বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

জীববৈচিত্র্যের খনি থেকে শিল্পতালুকের পথে

দীর্ঘদিন ধরে জীববৈচিত্র্য লোকচক্ষুর অন্তরালে বেড়ে উঠেছিল আজ তার নব্বই শতাংশ হারিয়ে গেছে মূলত হ্যাবিট্যাট নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে।

অমর কুমার নায়ক

 

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন শিল্পপতিদের কাছে বিনিয়োগের একটি খোলা বাজার হয়ে উঠেছে নব নির্মিত ‘কাজী নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর’ সংলগ্ন অঞ্চলটি। আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের অন্ডালে অবস্থিত এই বিমান-নগরীটি। এখানে যে শিল্পের প্রভূত সম্ভাবনা আছে সে কথা শুধুমাত্র আজকের দিনের শিল্পপতিরাই আঁচ করতে পেরেছেন তা নয়, বহু বছর আগে থেকে এখানে বিভিন্ন ধরনের শিল্পের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন উদ্যোগপতিরা। সবার আগে কয়লা শিল্পের সূচনা হয় এখানে।
শিল্পাঞ্চল নির্মিত হওয়ার বহু আগে ব্রিটিশ শাসনকালে এখানে গড়ে ওঠে একটি বিশালায়তন এরোড্রোম, যা ব্যবহার করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। বর্তমানে বিমান-নগরীটি দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশ যুগে তৈরি এরোড্রোমের ভগ্নাবশেষ ওপর। স্থানীয়দের কাছে এই এরোড্রোম ‘ঢালাই’ বা ‘চাতাল’ নামেই বেশি পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর এই এরোড্রোম ব্যবহৃত হয়েছে সরকারি হেলিপ্যাড হিসাবে। সামরিক বিমানই বেশি উড়েছে সেই সময়। এরোড্রোমের পাশে অবস্থিত গ্রামের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে ছেলেবেলায় এখানে গেছি বাবার সঙ্গে হেলিকপ্টার নামা ও ওড়া দেখতে। এর মধ্যে কেটে গেছে অনেকটা সময়।

লালমুনিয়া।

পড়াশোনা শেষ করে চাকরি জোটার পর নেশা চাপল পাখি আর অন্যান্য জীবজন্তুর ছবি তোলার। সেই নেশায় ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম এরোড্রোমে। দশ বছর আগের কথা বলছি। বর্ষার পর পুজোর কাছাকাছি সময়। মুগ্ধ করা পরিবেশ। সবুজ মাঠের ধারে দুলছে কাশ, চারপাশে নানা বুনো আগাছা, মাঝে মাঝে দু-একটা বড় গাছ, নানা পাখির হুটোপুটি। প্রায় সকাল-বিকেল ওখানে ছুটে যাই আর তুলে আনি নতুন নতুন বিভিন্ন প্রজাতির ছবি। সেসময় যারা চাষ করতেন তাদের কাছেও আমি ততদিনে পরিচিত মুখ। ওরাই বলে দিতেন কোন দিকে কোন পাখি দেখেছেন বা কোন দিকে শিয়রচাঁদা কি ডোমনা চিতির আনাগোনা। সেসময় সন্ধের দিকে প্রায়ই বাড়ি থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যেত। পড়ন্ত বেলায় অস্থির হয়ে উঠতাম তিতিরের ডাকে। পাড়ার বড়দের থেকে শুনেছিলাম, এখানে গোসাপ, খেঁকশিয়াল, নেউল, শিয়াল আর খটাসের দেখা মেলে সন্ধে আর ভোরের দিকে জোড়ের (একচিলতে জলধারা) কাছে। সেসব দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়নি কোনদিনই কিন্তু এই জোড়ের আশপাশে বন্য জীবনের চিহ্ন দেখেছি বহুবার।

