ভূগর্ভস্থ সঞ্চয়ের ওপর এমন চাপ বাড়ছে যে তথ্য বলছে, মাথাপিছু বিশ্বজুড়ে এই মুহূর্তে মিষ্টি জলের পরিমাণ ২০ শতাংশ করে কমছে। মাটির গভীরে যাওয়ার এবং জল উত্তোলনের যান্ত্রিক সুবিধা যত বেশি বাড়ছে তত বিপদের মুখে পড়ছে পানীয় জলের আধার।
সুদীপকুমার মান্না
মরুভূমিতে উট তেষ্টা মেটাতে খুঁজে নিচ্ছে জলের জার— বিজ্ঞাপনে আমরা দেখছি।
আমরাও বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানের কাজে বা দৈনন্দিন জীবনে জলের জারেই নিশ্চিন্ত বোধ করছি।
বিভিন্ন জগতের বিখ্যাতরা ব্যবহার করছেন ভিন্ন প্রকারের এনার্জেটিক জল— দেখছি, খুঁজছি আমরাও। শেষে হাটবাজার, মুদিখানা, সরাইখানা— যেখান থেকে পাচ্ছি এক বোতল জল কিনে পান করে নিজেরাও সতেজ হচ্ছি।
বাড়িতে বাড়িতে জলের মেশিনে ঘোষিত পরিশ্রুত জল পান করে বেশ নিরাপদ বোধ করছি।
মোদ্দা কথা, পানীয় জল এখন পণ্য— যা কিনতে হয় খরচ করে। বাইরে বা বাড়িতে। জল জীবনের মূল উপদান হলেও বিনামূল্যে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।
এই সমস্ত জলের উৎস ভূগর্ভস্থ জল। মিষ্টি ভৌমজলই পানীয় জলের মুখ্য সঞ্চয়। এই সঞ্চিত জল পুষ্ট হয় মাটির তলায় প্রাকৃতিক জলের প্রবেশের মাধ্যমে। অর্থাৎ বৃষ্টিপাতের ফলে প্রকৃতির জল জলচক্র মেনে নেমে আসে প্রকৃতির বুকে। আর প্রকৃতিই তাকে আপনার করে অন্তস্থ করে নেয় জীবজগতের ধাত্রীর ভূমিকা পালনের জন্য। সভ্যতার আধুনিকতায়, জাগতিক উন্নয়নের শোষণে বিপর্যস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ— এই পরম্পরার কোনও ব্যত্যয় জলের ক্ষেত্রেও ঘটেনি।
পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর সেই জলের মাত্র ৩ শতাংশ মিষ্টি জল। এর মধ্যে প্রায় ৬৮.৭ শতাংশ বরফ হয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে। সুতরাং আর কোনও বিকল্প নেই, এই ভৌমজল সঞ্চয়কে ভরসা করা ছাড়া।
ভূগর্ভস্থ সঞ্চয়ের ওপর এমন চাপ বাড়ছে যে তথ্য বলছে, মাথাপিছু বিশ্বজুড়ে এই মুহূর্তে মিষ্টি জলের পরিমাণ ২০ শতাংশ করে কমছে। মাটির গভীরে যাওয়ার এবং জল উত্তোলনের যান্ত্রিক সুবিধা যত বেশি বাড়ছে তত বিপদের মুখে পড়ছে পানীয় জলের আধার। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম জল উত্তোলক দেশ হিসাবেই পরিগণিত হয় তীব্র জল-চাহিদার কারণে। সারা বিশ্বের প্রায় ১৬ শতাংশ জনসংখ্যা এই দেশে কিন্তু স্বাদু জল সম্পদের মাত্র ৪ শতাংশ এখানে। তীব্র জলসংকটে আক্রান্ত হয়ে উঠবে এই দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে— এইরকম আশঙ্কা গবেষকদের। এই বিপদ কাটানোর মূল যে পথ ছিল, অর্থাৎ ভূগর্ভে জলের প্রবেশ— আমরা সেই চিরন্তন প্রক্রিয়ার প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছি আরামদায়ক জীবনধারণ ব্যবস্থার দাসানুদাস হয়ে।
