বরের গাড়ি ঢুকতেই বড়বউদি সবার আগে ভারী বরণডালা নিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। সামনে আলোর ফোকাস ফেলে ভিডিও করছে একজন। বউদি একটু এগোচ্ছে আর ফটোগ্রাফার বলছে, “দাঁড়ান, দাঁড়ান। আর একটু আস্তে হাঁটুন।”
কাকলি দেবনাথ
“লীনা, এই লীনা। তাড়াতাড়ি ওঠ। এক্ষুনি কাক ডাকতে শুরু করবে।”
ঘুম ভেঙে লীনা ঠিক বুঝতে পারছে না সে এখন কোথায়। একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেল। কাল সন্ধেবেলায় দেশের বাড়িতে এসেছে। বড়দার একমাত্র মেয়ের বিয়ে। এত ভোরেও সারা বাড়ি গমগম করছে। জ্যাঠতুতো, পিসতুতো ভাইবোন, দাদা-বউদিদের হাসিঠাট্টার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। টুকরো টুকরো ভালবাসার স্পন্দনগুলিকে জড়িয়ে ধরে আরও খানিকক্ষণ শুয়ে রইল সে। মনের ভেতরে তিরতির করে বয়ে চলেছে একটা নদী যার প্রতিটি বাঁকে কত স্মৃতি উঁকি দিয়ে যাচ্ছে।
“কী রে, এখনও উঠিসনি?” বলে ছোটবউদি ঠান্ডা হাত লেপের ভেতরে ঢুকিয়ে লীনার গালের ওপর চেপে ধরল।
“ওরে বাবা, কী ঠান্ডা!” বলে লীনা যেই লেপটাকে জড়িয়ে ধরতে গেল, খুড়তুতো জামাইবাবু হাসতে হাসতে পায়ের নীচে থেকে লেপটাকে টেনে নামিয়ে দিল। জ্যাঠতুতো বড়দি এসে বলল, “ওঠ ওঠ। আর দেরি করিস না। পুকুর থেকে জল ভরে আনতে হবে।”
এ বাড়ির এটাই নিয়ম। কাকভোরে বাড়ির জামাইকে ডুব দিয়ে ঘটে জল ভরতে হয়। না, আর শুয়ে থাকা যাবে না। চটপট উঠে হাত মুখ ধুয়ে নিল লীনা। ভাল একটা শাড়ি পরল। গায়ে শাল জড়াল। বেশ কনকনে ঠান্ডা বাইরে। আগের দিন সন্ধেবেলাতেই কুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন সবাই ঘট ভরতে যাওয়ার জন্য তৈরি। কিন্তু ক্যামেরাম্যান এসে পৌঁছয়নি। বড়দা গজগজ করছে, “এতগুলো টাকা অ্যাডভান্স নিল। তবুও সময়মতো আসার নাম নেই।”
এদিকে অমৃতযোগ পেরিয়ে যাচ্ছে বলে মা রেগে যাচ্ছে। বেশ কয়েক বার ফোন করা হল ক্যামেরাম্যানকে। এইরকম সময় মুঠোফোনই ভরসা। কিন্তু ফোন ধরল না। কী আর করা।
বড়বউদি কুলো নিয়ে সবার আগে আগে যাচ্ছে। তার পরে সুব্রত, লীনার বর। হাতে আম্রপল্লব দেওয়া ঘট। বাকি সবাই ওদের পিছনে।
ভোরের একটা নিজস্ব রূপ থাকে। সেই রূপ দেখে মনে হয়, কোনও কিশোরী রাজকুমারী যেন আড়মোড়া ভেঙে তার পদ্মফুলের পাপড়ির মতো আঁখিপল্লব একটু একটু করে প্রষ্ফুটিত করছে। পাশের ধানখেত থেকে নতুন পাকা ধানের মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে। কুয়াশা ঘেরা নরম ভোরে রাস্তার লাইটপোস্টগুলোকে মনে হচ্ছে রূপকথার দৈত্য। যেন সদ্য ঘুমভাঙা রাজকুমারীর সৌন্দর্য লুট করতে এসেছে।