হরিণছড়া প্রজাপতি।

এই জোড়ের পোশাকি নাম ‘তামলা নালা’ আর এটি মিশেছে ডিএসপি মেন গেটের কাছে যে নালা আছে তার সঙ্গে, যা কারখানার নোংরা বয়ে নিয়ে মেশে দামোদরে। এই ‘তামলা নালা’ বা জোড় বর্ষায় পরিপুষ্ট আর অন্য সময় শুকিয়ে যায় জলের অভাবে। তবে কিছুটা অংশে প্রায় সারাবছর অল্প জল থাকে যা আশপাশের বহু জীবজন্তুর পিপাসা মেটায়।
এরোড্রোমের একেবারে লাগোয়া যে তিনটি গ্রাম রয়েছে সেগুলি হল তামলা, অন্ডাল গ্রাম ও দুবচুরুরিয়া। এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হলে দুর্গাপুর থেকে আসানসোলের দিকে যেতে, দু’নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে ডানপাশে বাঁক নিতে হবে। এই রাস্তা আগে থেকে থাকলেও এখন এয়ারপোর্ট কতৃপক্ষ মসৃণ পাকা রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে আর সেই সঙ্গে বদলে গিয়েছে পুরো এলাকার ছবি। বিভিন্ন ধরনের বাসস্থানের মিশ্রণ এই বাস্তুতন্ত্রটি। এখানে একদিকে যেমন চাষের জমি, তেমনই অন্যদিকে সুদূর বিস্তৃত ঘাসজমি। তবে এসব আজ অতীত।
বর্তমানে এই এয়ারপোর্টকে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প, বিভিন্ন ব্যবসায়িক কেন্দ্র, কিছু কারখানাও। এখন আর চাষ-আবাদের তেমন সুযোগ নেই কারণ যেসব আবাদি জমি ছিল তা অনেকেই বিক্রি করে দিয়েছেন। সামান্য কিছু অবিক্রিত জমি এখনও টিমটিম করে টিকে আছে। দীর্ঘদিন ধরে জীববৈচিত্র্য লোকচক্ষুর অন্তরালে বেড়ে উঠেছিল আজ তার নব্বই শতাংশ হারিয়ে গেছে মূলত হ্যাবিট্যাট নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে।

জলমগ্ন অন্ডাল এরোড্রাম ২০২০।

আসানসোল–দুর্গাপুর শিল্পতালুকের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত এই অঞ্চলটিতে অস্থায়ী শ্রমিকের প্রাচুর্য, অনাবাদি জমির প্রতুলতা, কাঁচামালের সুবিধে এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার ফলে তা উদ্যোগপতিদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্র। সমগ্র অঞ্চলটির অবস্থান অজয়-দামোদর নদের অববাহিকার ওপরে। বলা যায়, এখানকার ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্যই জীববৈচিত্র্যের মূল কারণ। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, আবহাওয়া বিভিন্ন জীবকে তাদের বাসস্থান তৈরিতে সাহায্য করেছে। নদীর চরের এলাকায় বছরের বিভিন্ন সময়ে পাখিদের আনাগোনা থাকে। এই অঞ্চলটি ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকে জনবসতি পুনঃস্থাপিত হওয়া পর্যন্ত যে বিস্তর অবকাশ পেয়েছে, তখনই প্রকৃতি তাকে সাজিয়েছে আপন খেয়ালে।

