সবচেয়ে বড় কথা, সব না হলেও পত্রিকায় মুদ্রিত ভ্রমণ বিষয়ক লেখাগুলির মধ্যে কোনও কোনওটি তুমুল পাঠকপ্রিয় হয়েছে। সব মিলিয়ে ভ্রমণ সাহিত্যের একটা স্বতন্ত্র সত্তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তৈরি হচ্ছিল আলাদা পাঠক।
গৌতম কুমার দে
বাংলা পত্রপত্রিকায় ভ্রমণ বিষয়ক লেখালেখি শুরু হওয়ার অনেক পরে এসেছে শুধুই ভ্রমণ বিষয়ক একটি পত্রিকা।
১২৮৭ থেকে ১২৮৯ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’-এ ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয় সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’। তখন তাঁর বয়স ৪৬-৪৮ বছর। প্র.ন.ব (প্রমথনাথ বসু নামের আদ্যাক্ষর থেকে) ছদ্মনামে প্রবন্ধাকারে লেখাটি বেরিয়েছিল ছয় কিস্তিতে। ১২৯৯ বঙ্গাব্দ থেকে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে জলধর সেনের হিমালয় ভ্রমণের কাহিনি। ‘ভারতী’-র মতো আর একটি বিখ্যাত মাসিক সাহিত্যপত্র ছিল ‘সাহিত্য’। সেখানেও ছাপা হত জলধরবাবুর হিমালয় ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখা।
অনেকে মনে করেন বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক ভ্রমণকাহিনি ‘পালামৌ’। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ বইতে লিখেছেন : “…পালামৌ (১৮৮০) ঠিক প্রবন্ধ নহে, মুখ্যত ভ্রমণকাহিনী, তবে ইহার মধ্যে উপন্যাস ও প্রবন্ধেরও কিছু উপাদান দেখা যায়।” সুকুমার সেন তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ বইয়ে বলেছেন : “শুদ্ধ ভ্রমণকাহিনী উপলক্ষে যে আখ্যান (?) মনোরম সাহিত্যরচনা সম্ভব তাহা পালামৌ প্রমাণিত করিয়াছে।”
বাংলা ভাষায় হিমালয় বিষয়ক প্রথম যথার্থ লেখার অধিকারী জলধর সেন, তাঁর লেখা ‘হিমালয়’ ভ্রমণকাহিনি হিসেবে আজও বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। জলধরবাবু একা নন, আরও অনেকের ভ্রমণ বিষয়ক লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হত।
এই অনতিদীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট যে, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত পত্রপত্রিকায় ভ্রমণ সাহিত্য প্রকাশের একটা রীতি চালু হয়ে গিয়েছিল সেই সময়ে। পাঠকের একটা অভ্যাসও তৈরি হয়েছিল বলা চলে ভ্রমণ সাহিত্য পাঠের ব্যাপারে। সবচেয়ে বড় কথা, সব না হলেও পত্রিকায় মুদ্রিত ভ্রমণ বিষয়ক লেখাগুলির মধ্যে কোনও কোনওটি তুমুল পাঠকপ্রিয় হয়েছে। সব মিলিয়ে ভ্রমণ সাহিত্যের একটা স্বতন্ত্র সত্তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তৈরি হচ্ছিল আলাদা পাঠক। এই দুটি বিষয় পরস্পরের পরিপূরক। এই স্বতন্ত্র সত্তা বিষয়ভিত্তিক পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি এক প্রাক্ শর্ত।
ভ্রমণ সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের এই সংযোগকে তুলনা করা যেতে পারে শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষার যুক্ত হওয়াকে। এই যুগলবন্দীতে যে আভা বিকীর্ণ হচ্ছিল, তৎকালীন পাঠকের ভাববিশ্বে সেটাই কাঙ্ক্ষিত সমগ্রতা পেল যখন এর সঙ্গে যুক্ত হলেন পথের ডাকে সাড়া দেওয়া বাঙালিরা।