উলুধ্বনি আর শঙ্খ বাজিয়ে ওরা পুকুরঘাটের দিকে এগিয়ে চলল। পুকুরপাড়ে এসে বড়বউদি কুলোটা নামিয়ে রেখে বলল, “আমি আগে নিয়মগুলো করে নিই। তার পর ছোটজামাই ঘট ভরে জল তুলে আনবে।” ভোরের আবছা আলোয় সুব্রতর মুখ ভাল করে দেখা না গেলেও লীনা বুঝতে পারছে, সুব্রত বিরক্ত চোখে লীনার দিকেই তাকিয়ে আছে। আগেই বলেছিল, এত ঠান্ডায় সে কিছুতেই জলে নামবে না। লীনা বুঝতে পারছে না কী করবে। সুব্রত যদি পুকুরে না নামে, সবাই কী ভাববে! হয়তো বলবে, লীনার বরটা বড্ড অহংকারী। এমন সময় বড়দি বলল, “এত ঠান্ডায় সুব্রতকে আর জলে নামতে হবে না। পাড়ে দাঁড়িয়ে মাথায় জলের ছিটে দিয়ে ঘট ভরে নিলেই হবে।“
সুব্রত যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল । “থ্যাঙ্ক ইউ বড়দি।” বলে তাড়াতাড়ি পুকুরঘাটের শেষ সিঁড়িতে নেমে জল ভরে আনল।
জল নিয়ে ঘরে ঢুকতেই মা বলল, “আর দেরি করিস না। চটপট মেয়েটার নান্দীমুখের কাজটা সেরে নে।”
দাদার মেয়ে তনু আদুরে গলায় বলে উঠল, “ইস, এত সকালে আমি দই-চিঁড়ে খেতে পারব না।”
“আরে, নিয়মরক্ষার জন্য একটু মুখে দিবি। সবটা খেতে হবে না। এখন তো আর আমাদের দিনের মতো উপোস থাকতে হয় না। দুপুরে তোর জন্য নিরামিষ রান্না হবে।”
একটা থালায় দই-চিঁড়ে, খই, মিষ্টি সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে তনুকে। ওকে ঘিরে বসেছে সব ভাই-বোনেরা। পটাপট মুঠোফোনে বন্দি হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি খুনসুটির মুহূর্ত।
আজকাল বিয়েবাড়িতে বাড়ির মহিলাদের তেমন কোনও কাজ থাকে না। সবই প্যাকেজ সিস্টেম। লীনা দেখেছে তাদের সময়ে জেঠিমা কাকিমা, পিসিমারা সারাদিন রান্নাঘরে জলখাবার আর চা করতেই ব্যস্ত থাকত। রাঁধুনি বামুন শুধু দুপুরের আর রাতের রান্না করত। এখন তো জলখাবারও প্যান্ডেলে বসিয়ে খাওয়ানো হয়।
জলখাবার যেখানে খাওয়ানো হচ্ছে সেখানে জায়েন্ট স্ক্রিনে চালানো হয়েছে তনুর প্রি-ওয়েডিং শ্যুটিংয়ের সিডি। উফ, কী অসাধারণ উঠেছে ছবিগুলো। তনু এমনিতে দেখতে খারাপ নয়। তবে ছবিতে একেবারে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার মডেলদের মতো দেখাচ্ছে। আরে, তনুর বরেরও ছবি আছে। এ বাবা! ওরা বিয়ের আগেই এতটা ঘনিষ্ট হয়ে ছবি তুলেছে! তাও আবার এইসব ছবি সবার সামনে দেখানো হচ্ছে! লীনার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ গুঞ্জন উঠল, “ক্যামেরাম্যান এসে গেছে, ক্যামেরাম্যান এসে গেছে।” বিয়েবাড়ি জুড়ে যেন সাজ সাজ রব পড়ে গেল।
এবার শুরু হবে গায়ে হলুদের পর্ব। তনুর মাথার টিকলি থেকে বাজুবন্ধ, চূড় সবই হলুদ ভেলভেটের ফুলের। কত রকমের হলুদের শেড। ছেলেরা পরেছে হলুদ পাঞ্জাবি, মেয়েরা হলুদ শাড়ি। দূরে হলুদ সরষে ফুলের খেত। সব মিলিয়ে এক অপূর্ব কোলাজ।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া মিটলে লীনা আর তনু চিলেকোঠার ঘরটায় গিয়ে বসল। এখানে নিশ্চিন্তে একটু বিশ্রাম নেওয়া যাবে। শোওয়ার আগে তনু বলল, “পিসিমণি, তুমি আমার বিয়ের শাড়ি দেখেছ?”