আমাদের জীবনধারণ পদ্ধতিতে তথাকথিত ভাল থাকার জন্য আমরা ঢেকে দিচ্ছি ভূপৃষ্ঠকে কংক্রিট বা পিচের চাদরে। বড় রাস্তাঘাট বাড়ছে, চওড়া হচ্ছে জীবনের গতির দ্রুততার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ছোট রাস্তা থেকে গলিপথ, বাড়ির উঠোন থেকে খোলা প্রাঙ্গণ ঢাকছে কংক্রিটের আস্তরণে। মাটিতে পা তো দূরে থাক, জুতোতে মাটি লাগাতেও রাজি নয় দুনিয়া। ফলে চাহিদা অনুযায়ী ঢাকছে মাটি।
প্রকৃতির নিজস্বতা অনুয়ায়ী বৃষ্টিপাতের জল মৃত্তিকার রন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করে ভূগর্ভে। স্তরের পর স্তরে পরিশ্রুত হতে হতে ভূ-উপাদানে পুষ্ট হয়ে রূপান্তরিত ভৌমজল সঞ্চিত হয় মিষ্টি পানীয় জল হিসেবে। মানবসভ্যতা পুরোপুরিই প্রায় নির্ভরশীল এই আধারের ওপরেই। সাধারণভাবে বাড়িতে ব্যবহার্য থেকে ব্যবসার জন্য পর্যন্ত আর অন্য কোনও উৎস নেই। সরকারিভাবে ব্যবস্থা করা জল বিতরণ কেন্দ্র এবং বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহ উদ্যোগের ভরসা এই ভূগর্ভস্থ জলই। নদীর জল পরিশোধন করে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে কিন্তু নদীতে যখন জল কমে তখন বর্ষায় জমানো ভূ-অভ্যন্তরস্থ জলই নদীবক্ষে ফিরতে থাকে মাটির মধ্যেকার শিরা-উপশিরা দিয়ে। এই জল নদী নিজের জন্যই জমা করে রাখে বর্ষায় তার দু-কূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।
বড় বড় কোম্পানি থেকে বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হওয়া জল ব্যবসার জন্য উত্তোলিত লাগামছাড়া জল নিয়ে আমরা একপ্রকার উদাসীনই। গ্রামের বা পাড়ার তৈরি জলপাত্রের জলের গুণাগুণ তো পরের ব্যাপার, উত্তোলিত জলের পর পুনঃসঞ্চয়ের জন্য বড় জলাধার তৈরির মাধ্যমে বৃষ্টি-জল সঞ্চয়ের পরিবেশগত দাবি লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং এই সংক্রান্ত প্রশাসনিক বিধি ভঙ্গ হচ্ছে সমাজ এবং প্রশাসনের সার্বিক নিস্পৃহতায়।
বৃষ্টির জল কংক্রিট ভেদ করে প্রবেশ করতে পারে না ভূগর্ভে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক জলসঞ্চয় শৈলী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে এর ফলে। ভূপতিত জলরাশি কংক্রিটের তল বয়ে প্রবাহিত হয় নিকাশি ব্যবস্থার মধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নদীতে। সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলে বর্জ্য প্লাস্টিক-সহ জলজ বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক প্রভূত পদার্থকে। যে জল প্রবিষ্ট হয়ে সঞ্চিত হওয়ার কথা ছিল ভূ-আধারে, তা প্রবাহিত নদীপথে স্রোত হয়ে বয়ে চলে যায়। ভৌমজলের সঞ্চয় কমতেই থাকে। এছাড়া পিচ বা কংক্রিট আস্তরণহীন মাটির বহুলাংশই আক্রান্ত প্লাস্টিক-সহ তথাকথিত উন্নত সভ্যতাজাত কঠিন বর্জ্যে— যা বাধা হয় ভূ-অভ্যন্তরে জলের প্রবেশে।
