বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

পড়ার বইয়ের বাইরে

 

 

সম্প্রতি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি স্কুলে পড়াশোনার পদ্ধতিতে বেশ কিছু বদলের প্রস্তাব এবং উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। মোট পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশিকা রাখা হয়েছে। তার মধ্যে  অন্যতম একটি হল, বই পড়ার অভ্যাস বাড়ানো। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে পড়ার বইয়ের বাইরে অন্য বই পড়ার অভ্যাস বাড়ানো। সেখানে বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত যে ছাত্রছাত্রীরা রয়েছে তারা যেন যথেষ্ট বই পড়ার সুযোগ পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে, স্কুলের লাইব্রেরির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, সেখানে নতুন বইয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে, পড়ুয়ারা যেন মাসে অন্তত দুটি-তিনটি বই পড়তে পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে, তাদের বই পড়া নিয়ে আলোচনা ও কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে, প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের দু’তারিখে বই দিবস পালন করা হবে। সাধু প্রস্তাব। এই উদ্যোগ সফল হওয়াই কাঙ্ক্ষিত।
সরকারি স্কুলে পঠনপাঠন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকে। বেসরকারি স্কুলের সঙ্গে তুলনা চলে। নানারকম সমীক্ষাও হয় এ বিষয়ে। দেখা গিয়েছে, এ রাজ্যে বেসরকারি স্কুলের তুলনায় সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। অবশ্যই বিষয়টির সঙ্গে আর্থ-সামাজিক কারণ জড়িত। তবে তথ্য হিসেবে যা সত্য, বাস্তবেও তাই। কাজেই সরকারি স্কুলের পঠন-পাঠন পদ্ধতি নিয়ে নতুন ভাবনা ও তার রূপায়ণ সবসময়ই স্বাগত। বিশেষ করে পড়ার বইয়ের বাইরে অন্য বই পড়ায় উৎসাহ বাড়ানো নিয়ে উদ্যোগ স্বাগত অবশ্যই।
নতুন প্রজন্মের হাতে মোবাইল এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার বা অনলাইনে পড়াশোনা এখন আর নতুন কিছু নয়। কারা সেই সুযোগ পাচ্ছে, কতটা পাচ্ছে এবং তার প্রকৃত ব্যবহার ঠিক কীরকম তা নিয়েও যদিও তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। এ কথা তো বলাই হয় যে মোবাইল হাতে এসে যাওয়ার ফলে চারপাশের জগৎ সম্বন্ধে জানা যেখানে বিস্তৃত হওয়ার কথা ছিল তার বদলে তা সংকুচিত হয়ে এসেছে। ঝোঁক ও আসক্তি দুই-ই বেড়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকানোর মতো অবসর আর মিলছে না। বড়রাই এমন অভ্যেসের বাইরে যেতে পারছেন না, ছোটদের দোষ দেওয়া তো দূরের কথা। এর ফলে যা ঘটছে তা হল, মেধাশক্তির অপচয়, তা নষ্টও হচ্ছে। প্রকৃত কথাটি হল, একটি যন্ত্র ও প্রযুক্তিকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করব তা আমাদেরই ওপর নির্ভর করে। ছোটদের শেখানোও আমাদেরই কাজ। সবচেয়ে বড় কথা, তার একটি সুষম ব্যবহার সম্পর্কে তাদের জানানো ও বোঝানো। লাভ ও ক্ষতি দুটোই আমাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।
পড়ার বইয়ের বাইরে অন্য বইয়ে স্কুলপড়ুয়াদের উৎসাহ বাড়ানোর কথা যখন বলা হচ্ছে তখন যে প্রশ্ন প্রথমেই মনে আসে তা হল, উৎসাহ আদৌ আছে কি? বাড়ানো তো পরের কথা। বাস্তব পরিস্থিতি যা তাতে এ বিষয়ে সন্দেহই দেখা দেয়। যেমন, বাংলা বইয়ের পাঠক কমে যাওয়ার একটি কারণ হিসেবে বলা হয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ার ফলে সেই পড়ুয়াদের আর বাংলা বই পড়ায় উৎসাহ আসে না। অথচ, সত্যটি হল এই যে, বাংলা মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়াদের সংখ্যাই বেশি। তারা কি তাহলে পড়ার বইয়ের বাইরে অন্য বাংলা বই পড়ে না? পড়লে তো ছবিটি অন্যরকম হত।
অন্য বই পড়ায় উৎসাহ আনার চেষ্টা মানে তো সাহিত্যের পাঠে, মুক্তচিন্তার পাঠে উৎসাহ দেওয়া। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যে পারিপার্শ্বিকের মধ্যে থাকে তাতে স্কুলে ও স্কুলের বাইরে এমন উৎসাহ পাওয়া কঠিন। কিছু ব্যতিক্রম ছিল, এখনও আছে, কিন্তু তা ব্যতিক্রমই। সংখ্যায় নেহাতই কম। তার ব্যাপ্তি ঘটানো কঠিন কাজ।অন্য বই পড়ায় সাহিত্যপাঠে আগ্রহ তৈরি হওয়া উচিত। এ বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয় যে বিভিন্ন বিচিত্র বিষয়ের বই পড়ায় জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ে, মানবিক বোধ গড়ে ওঠে, ভাল-মন্দের তফাৎ বোঝা যায়, বুদ্ধি ও মেধা ক্রিয়াশীল থাকে, যুক্তি ও আবেগের ভারসাম্য তৈরি হয়।
এইসঙ্গে আর একটি কথাও মনে রাখা দরকার। অনলাইন পড়াশোনা মানে শুধু পাঠ্যপুস্তকের পড়াশোনাই নয়। বই পড়ার বিস্তার তার মাধ্যমেও ঘটতে পারে। তেমন উপায়ও রয়েছে। বাচ্চা কাঁদলে মোবাইল এখন তার ঝুমঝুমি। বড় হতে থাকলেই ইন্টারনেট গেম তার বিনোদন। আরও নানা প্রলোভন সামনে আসতেই থাকে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে যন্ত্র ও প্রযুক্তিকেই আমরা ব্যবহার করতে পারি। অন্য বই পড়ার ক্ষেত্রেও কথাটি খাটে। সব মিলিয়ে যদি এমন ঘটে তাহলে আমাদের ছোটদের লাভ। বড়দেরও। শুধু পড়ার বই মুখে করে ছোট থাকা যায় না। বড়ও হওয়া যায় না। প্রকৃত সাহিত্যের প্রকৃত পাঠ মনকে সংহত করে। ভবিষ্যতের জন্য বর্তমান থেকেই তার চর্চা জরুরি।

মতামত জানান

Your email address will not be published.