বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

ভাবের ঘরে চুরি

যাঁদের লেখা ভাল লাগে তাঁরা ইহলোকের মায়া কাটিয়েছেন। আর সশরীরে বর্তমান যাঁদের পুরনো লেখা ভাল লাগে তাঁদের নতুন লেখা ওল্টানোর চেষ্টা করে বুঝি লেখকদেরও যে অবসর নেওয়া উচিত সে বিষয়ে ভাবা দরকার।

দিলীপ কুমার ঘোষ

 

আমার লেখালেখি নিষ্কাম সাধনা। যাঁর হাতগুণে দু’বেলা খাদ্যশস্য-শাকসবজি-মাছ-মাংস-ডিম কাঁচা অবস্থায় গলাধঃকরণের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি, আমাকে মোবাইলে লিখতে দেখলেই তাঁর জিজ্ঞাসা, লিখে টাকা পাওয়া যায়? সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে বাধ্য হই, সাহিত্যবৃত্তিকে প্রোমোট করে বাউন্সার পাওয়া গেলেও মৌলিক লেখালেখি থেকে টাকা পাওয়া যায় না। অন্তত আমার মতো অসিদ্ধ লেখকের লিখে টাকা উপার্জন করা অনেকটা পাথর খুঁড়ে জল বের করার মতো ব্যাপার।
এদিকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে প্রযুক্তিবিদ্যা পাঠরত আমার অষ্টাদশবর্ষীয় সন্তান ইউটিউবে গেম চ্যানেল খুলে সাবস্ক্রাইবার জোগাড়ে ব্যস্ত। সে তার জননীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে এইভাবে তার পক্ষে নাকি অনেক টাকা মায় ডলার পর্যন্ত উপার্জন করা সম্ভব। এই বিষয়ে তার সহায় তার কনিষ্ঠ মাতুল, যে নিজে পাশা বিশারদ শকুনি না হয়েও মোবাইলে এমন কিছু গেম অ্যাকাউন্টের হকদার হয়েছে, ইচ্ছা করলে যেগুলোকে নাকি কয়েক হাজার ডলারে বিক্রয় করা সম্ভব।
এই ডলারের ঝনঝনানি এবং করোনাকালে অনেকাংশে ঘরে বসে প্রায় বিনা আয়াসে আমার মোটা মাসমাইনের সচল প্রবাহ আমার ধর্মপত্নীর মধ্যে এই বিশ্বাস উৎপাদন করেছে যে অর্থোপার্জন ভীষণ সহজ একটা ক্ষেত্র এবং যেকোনও কাজে অর্থোপার্জনটাই মোক্ষ। সংকীর্ণ এবং একদেশদর্শী চিন্তাভাবনার জন্য তাঁকে দোষারোপ করব কী, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আমদানি হয়েছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। যেখানে জীবনে এই প্রথম তিনি শ্রমলব্ধ উপার্জনের বাইরে গিয়ে অনায়াসে মাসমাহিনার ন্যায় অর্থের অধিকারী হয়েছেন। তাই ইদানীং সমস্ত কিছুর মধ্যে তিনি খুব বোধগম্য কারণেই অর্থান্বেষণ করে চলেছেন।
লেখালেখি করে দেখতে গেলে সেইভাবে আমারও কিছু অর্জন করার নেই। অর্থ আমাকে টানে না, খ্যাতির মোহ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে না, অমরত্বের ইচ্ছা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় না। সুতরাং আত্মতৃপ্তি লাভের জন্য আমার অন্তত কষ্টসাধ্য লেখালেখি কর্মে নিযুক্ত হওয়ার কোনও যুক্তি নেই। তবে আমি লিখি কেন? হ্যাঁ, এটা খুব সঙ্গত প্রশ্ন এবং তার উত্তর দেওয়ার দায়ও আমার ওপর বর্তায়। আসলে আমি লিখি, কারণ আমি লেখা ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। অনেক দিন আগে সুনীল গাভাসকরের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম, সেখানে উনি বলেছিলেন, ওঁর ভাবনায় শুধু ক্রিকেট আর ক্রিকেটার। তাঁর সেই কথা ধার করে নিয়ে আমার বলতে ইচ্ছা করে, আমার ভাবনায় শুধু লেখা আর লেখক।