প্রথাগত খাল-বিলগুলি হয় বহুলাংশেই মজে গেছে, বর্জ্য স্তূপ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে, আর না হয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য নিচু এলাকার চিত্রই একই। এলাকার জলাশয়গুলি হারিয়ে যাচ্ছে, অবৈধভাবে বুজিয়ে দখল হচ্ছে। ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে আর কোনও উপায় থাকছে না অব্যবহৃত ভূমি ব্যবহার ছাড়া। প্রগতির স্মারক হিসেবে এগুলোতে গড়ে উঠছে ইমারত, কারখানা। দাবি থাকছে কর্মসংস্থানের। কিন্তু প্রকৃতি বান্ধব হওয়ার, পরিবেশ নীতি মানার আশু প্রয়োজনীয়তাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে— অসচেতনতার এবং দায়িত্বহীনতার চূড়ান্ত নিদর্শন হিসেবে যা উপস্থাপিত। ভূপৃষ্ঠে অনুভূমিক বিস্তারের ক্ষেত্রে পরিমার্জন এবং রূপান্তরের জন্য সচেষ্ট হওয়ার সময় অনেক দিন হল এসে গেলেও তার বিকল্পের সন্ধান নেই এখনও। ফলে অন্যান্য ক্ষতির চলমানতার সঙ্গে এই মুহূর্তে তীব্রভাবে বেগবান সভ্যতার ভৌমজল সংকট।
কীভাবে পাল্টাচ্ছে এলাকার ভূগর্ভস্থ জলের গভীরতা? এই ম্যাপিং এবং তথ্যভাণ্ডার সরকারিভাবে প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয়তা সময়ের দাবি হয়ে উঠছে। যেকোনও প্রকল্পের পরিকল্পনার জন্য এই তথ্য বিশ্লেষণ পূর্বশর্ত হওয়া উচিত। জল উত্তোলন নীতি এলাকাভিত্তিক প্রস্তুত করে এগোতে হবে আগামীর পথে। ভূপৃষ্ঠে জল প্রবেশের জন্য ছোট থেকে বড়— সমস্ত ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিতে হবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। প্রাকৃতিক এবং প্রথাগত জল সঞ্চয় ব্যবস্থা এবং পরিকাঠামোর সংস্কার আর রক্ষায় শৈথিল্য মানেই সংকটের মাত্রা বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা।
ভূগর্ভস্থ জলই প্রায় ৪৩ শতাংশ সরবরাহিত হয় সেচের কাজে (২০২১ -এ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ভারতের ক্ষেত্রে যা প্রায় ৯০ শতাংশ)। সার ও বীজ-সহ পরিপূরক কাঠামোর সুবিধায় কৃষির প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জল ব্যবহার নীতি নিয়ে পরিকল্পনা বা নিয়ন্ত্রণের ভাবনা খাদ্যের প্রয়োজনীয়তার আবহে চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিপদ বাড়ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। এটাই বাস্তবতা। মিষ্টি জল সঞ্চয়ের এই হ্রাসের ফলে কৃষিক্ষেত্রে UNEP সম্ভাব্য কিছু বিপদকে চিহ্নিত করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। সেগুলো হল— খরা ও শুষ্ককরণ, লবণাক্ত জলের অনুপ্রবেশ, দূষণ এবং ভূমিক্ষয়। ভূগর্ভস্থ জল তোলার জন্য যত গভীর থেকে গভীরতর সঞ্চয়ে আমরা হানা দিচ্ছি— তার সঙ্গে তুলে আনা লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে ভূপৃষ্ঠে; তার সঙ্গে বাড়ছে আর্সেনিক, ফ্লুরাইড আক্রান্ত রোগ।
সুতরাং গোকুলে নয়, বেড়ে উঠে যে বধিবে সে আবির্ভূত হচ্ছে প্রকাশ্যেই।
“মিহি মাদুরে দিয়ে ঢাকো/ফরাশ পাতি করিব ধূলা বন্ধ”— কবিতার রাজা যা চেয়েছিল সেই ব্যবস্থা তো সম্ভব হয়নি, ফলে চোখ বন্ধ করে প্রলয় রোখা যাবে না।
পানীয় এবং খাদ্য— দুইয়েরই সংকট বাড়ছে। ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্ত বিপদের আস্তরণকে ভেদ করে নিজেদের পরিত্রাণের রক্ষাকবচকে সুরক্ষিত রাখার দায় কিন্তু আমাদেরই।