেশমাত্র বিরক্তি নেই। ‘কায়ে মস্ত পাউস আলা’ (কী দারুণ বৃষ্টি নেমেছে) বলতে বলতেই হয়তো পড়ে গেল কোনও গর্তে হুড়মুড়িয়ে। উঠেই হাসছে। আবার সেই বর্ষার গুণগান করছে আর হাঁটছে।
প্রথমবার ভাবলাম এমন গরমের পরে বৃষ্টি দেখে উৎসাহিত জনতা। কিন্তু পরে দেখলাম প্রতিবছর এমন বৃষ্টিই নামে। আর এরা বলবেই ‘কায়ে মস্ত পাউস আলা’।
বর্ষা পুরো মেটার আগেই অফিসে গিয়ে শুনলাম পরদিন ছুটি। কীসের ছুটি? লিস্টে দেখি জন্মাষ্টমী। ছুটির হাফ আনন্দ নিয়ে অফিস থেকে ফিরে বিছানার ধারের জানলায় বসেছি। দেখি পাশের পার্কে বিশাল উঁচুতে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে এক হাঁড়ি। এটা কী বস্তু, এহেন জিনিস কলকাতায় দেখিনি কখনও।
গগনবিদারী সুরে বেজে চলেছে মাইক— ‘গোবিন্দা আলা রে’। তার পরেই শুরু হল আসল খেলা। লোক, লোকের ওপর লোক, তাদের ওপর শিশু, তস্য শিশু। ছুঁতে হবে ওই হাঁড়ি। হাঁড়ি ভাঙলে তবে টাকা। এতদিন জানতাম গুপ্তধন থাকে মাটির নীচে। এখানে তো দেখছি আকাশে।
এর পরপরই অফিসে যেতে-আসতে দেখলাম রাস্তার ধারে ধারে ম্যারাপ বেঁধে গণেশ তৈরি শুরু হয়েছে। উঁকি মেরে দেখলাম। মূর্তি হচ্ছে, কিন্তু মাটি কোথায়!
কনক্লুশন টানলাম, এ শহরে পাথর আর বালি বেশি, গঙ্গার নরম মাটি এখানে নেই, তাই গণেশ প্লাস্টার অব প্যারিসের!
সর্বজনীন গণেশ উৎসব দেখতে হবে। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, দেখতেই যদি হয় তবে ‘লালবাগচা রাজা’। দি বেস্ট। তবে অফিসের কলিগরা বলছে, অনেক সময় চব্বিশ ঘণ্টাতেও দর্শন মেলে না। এমন ভয়ানক লাইন।
হস্টেলে এসে দুঃখের কথা বলতেই আমার রুমমেট বলে, আমায় বলবে তো আগে!
এখন তো বলছি। উপায় করো প্লিজ। তোমাকে দশ পিস রাজভোগ খাওয়াব আমি।
হয়ে গেল ব্যবস্থা। তার পিসতুতো দাদার মাসতুতো বোনের পিসিশাশুড়ির ছেলে বা এরকমই কেউ একজন সেখানকার পুজো কমিটির সেক্রেটারি।
ভিভিআইপি লাইন দিয়ে সটান গিয়ে পৌঁছলাম সেখানে। শুনলাম ‘বচ্চন সাব’ ইত্যাদিরা নাকি এই লাইন দিয়েই যান প্রতিবছর।
বম্বে বেশ কিছুটা আপন হয়ে গেছে ততদিনে। মা-বাবা বার দুয়েক ঘুরে গেছে। মা মন দিয়ে পাত্র-পাত্রী কলামে মেয়ের জন্য বম্বেস্থিত সুযোগ্য পাত্র অনুসন্ধানে ব্যস্ত। বম্বের মামা-মামিও পিছিয়ে নেই। এমত সময় এক মারাঠি তনয়কে পছন্দ করেছি আমি এবং বিয়ে করলে তাকেই করব ঘোষণায় আবার বিপ্লবের মেঘ ঘনাল আকাশে।
মা-বাবা মামাকে বগলদাবা করে এসে গেলেন বম্বে।
মামা বললেন, কী বলেছিলাম!
বাবা বললেন, তোর বম্বে প্রেম হয়েছে জানতাম। আর সেটা বেশ ওভারডোজে, তা বলে বোম্বাইয়া?
না বাবা, এ কোলাপুরিয়া। ওদের বাড়ি বম্বে নয়, কোলাপুর।
এর পর গল্প মোড় নিল একেবারে ভিন্ন বাঁকে।
বাঙালি বাড়ি বলে— মারাঠি বিয়ে করে মেয়ের আমাদের বাঙালিয়ানা গেল! মারাঠি শ্বশুরমশাই বলেন— বাঙ্গালিন কে শাদি করে ছেলে আমার বাঙ্গালি ঝালো।
গেল আর ঝালোর ব্যাল্যান্স করে দু’জনের গাড়ি গড়াল গুড়গুড়িয়ে

অলঙ্করণ: রাজ রায় 
1 Comment
  1. Tanuja Chakraborty says

    ভালো লাগল। তবে শেষটা আরও ভালো হতে পারতো।

মতামত জানান

Your email address will not be published.