অবশেষে অনুকূল জল-হাওয়া পেয়ে অঙ্কুরিত হল ভ্রমণপাগল জাতি বাঙালির মাতৃভাষায় প্রথম ভ্রমণ বিষয়ক পত্রিকা ‘ভ্রমণ কাব্য’। আত্মপ্রকাশ ১৯৬৭ সালের ১ অক্টোবর। ত্রৈমাসিক। সম্পাদক মনোজ দাস। সম্পাদকই পত্রিকার মুদ্রক, প্রকাশক, প্রযোজক, বিজ্ঞাপন সংগ্রাহক, জনসংযোগকারী আর স্বত্ত্বাধিকারী তো বটেই। অর্থাৎ সব দায়িত্বই একজনের কাঁধে। এই প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যাই ছিল পত্রিকার শারদ সংখ্যা। বিনিময় মূল্য ৭৫ পয়সা।
মনোজ দাস থাকতেন মধ্য কলকাতার তালতলার কাছে। ১৭ দুর্গাচরণ ডাক্তার রোডে। তবে পত্রিকা ছাপা হয়েছিল গীতাভারতী প্রেস, ১৭১/১ বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট থেকে। সম্পাদক নিজে একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন। পত্রিকা নির্মাণে তার স্বাক্ষর ছিল পাতায় পাতায়। পঞ্চান্ন-ছাপান্ন বছর আগের সেই পত্রিকায় মুদ্রিত বিজ্ঞাপনের সংখ্যা অবাক করার মতো।
‘ভ্রমণ কাব্য’ পত্রিকার এই নামই পত্রিকাটির চরিত্র, মান, লক্ষ্যকে সূচিত করছে। নেহাত যে হালকা মেজাজের, লঘু চালের পত্রিকা নয় এটি, বরং ভ্রমণ সম্পর্কে পত্রিকার একটা আদর্শ ও উদ্দেশ্য রয়েছে— ভ্রমণ নিয়ে তা গঠনমূলক কিছু করতে চায়— পত্রিকার নামেই তার পরিচয়।
পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল : “অবশেষে ভ্রমণ বিষয়ক পত্রিকা ‘ভ্রমণ কাব্য’ আত্মপ্রকাশ করল। এটা সর্বজনবিদিত যে বেশিরভাগ বাঙালি সুযোগ পেলেই এদিক ওদিক বেড়িয়ে পড়েন। ভ্রমণ কাহিনী পড়তেও তাঁরা ভালোবাসেন। অথচ বাংলা ভাষায় এই ধরনের একটি পত্রিকার খুবই অভাব ছিল। ভ্রমণপিপাসু পাঠকবর্গকে সুখী করতে পারলেই এই পত্রিকা প্রকাশের সার্থকতা থাকবে। এই প্রকাশ সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে যাঁকেই এই সংখ্যায় লেখা দেবার অনুরোধ জানান হয়েছে তিনিই সাগ্রহে সম্মতি দিয়েছেন।…”
পত্রিকা সম্পর্কে সারস্বত সমাজের এই আগ্রহ ও সহযোগিতা পত্রিকার শেষ সংখ্যা প্রকাশ হওয়া অবধি নিরবচ্ছিন্নভাবে ছিল। পত্রিকার প্রথম সংখ্যা সজ্জার ভার নিয়েছিলেন শিল্পী প্রবীর বিশ্বাস। তখনকার এক বিশিষ্ট ভ্রামণিক ও চিত্রগ্রাহক প্রবোধ দে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সম্পাদককে, সারা ভারত ঘুরে তোলা তার সমস্ত ছবি তিনি ‘ভ্রমণ কাব্য’ পত্রিকাকে দেবেন।
উদ্বোধনী সম্পাদকীয়তে পত্রিকার আদর্শ ও লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল—
“১) ভ্রমণের ওপর লেখাগুলোকে নিছক কাহিনী বলে আমরা মনে করি না। এরও একটা সাহিত্য রস রয়েছে। সেই ভ্রমণ সাহিত্যের প্রচার ও প্রসার আমাদের লক্ষ্য। এই সাহিত্য আলোচনার জন্য ‘ভ্রমণ সাহিত্য প্রসঙ্গে’ শীর্ষে আমরা ভ্রমণ সাহিত্যের উপর আলোচনা আহ্বান করছি।
২) সর্বসাধারণের মধ্যে ভ্রমণের স্পৃহা জাগিয়ে তোলা আমাদের লক্ষ্য।
৩) ভ্রমণকারীদের সুবিধার জন্য যে সব ব্যবস্থা করা দরকার তার জন্য আমরা সরকারী দপ্তরকে অবহিত করব এবং সেই ব্যবস্থা যাতে হয় সেই চেষ্টা করব।
৪) বৈদেশিক মুদ্রার অভাব… পরিবর্তনের জন্য আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে… দাবী করব।