“না রে। সময় পেলাম কই!”
“দাঁড়াও, দেখাচ্ছি। ডিজাইনার শাড়ি। এখানকার সবচেয়ে নামকরা বুটিক থেকে কিনেছি।” বলে আলমারি থেকে সাদা রঙের একটা দামি শাড়ি বের করল। শাড়িটা লীনার কোলের ওপর দিয়ে খুশি খুশি মুখে চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন? ভাল হয়েছে না?”
লীনা অবাক হয়ে বলল, “এ বাবা, বিয়েতে সাদা শাড়ি কেউ পরে?”
“সাদা কোথায়? এটা তো অফ হোয়াইট। তাছাড়া হালকা গোলাপি রঙের সুতোর কাজ আছে তো। তুমি আমাদের বিয়ের কালার থিম জান না? কার্ডে লিখে দিয়েছিলাম তো! অফ হোয়াইট।”
“অ্যাঁ, বিয়েতে আবার কালার থিম আছে না কি?” লীনা চোখ বড় বড় করে বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইল।
“হ্যাঁ। তুমি কী কালারের শাড়ি এনেছ?”
“নীল রঙের।”
লীনার কথা শুনে তনু আঁতকে উঠল। “কী বলছ তুমি পিসিমণি? না না, চলবে না। তুমি শিগিগির একটা অফ হোয়াইটের শাড়ি কিনে আনো প্লিজ। বিচ্ছিরি উঠবে ফটোগুলো। আমার পুরো প্ল্যান মাঠে মারা যাবে।”
লীনার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। এই অল্প সময়ে বিয়েবাড়িতে পড়ার মতো অফ হোয়াইট শাড়ি কোথায় পাবে সে?
তনু ততক্ষণে আশেপাশের বুটিকগুলোতে ফোন করতে শুরু করে দিয়েছে। বাড়ির মহিলামহলের সবার কানে কথাটা পৌঁছে গেছে। সবার মুখেই এক কথা— “নিমন্ত্রণপত্রে লেখা ছিল তো!”
লীনার নিজেকে বড্ড ব্যাকডেটেড লাগছে। নিমন্ত্রণপত্র তো সেভাবে পড়েই দেখেনি সে। শুধু ওপরের কভারটা দেখেছে। নিজের ওপর নিজেরই রাগ হচ্ছে। এমন সময় মুশকিল আসান করল লীনার মা। গতবছর বেনারস থেকে লীনা মায়ের জন্য একটা অফ হোয়াইট বেনারসি এনেছিল। সেটাই বের করে দিল। লীনার মুখেও হাসি ফুটল। মনে মনে বলল, ভাগ্যিস সুব্রতর শেরওয়ানিটা ক্রিম কালারের কেনা হয়েছিল
২
বিকেল থেকেই সাজ সাজ রব। বিউটি পার্লার থেকে কনে সাজাতে লোক চলে এসেছে। তিল তিল করে সাজিয়ে তনুকে এবার তিলোত্তমা করে তুলবে ওরা। বাড়ির মেয়ে-বউরা সব পার্লারে চলে গেছে। পার্লারে সাজতে যেতে লীনারও খুব ইচ্ছে করছিল কিন্তু কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগল। ভাবল, পিসিশাশুড়ি হয়ে পার্লারে সাজতে গেলে লোকে যদি কিছু বলে!