সাইবেরিয়ান স্টোনচ্যাট।

আমি যখন এই এলাকার জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করি তখন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও সে সময় থেকে এখন অবধি প্রায় শতাধিক পাখি, পঞ্চাশেরও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি আর ফড়িং এবং অসংখ্য পোকামাকড় সম্পর্কে জানতে পারি। এয়ারপোর্ট হওয়ার সময় থেকেই সেই জীববৈচিত্র্যের সম্ভার ফুরোতে থাকে। বিভিন্ন জমি প্লট হয়ে বিক্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাষের জমি হারিয়ে যায় যা কিনা বিভিন্ন জীবের আবাসস্থল ছিল। বড় গাছ কেটে জায়গা ফাঁকা করে দেওয়া হয় বিভিন্ন নির্মাণের জন্য। ঢালাইয়ের যেসব অঞ্চলে জল জমার সুযোগ ছিল সেসব অংশে নিকাশি ব্যবস্থা করে জল বের করে দেওয়া হয়। এখানকার মাঠের এবং ঢালাইয়ের জমা জলে অনেক দেশি মাছের দেখা মিলত, বর্ষায় অনেকেই গামছা বা মশারি দিয়ে সেসব ধরত। জল বের করে দেওয়ার কারণে জল জমে শ্যাওলা পড়ায় বাধা আসে। ফলে জলচারী পাখিদের সংখ্যা কমতে থাকে। জোড়ের আশপাশের খেতখামার ছিল ফাঁকা আর সেইসব এলাকায় বাস ছিল বিভিন্ন ছোট স্তন্যপায়ীদের। সেদিকেও নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেছে বছর দুয়েক হল আর তাই সেইসব এলাকা থেকেও সরে গেছে বন্যপ্রাণ। ঘাসবন ছেঁটে ফেলা হয়েছে, পাখিরা আত্মগোপনের সুযোগ হারিয়েছে। বিশেষ করে যারা পরিযায়ী তাদের সংখ্যা দিনের পর দিন কমে আসছে। একটা সময় ছিল, শীতের শুরুতেই এখানে আনাগোনা শুরু হয়ে যেত বিভিন্ন জলচারী পরিযায়ী পাখিদের। সেই সঙ্গে আসত শিকারি পাখিরাও। বহুদূর থেকে উড়ে আসা পাখিরা যখন খাবারের, বাসস্থানের অভাবে ফিরে যেতে বাধ্য হতে থাকল তখন তারা বেছে নিল অন্য কোনও নিরাপদ স্থান। আসলে এই ঘটনা এক দিনে ঘটেছে তা নয়, দীর্ঘদিন ধরে একটি জায়গা নষ্ট হওয়ার কারণে জীবকুল সরে গেছে অন্য কোনও স্থানে।

কাপাসি চিল।

তবে কি বর্তমানে কিছুই নেই এই অঞ্চলে? এ কথা বলা ঠিক হবে না। এখনও সামান্য কিছু জীবজন্তু টিকে আছে যেসব অল্প অংশ সজীব আছে সেখানেই। কিছু পরিযায়ী পাখি এখনও আসে শীতের সময় অল্প জমা জলে। আবার বছরের বিভিন্ন সময়ে যারা প্যাসেজ মাইগ্র্যান্ট হিসেবে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে যায় তারা কিছুটা সময় কাটিয়ে যায় এখানে। এরোড্রামে দেখা পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাখিরা হল শর্ট-ইয়ার্ড আউল, লং-লেগড বাজার্ড, বুটেড ঈগল, ইউরেশিয়ান মার্স হ্যারিয়ার, ইস্টার্ন মার্স হ্যারিয়ার, পায়েড হ্যারিয়ার, পেরিগ্রিন ফ্যালকন, রেড-নেকড ফ্যালকন, লেসার অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক, গ্রে হেরন, মার্স স্যান্ডপাইপার, স্পটেড রেডশ্যাঙ্ক, কমন গ্রিনশ্যাঙ্ক, বিভিন্ন ওয়ের্বলার, ওয়েগটেল, কমন স্টোনচ্যাট, সাইবেরিয়ান রুবিথ্রোট, ব্লু-থ্রোট এবং গ্রে ফ্ল্যাঙ্কোলিন ও বিভিন্ন মাঠের পাখিরা। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে দেখা গেছে খেঁকশিয়াল, শিয়াল, খটাস প্রভৃতি। কালাচ, চন্দ্রবোড়া, গোখরো, এঁটেল ঢোঁড়া সাপ ও বিভিন্ন ব্যাং এবং নানা ধরনের পতঙ্গও আছে। তবে জায়গাটি ছিল জীববৈচিত্র্যের খনি। আমরা তার বদলে বেছে নিয়েছি ঝাঁ চকচকে শহরকে।

ছবি: লেখক 
মতামত জানান

Your email address will not be published.