৫) বিদেশী পর্যটকগণ আরও বেশী সংখ্যায় যাতে ভারত ভ্রমণে আসেন সেইজন্য যে সব ব্যবস্থা করা দরকার বলে মনে করি তা কর্তৃপক্ষকে জানানো ও তাঁদের সাথে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করব।
৬) ভারতের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে (যেখানে থাকবার সুব্যবস্থা নেই) যাতে সুলভে খাওয়া এবং থাকার ব্যবস্থা করা হয় সেই জন্য সরকার এবং জনসাধারণের কাছে অনুরোধ জানাব।”
সম্পাদকের বক্তব্য অনুসারে ‘ভ্রমণ কাব্য’ চেয়েছিল পর্যটনের সার্বিক ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন। এজন্য সরকার থেকে আমজনতা সকলকে সে এই কর্মকাণ্ডের শরিক করতে চেয়েছে। সাধারণ মানুষকে
ভ্রমণের পাঠ দিয়ে তাকে এ ব্যাপারে আগ্রহী ও শিক্ষিত করে তোলাটা ছিল পত্রিকার অন্যতম লক্ষ্য। কারণ ব্যক্তিগত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে মনোজ দাস বুঝেছিলেন যে, যতক্ষণ না ভ্রমণকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনা যাবে, ভ্রমণ সহজসাধ্য না হবে ততক্ষণ তা কেবল আর্থিকভাবে সম্পন্ন সমাজের এক সামান্য ভগ্নাংশের কুক্ষিগত হয়ে থাকবে। মনোজবাবু আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলেন ভ্রমণ অফ দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল। সম্পাদকীয়তে উক্ত শেষ উদ্দেশ্য আজকের ভাষায় যাকে বলে হোম স্টে (অর্থাৎ স্থানীয় মানুষের বাড়িতে পর্যটকের থাকা-খাওয়া)— তার ইঙ্গিত বহন করছে। এটা অবশ্যই ভ্রমণ সম্পর্কে সম্পাদকের দূরদৃষ্টির পরিচায়ক।
ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে অর্ধ-শতাব্দীরও আগে মনোজবাবু পর্যটনকে শিল্পের শিরোপা দিতে চেয়েছিলেন। যাতে সামিল হবেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। তিনি বুঝেছিলেন, ভ্রমণকে প্রসারিত করতে হলে একইসঙ্গে তাকে আর্থিকভাবে শক্ত বনিয়াদের ওপর দাঁড় করানোর পাশাপাশি শ্রেণি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের যুক্ত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এতে জাতীয় অর্থনীতিতে ছাপ ফেলতে পারবে ভ্রমণ। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার অভাবজনিত সুরাহা যেমন হবে, তেমনই সরকারও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন শিল্পের পরিকাঠামো উন্নয়নে এগিয়ে আসবে। এমনকি জাতীয় পর্যটন নীতি গ্রহণের কথা ভাবতে বাধ্য করা সম্ভব এভাবেই। এই সার সত্যটুকু বুঝেছিলেন মনোজ দাস। তাই পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছিলেন। দেশি-বিদেশি ভেদাভেদ করেননি। তাছাড়া বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি হলে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়বে বই কী।
কোনও অনুকম্পা, দয়া-দাক্ষিণ্য বা ভর্তুকির বদলে ভ্রমণকে স্বনির্ভর করতে তার শরিক হতে চেয়েছিল ‘ভ্রমণ কাব্য’। ভ্রমণকে ঘিরে আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিল পত্রিকাটি। মননশীল সম্পাদক তাঁর মেধা-মনন-ভাবনা থেকে বুঝেছিলেন যে, কোনও আন্দোলন সফল হতে গেলে আন্দোলনকারীদের সাংস্কৃতিক দিকটি জোরদার হওয়াটা জরুরি। ‘ভ্রমণ কাব্য’ ঠিক এই কাজটাই করতে চেয়েছিল। পত্রিকাকে তাই তিনি ভ্রমণের গাইড বুক করতে চাননি। চেয়েছিলেন