সেটাই হয়েছে আমার কাল। আমি আগে পাঠক, পরে লেখক। আমার লেখক হওয়া নিতান্তই দায়ে পড়ে। না হলে তাঁত বুনেই আমার তাঁতি-জীবন কেটে যেত, এঁড়ে গোরু পোষার কোনও ইচ্ছা আমার ছিল না। পড়তে গিয়ে দীর্ঘদিন আমার মনোমতো নতুন ভাল লেখার সন্ধান আর করে উঠতে পারছিলাম না। যা ভাল লাগে সব দেখি ধ্রুপদী। যাঁদের লেখা ভাল লাগে তাঁরা ইহলোকের মায়া কাটিয়েছেন। আর সশরীরে বর্তমান যাঁদের পুরনো লেখা ভাল লাগে তাঁদের নতুন লেখা ওল্টানোর চেষ্টা করে বুঝি লেখকদেরও যে অবসর নেওয়া উচিত সে বিষয়ে ভাবা দরকার।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা মনে পড়ে যায়। তৎকালীন বঙ্গরঙ্গমঞ্চে অভিনীত নাটকের গুণাগুণ দেখে তিনি খুব হতাশ হয়ে পড়েন এবং লিখতে একপ্রকার বাধ্য হন— “অলীক কুনাট্য রঙ্গে,/মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে,/নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।” কিন্তু তিনি শুধু এটুকু লিখেই নিজের দায়িত্ব পালন করেননি। নিজে নাটক লিখে নাট্যচর্চার অভিমুখ বদলে দিয়ে নিজের কর্তব্য-কর্ম সাধন করেছিলেন। মধুসূদন যা পেরেছিলেন, আমার দ্বারা তা সাধিত হবে, এমন ভাবার মতো মানসিক সুস্থতার অভাব এখনও আমার ঘটেনি। কিন্তু মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যা করতে পেরেছিলেন, আমি অন্তত নিজের জন্যে তো তা করতে পারি! তাই ‘পঙ্গুম্ লঙ্ঘয়তে গিরিম্’ স্মরণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ব বলে মনস্থির করি।
শ্রীরামপুর মিশন-ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের যুগ পেরিয়ে বিদ্যাসাগরের হাত ধরে বাংলা গদ্যসাহিত্য এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায় যেখান থেকে সম্ভবপর হয় কথাসাহিত্য সৃজনের অভিযাত্রা। আলালি-গদ্য এবং হুতোমের ‘কলকেতাই চলতি বুলি’ অর্থাৎ ‘ক্যালকাটা ককনি’ সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে উঠে বাংলা কথাসাহিত্যের দিগন্তকে আরও প্রসারিত করে।
বঙ্গ কথাসাহিত্য ভান্ডারের ‘বিবিধ রতন’ বাংলা সাহিত্যের পাঠককে ধনী করে রাখে কিন্তু ক্ষোভ সঞ্চারিত হয় তখন, যখন দেখা যায় একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এসেও একের পর এক উপন্যাসেও অনুসৃত হচ্ছে বঙ্কিমী ভঙ্গি এবং রীতি; ষাট-সত্তর বছর আগে লেখা শরদিন্দুর অমর সৃষ্টির অক্ষম অনুকরণ; পুরাণ-মহাভারত থেকে আহৃত কাহিনি নিয়ে পুনর্নির্মাণ, না হলে ঐতিহাসিক-অনৈতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের জীবনীমূলক আখ্যান। সময় যত এগোচ্ছে, এই ট্রেন্ড তত বাড়ছে। কোনও সার্থক ভাঙচুরের প্রচেষ্টা নেই বা নিজস্বতা নির্মাণের সচেতন প্রয়াস তেমন চোখে পড়ে না।
বর্তমানে সাহিত্য আর রুচি তৈরি করছে না, পরন্তু জনরুচি নির্মাণ করছে সাহিত্যের ভাব-ভাষা-রীতি-আখ্যান। তার ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। সাহিত্যের নামে রচিত হয়ে চলেছে জনগণেশের পছন্দমাফিক গালগল্প।
আর একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সাহিত্য-সম্পাদনা যে ‘স্পেশালিস্ট জব’, সকলের দ্বারা যে তা সম্ভবপর নয়, এই সরল সত্য ভুলেছে বাংলা সাহিত্যবাজার। অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়া এসে পড়ায় স্ব-সম্পাদিত রচনা প্রকাশ এখন আর অন্য কারও সম্পাদনার ধার ধারে না! আর যেখানে সম্পাদনার সুযোগ রয়েছে সেখানেও গোষ্ঠী রাজনীতির প্রভাব। এর ফল ভাল না খারাপ, তার বিচার একদিন সময়ই করবে।
আর নিজের সাহিত্যসাধনা? সে কথা আর কইবেন না কত্তা, ঘোড়ায় হাসব! সেই প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে যা উঠে আসছে, দেখছি তাও সেই নতুন বোতলে পুরনো মদ! তাই ভাবছি ক্ষান্তি দেওয়াই ভাল, তাতে অন্তত ভাবের ঘরে চুরি করতে হবে না!

অলঙ্করণ: রাজ রায় 
মতামত জানান

Your email address will not be published.