বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

ধৈর্যের প্রস্তুতি

 

 

 

 

বিষয়টি আমাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। এই বছর ‘সুখপাঠ’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় যে সমস্ত লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে কিছু লেখায় পাঠকদের প্রতিক্রিয়া আমরা পেয়েছি পত্রিকার পাতাতেই। তেমনই একটি প্রতিক্রিয়া আমাদের ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছে। একটি গল্প পড়ে এক পাঠক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন লেখাটির দৈর্ঘ্য নিয়ে এবং তাঁর প্রশ্ন, অনলাইন পত্রিকায় কি এত দীর্ঘ লেখা ছাপা উচিত? পড়তে গিয়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। পাঠক নমস্য। তিনি কোনও লেখা পড়ে তাঁর মনোভাব সুস্পষ্ট করতেই পারেন। তবে পাঠকের এই প্রশ্নটিই আমাদের সামনে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে এনেছে।
প্রথমত, অনলাইন সাহিত্য পত্রিকায় কত বড় বা কত ছোট লেখা প্রকাশিত হবে তার কি কোনও সুনির্দিষ্ট মাপ রয়েছে?  এখনও পর্যন্ত এরকম কিছু জানা যায়নি। তবে অনলাইন পত্রপত্রিকায় দীর্ঘ লেখা পাঠকরা পড়েন না বা পড়বেন না, এমন একটি ধারণা তৈরি হয়ে রয়েছে নানা কারণে। সেইসব কারণের একটি হল অনলাইন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি পড়ার মাধ্যম। অর্থাৎ কেউ চলভাষ ব্যবহার করবেন,  কেউ কম্পিউটার,  কেউ বা ট্যাব। এক্ষেত্রে প্রথমটির সম্ভাবনাই বেশি ও ইতিমধ্যে বহুল প্রচলিত। মনে রাখা ভাল যে এই ব্যবস্থাটি শুরু হওয়ার পর লেখালেখি সেখানে জায়গা পেয়েছে এবং পাঠকরা তা স্বীকার করে নিয়েই পাঠের অভ্যেসে প্রবেশ করেছেন। চলভাষে এখন নানাবিধ কার্যকলাপে আমরা অভ্যস্ত। যাঁরা তার মধ্যে পড়ার মাধ্যম হিসেবে একে বেছে নিয়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝেই নিয়েছেন। মুদ্রিত মাধ্যমে কোনও লেখা পড়ার স্বাচ্ছন্দ্য পাঠক অন্য মাধ্যমে তেমন পান না, এমন কথাও শোনা যায়। তবে এও নিশ্চয়ই স্বীকার্য যে পাঠক একটি বিকল্প হিসেবেই বা মুদ্রিত মাধ্যমের পাশাপাশিই অন্য মাধ্যমটিকে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং নিয়েছেন বিশেষ করে এই কারণে যে বিশেষ করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর কাছে সাহিত্যপাঠই মুখ্য। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে গেলেও তার ব্যত্যয় ঘটে না বা ঘটবে না।
এর পর যে প্রশ্নটি আসে তা হল, যদি কেউ সাহিত্য পাঠের এই বিকল্প মাধ্যমটিকে ব্যবহার করেন তাহলে কি লেখার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নিয়ে তিনি ভাবিত হবেন?  তিনি কি ধরেই নেবেন যে অনলাইন সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা মাপে ছোট হলেই ভাল? সে লেখা পাঠ করার জন্য বেশি সময় বরাদ্দ করা বা তার সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটানো সম্ভব নয়? যে ধৈর্য পাঠক মুদ্রিত কোনও পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার জন্য বহাল রাখতে পারেন তা কি অনলাইন পত্রিকার ক্ষেত্রে ধৈর্যচ্যুতিতে পরিণত হয়? না কি অনলাইন বা ডিজিটাল ব্যবস্থা আমাদের ধৈর্যকে ক্রমশ খাটো করে আনছে? আমরা চটজলদি কোনও লেখা পড়ে ফেলতে পারলেই সন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছি, তার গুণাগুণ আমাদের কাছে বিশেষ বিবেচনার বিষয় থাকছে না। ফেসবুকে কেউ যতক্ষণ সময় নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ঘোরাফেরা করেন বা সংবাদ পড়েন সেই তিনিই সাহিত্যের একটি দীর্ঘ লেখা পড়ার ক্ষেত্রে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে রাজি নন। এমন যদি ঘটে তাহলে কিন্তু তার প্রভাব অন্যত্রও পড়তে পারে এমন ভেবে নেওয়াটাও বাতুলতা হবে না। মুদ্রিত মাধ্যমেও এমন ঘটছে না সে কথা কি হলফ করে বলা যাবে? যদি ঘটে তা হলে তা মোটেও সুখের হবে না।
শুধু শারদ সংখ্যায় নয়,  তিন বছর  সময়কালের মধ্যে ‘সুখপাঠ’-এ বেশ কিছু দীর্ঘ লেখা প্রকাশিত হয়েছে।  শারদ সংখ্যায় যে সমস্ত লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে বেশ কিছু গল্প, বিশেষ রচনা, প্রবন্ধ ও ভ্রমণ আয়তনে দীর্ঘ। এইসব লেখা প্রকাশ করার সময়ে আমরা শুধু লেখাটির উৎকর্ষ বিবেচনায় রেখেছি, তার আয়তন নয়। কোনও লেখক তাঁর মেধা,  বোধ,  মনন দিয়ে যখন একটি লেখা লেখেন তখন অনলাইন মাধ্যমে পড়ার সমস্যার ধারণাটিকে সামনে রেখে তাঁর লেখাকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া যায় না। তাতে লেখকের ভাবনাকেই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। মনে রাখা দরকার যে লেখক একটি সার্বিক চিন্তার সমন্বয় ঘটাচ্ছেন তাঁর লেখায়।  বটবৃক্ষ না হোক,  পরবর্তীতে কী হবে সে কথা ভেবে কি লেখক অনলাইন পত্রিকায় লিখতে গিয়ে তাঁর লেখাকে বনসাই করে তুলতে পারেন? ফলে ‘সুখপাঠ’ মুদ্রিত নয়, অনলাইন পত্রিকা, এমন ভেবে নিয়ে আমরা লেখকের কলম চেপে ধরিনি।
পাঠ যখন সাহিত্যের তখন সেখানে ধৈর্য এক বিশেষ বিষয়। মাধ্যম সেখানে বাধা হবে কেন?  পাঠকের কাছে আমাদের বলার কথা, কোনও লেখা যদি সার্থক হয়ে ওঠে সেখানেই লেখাটির সাফল্য। লেখক এবং পাঠকেরও সাফল্য।  অভ্যাসের নিয়মই এই যে, তা বদলায়। বাংলা সাহিত্যের ধারাটি নিয়ত বহমান। তা আমাদের গর্বের বিষয়। পাঠক নিশ্চয়ই সেই ধারার সঙ্গে থাকবেন। সেখানে ধৈর্যের প্রস্তুতিই কাম্য।

 

মতামত জানান

Your email address will not be published.