লেখাগুলোর সাহিত্যমূল্য বজায় রাখতে। এ সম্পর্কে তাঁর ঘোষিত উদ্দেশ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে তাঁর একান্ত ইচ্ছে ছিল পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা যেন জীবনবোধ সমৃদ্ধ হয় এবং তার মধ্যে একটা দর্শন থাকে। একবার পড়ার পরেও লেখাগুলোর যেন আবেদন থাকে পাঠকের কাছে। লেখায় সাহিত্যরসের উপস্থিতি অনিবার্য মনে করেই সম্ভবত তিনি পত্রিকার নামকরণের ক্ষেত্রে ‘ভ্রমণ’-এর পরে ‘কাব্য’- বসিয়েছিলেন।
‘ভ্রমণ কাব্য’ আক্ষরিক অর্থেই ছিল ভ্রমণবীক্ষার ভ্রূণস্বরূপ। যার ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাবান সম্পাদকের দৃষ্টিভঙ্গি। মনোজবাবু ভ্রমণের পত্রিকার সূত্রে ভ্রমণের যে বয়ান নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তার নেপথ্যে সক্রিয় ছিল সময়-সাহিত্য-ইতিহাসের বয়ানের ভিন্ন রূপ সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি। সেই সময়ে মনোজ দাস ‘স্টোরি ইন দ্য বাস’ শিরোনামে একটি কলাম লিখতেন। সে লেখা প্রকাশিত হত ‘Free lands’ নামে একটি পত্রিকায়। লেখার মধ্যে উঠে আসত বাসের সহযাত্রী, চালক, পরিচালক-সহ নানাজন সম্পর্কে সুগভীর ও দরদী পর্যবেক্ষণ। সেই লেখার পরতে পরিতে মিশে থাকত এক চারণ-লেখকের সমাজসচেতনতা, ইতিহাসবোধ, আর্থ-সামাজিক অনুভব, ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। বস্তুত এই কলাম লেখার সময়েই বাংলায় একটি পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ বা পর্যটন পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা অঙ্কুরিত হয়েছিল তাঁর মনোজগতে। সেই সুচিন্তিত ভাবনারই মার্জিত অপত্য ‘ভ্রমণ কাব্য’।
আটচল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছে ‘ভ্রমণ কাব্য’ প্রকাশ করাটা ছিল সম্পাদকের অনুসন্ধান। এক পাঁড় ভ্রামণিক ও দুর্ধর্ষ মানুষের আত্ম-আবিষ্কারের ফল হিসেবে বাঙালি পেয়েছিল ভ্রমণ বিষয়ক প্রথম পত্রিকা। অর্থাৎ বাঙালির অন্যতম জাতিগত বৈশিষ্ট্য (যা প্রায় জিনগত বলে কথিত) ভ্রমণপ্রিয়তা সামগ্রিকভাবে যা পারেনি, প্রায় একক প্রচেষ্টা ও উদ্যমে তাকে সম্ভব করেছিলেন মনোজ দাস।
পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রবোধ দে-র তোলা সাদা-কালো আলোকচিত্র দিয়ে। তুষারমণ্ডিত কেদারনাথ পাহাড়। সামনে কেদার মন্দির। রেখাচিত্র : শ্রী প্রবীর বিশ্বাস। সোভিয়েত রাশিয়ার ছবিগুলো ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকার সৌজন্যে প্রাপ্ত।
প্রথম সংখ্যার সূচিপত্র কেমন ছিল? লোভ সামলাতে না পেরে পুরোটাই তুলে দিচ্ছি—
কানাডার চিঠি : শীতাংশু মিত্র
কুমারী মন : সুবোধ চক্রবর্তী
ঝিলামের রঙ : মানস কুমার দাস
ইউরোপে যা দেখেছি : অধ্যাপক সুব্রত গুপ্ত
ভ্রমণ কাব্য : ভূতনাথ চট্টোপাধ্যায়
পালামৌ : অনিল কুমার সমাজদার
নায়েগ্রা দর্শন : মনকুমার সেন
ফ্রি পাশ : বিনয়কুমার মুখোপাধ্যায়
দেশে দেশে উড়ে চলি : অমরেন্দ্র দাস
কন্যাকুমারী : প্রবোধ দে
হস্তিনা থেকে হনলুলু : প্রবীর বিশ্বাস
সংবাদ বিচিত্রা
ভারতের চার প্রধান নগরীর দ্রষ্টব্যস্থান
পুরানো বই-এর পরিচয়
এই সংখায় যাঁরা লিখেছেন
প্রায় সবক’টি লেখাই সাহিত্যরসে সিক্ত। এক সৃজনশীল সম্পাদকের কাজে তার পরিচয়ও বটে। ‘ভ্রমণ কাব্য’-র উদ্বোধনী সংখ্যাই যাকে বলে এলাম, দেখলাম আর জয় করলাম। প্রথম সংখ্যার পর থেকি নানা গুণী মানুষ তখন মনোজবাবুর কাছে আসছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র, কুমারেশ ঘোষ, কমলা মুখোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। পত্রিকায় ঘোষিত উদ্দেশ্য সফল করতে শুরু হয়েছে ভ্রমণ সাহিত্য বিষয়ক আড্ডা। প্রতিমাসের শেষ শনিবাসরীয় সন্ধ্যায়। সেখানে স্লাইড শো দেখাচ্ছেন শঙ্কু মহারাজ, করুণাময় দাস প্রমুখ। পত্রিকাকে কেন্দ্র করে এই আড্ডাও সেই সময়ের নিরিখে এক উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ তো অবশ্যই।
‘ভ্রমণ কাব্য’-র দ্বিতীয় সংখ্যায় (জানুয়ারি ১৯৬৮), প্রথম সংখ্যার বিপুল সাফল্য সম্পর্কে সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল : “… এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার দ্বারা যেরূপ সমাদৃত হয়েছে তা যে কোন পত্রিকার পক্ষে এক বিশেষ ঘটনা বলা যেতে পারে।”
‘ভ্রমণ কাব্য’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা (এপ্রিল ১৯৬৮) বেরিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ সংখ্যা হিসেবে। বাংলায় ভ্রমণ পত্রিকার ইতিহাসে এটি এক অমূল্য রত্ন। পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই এর পর্যায় হিসেবে লেখা হয়েছিল— ‘ভ্রমণ বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা’। এই সংখ্যা থেকে এও ছাপা হল : BHRAMAN KAVYA Quarterly Magazine on Tours & Travels।
জুলাই ১৯৬৯ সংখ্যায় (Vol. II No. 4) অবশ্য ‘& Travels’ অংশটুকু ছাপা হয়নি।
এর পর অক্টোবর ১৯৭০ সংখ্যা থেকে ‘ভ্রমণ কাব্য’ হল মাসিক পত্রিকা। এর অন্যতম কারণ ছিল বিপুল পাঠক সমাদর। মাসিক হিসেবে প্রকাশের ঝুঁকি ও আর্থিক দায়ভার বহনের মতো সাহস জুগিয়েছিলেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুণমুগ্ধ অগণিত পাঠক। তিন মাসের বিরহ তাঁদের আর সহ্য হচ্ছিল না।
চতুর্থ বর্ষ, নববর্ষ সংখ্যায় (এপ্রিল-মে ১৯৭১) বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছাপা হল : “অতীব দুঃখের সাথে জানাইতেছি অনিবার্য কারণে এই বৎসর ভ্রমণ কাব্য আর মাত্র শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ করা হইবে। চেষ্টা থাকিবে শারদীয়া সংখ্যা যতটা সম্ভব সমৃদ্ধ করা।” এই সংখ্যায় ‘Magazine on Tours & Travels’ ও ‘Monthly’ ছাপা হল না। ভেতরের পাতায় (পৃষ্ঠা ১১) ছাপা হল : ‘প্রকাশ অন্তর্বর্তী কাল : ষান্মাষিক’।
পূর্বোক্ত সংখ্যাটির সম্পাদকীয় বয়ান থেকে জানা যাচ্ছে যে, পত্রিকার তরফে ভ্রমণ অনুরাগীদের নিয়ে যে সম্মেলনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, অব্যবহিত আগের সংখ্যায় সে বিষয়ে কোনও স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে চলতি বছরের শেষ দিকে তা করার চেষ্টা চলছে। ভেবে দেখুন, সেই সময়ে ভ্রমণ অনুরাগীদের নিয়ে একটি সম্মেলনের কথাও ভেবেছিলেন মনোজ দাস।
মে ১৯৭২ ‘ভ্রমণ কাব্য’-র সম্পাদকীয় বয়ান থেকে জানা যাচ্ছে : “এই সংখ্যাকে বাংলাদেশ বিশেষ সংখ্যা করবার পরিকল্পনা ছিল। কারণ মনে করেছিলাম ইতিমধ্যেই সে দেশ যুদ্ধকালীন ক্ষত সারিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে পারবে। … কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ পরিভ্রমণকারীদের আরও কিছুকাল অপেক্ষা করে সেখানে যাওয়া সমীচীন হবে।”
পত্রিকার জন্য একের পর এক উদ্ভাবনী বৈচিত্র্যে ভরপুর সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন এক সম্পাদক। তাঁর অমানুষিক পরিশ্রমের প্রতিশোধ নিয়েছিল শরীর। আগে থেকেই ছিল ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস। ভুগছিলেন শ্বাসকষ্টে। তার ওপর উদয়াস্ত কায়িক ও মানসিক পরিশ্রম। ১৯৭৪ সালের ৩০ নভেম্বর মাত্র ছাপান্ন বছর বয়সে বাংলার প্রথম ভ্রমণ পত্রিকার এই সম্পাদকের জীবনযাত্রায় দাঁড়ি পড়ল।
মনোজবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সাঙ্গ হল ‘ভ্রমণ কাব্য’-র পথচলাও।
সময় সঞ্চরণশীল। প্রশ্ন জাগে, বাংলা ভাষায় ভ্রমণ পত্রিকা আবির্ভাবের এই বিলম্ব কি তবে ব্যবসায় উদ্যোগী বাঙালির অনীহা এবং ঝুঁকি নেওয়ার ব্যাপারে তার রক্ষণাত্মক মনোভাবের পরিচায়ক? পত্রিকার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ক্ষণটিও দোলাচলে ভরা। পশ্চিমবঙ্গে তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পট পরিবর্তনের সলতে পাকানোর পর্ব চলছে। উত্তাল রাজনৈতিক আবহে ভ্রমণ তখন মোটেই শান্তিকল্যাণ নয়। রীতিমতো বিলাসিতাই বলা চলে। তবে কি সমাজমনের সাংস্কৃতিক প্রতিভাস এই পত্রিকা প্রকাশ?
তৎকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে মনে হয়, ‘ভ্রমণ কাব্য’ বাংলা ভাষায় প্রথম ভ্রমণ পত্রিকা মাত্র নয়। তা হল নতুনভাবে ভাবা, দেখা ও কাজ করার বহিঃপ্রকাশ। পাঠক-লেখককে বাদ দিয়ে কারও ওপর কোনওরকম নির্ভরতার তোয়াক্কা করেনি সে। সম্পাদক একজন প্রগতিশীল, বাগ্মী, সৃজনশীল এবং প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। স্কুলে পড়াকালীন স্থানীয় ধলেশ্বরী নদীতে ডিঙিনৌকায় চড়ে আপনমনে ঘুরে বেড়াতেন। অনেকটা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের মতো। পরবর্তীকালে সারা ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরেছেন নিজের মতো করে। ‘ভ্রমণ কাব্য’ যেন ঠিক এরকম একজন বহুমুখী ও প্রাণবন্ত সারথির অপেক্ষাতেই ছিল।
পত্রিকা প্রকাশের নেপথ্যে থাকা এক অন্তরালবর্তী নীরব কর্মীর কথা এখানে না বললেই নয়। তিনি হলেন মনোজবাবুর স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী। স্কুলে পড়াতেন। সংসারে যাবতীয় দায়-দায়িত্ব একার কাঁধে তুলে নিয়ে স্বামীকে মুক্ত মনে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করবার পরিসর দিয়েছিলেন কোনও কিছুর প্রত্যাশা ছাড়াই।
‘ভ্রমণ কাব্য’-র গুরুত্ব শুধু ঐতিহাসিক নয়। তার অনেক উঁচুতে এর আসন। আজও যে সে ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়ে গেছে তার কারণ হয়তো প্রচারবিমুখ এক সম্পাদকের পাঠকের প্রতি স্বেচ্ছারোপিত দায়বদ্ধতা।
লক্ষণীয়, মনোজ দাসের ছদ্মনামটি— ‘নিঃসঙ্গ বিহারী’। ভ্রমণ পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা মানুষটি তাঁর পত্রিকার মতোই ছিলেন একক!