সন্ধে হতেই বরযাত্রীরা সব চলে এসেছে। বাড়ির বউরা কেউ উলুধ্বনি দিচ্ছে, কেউ শঙ্খ বাজাচ্ছে, অল্পবয়েসি মেয়েরা বরযাত্রীদের গোলাপফুল আর আতর দেওয়ার জন্য গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বরের গাড়ি ঢুকতেই বড়বউদি সবার আগে ভারী বরণডালা নিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। সামনে আলোর ফোকাস ফেলে ভিডিও করছে একজন। বউদি একটু এগোচ্ছে আর ফটোগ্রাফার বলছে, “দাঁড়ান, দাঁড়ান। আর একটু আস্তে হাঁটুন।” বরের গাড়ির সামনে এসেও বেচারি জামাই বরণ করতে পারছে না। ক্যামেরাম্যান এখনও অনুমতি দেয়নি। তারা এখন গাড়ির ভেতরে বরের ছবি তুলতে ব্যস্ত।
“নিন, এবার শুরু করুন।” বলতেই বউদি যেই কুলোটা বরের কপালে ঠেকাতে যাবে অমনি ছেলেটা বলল, “না না, ওভাবে নয়। এইভাবে, কোনাকুনি করে ধরুন। তাহলে দু’জনের মুখই ফ্রেমে আসবে।”
সবাই কলের পুতুলের মতো ওদের পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। নিজের সেরা পারফরমেন্স দেওয়ার চেষ্টা করছে। বর বেচারা পাক্কা পাঁচ মিনিট রসগোল্লার চামচের সামনে মুখ হাঁ করে বসে রইল। ফটোগ্রাফার কিছুতেই তাকে “নিন এবার খান” বলছে না।
এ বাড়ির নিয়ম হল রাস্তা থেকে বরকে কোলে করে ছাদনাতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। লীনার মনে আছে সুব্রতকেও এভাবেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে এক মজার দৃশ্য। গ্রামের স্বাস্থ্যবান ছেলেদের আগে থেকেই বলা থাকত। কিন্তু তনুর বরকে কোলে তুলতে কেউ রাজি হচ্ছে না। অথচ বিয়েবাড়িতে উপস্থিত যুবকদের প্রায় প্রত্যেকেরই নিয়মিত জিমে যাওয়া স্বাস্থ্য। লীনা শুনতে পেল, ভিড়ের মধ্যে একজন বলছে , “ধ্যুৎ, আমি কোলে তুলতে পারব না। আমার এত সুন্দর শেরওয়ানিটার বারোটা বেজে যাবে।”
৩
বিয়ে শুরু হয়ে গেছে। চারদিকে বলিউডের নায়িকাদের মতো সুন্দর মেকআপ করা মুখের ভিড়। নিজেদের বাড়ির ছেলেমেয়েদেরই ঠিকমতো চেনা যাচ্ছে না। লীনা ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। গ্রামের বিয়েতেও কী সুন্দর প্যান্ডেল হয় এখন! দূরদর্শনের ধারাবাহিকগুলোর অনুকরণে সাজানো হয়েছে ছাদনাতলা। তার বিয়ের সময় শুধুমাত্র চারদিকে কলা গাছ পুতে, গাঁদাফুলের মালা দিয়ে ছাদনাতলা সাজানো হয়েছিল। এখন সারা প্যান্ডেল জুড়ে অপূর্ব সব কারুকাজ। সান্ধ্যকালীন টিফিনের জন্য অনেক রকমের স্টল বসেছে। ভেজ-ননভেজ পকোড়া, ফুচকা, কাবাব, কুলফি, কফি, আরও কত লোভনীয় খাওয়ার। এখন আর আগেকার দিনের মতো প্যাকেটের ব্যাবস্থা নেই। যে যার নিজের ইচ্ছেমতো খাবার তুলে নাও। বরযাত্রীরা এসেই সব স্টলের সামনে ভিড় করেছে। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে লীনার চোখ গেল ফুচকার স্টলের দিকে।
“আরে, পুরুতঠাকুর না? এরমধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল!”
পুরুতঠাকুর বড় একটা হাঁ করে ফুচকা মুখে পুরেছেন তখন। লীনাকে দেখে একটু যেন ঘাবড়ে গেলেন। কোনওরকমে মুখ বন্ধ করে, চোখ বড় বড় করে “উঁ উঁ” করে কী যে বললেন, বোঝা গেল না।
লীনা তাড়াতাড়ি বলল, “আগে খেয়ে নিন। তার পর কথা বলবেন।”
কোঁত করে তেঁতুলগোলা জল সমেত ফুচকা পেটে চালান দিয়ে ঠাকুর শাই বললেন, “এই সবে মালাবদল হল। এখন ফটোগ্রাফার ছেলেগুলো নানারকম কায়দা করে ফটো তুলবে। অনেক সময় লাগবে। তাই ভাবলাম এই ফাঁকে একটু… আমি তো চা খাই না, তাই… ” বলে লজ্জা লজ্জা মুখ করে আর একটা ফুচকা মুখের ভেতরে চালান করলেন।
লীনারও খিদে খিদে পেয়েছে। একবার কাবাবের লাইনের দিকে তাকাল। বিশাল ভিড় সেখানে। চারদিকে পরিচিত খুশিভরা উজ্জ্বল মুখ। পায়ে পায়ে গিয়ে কফি স্টলের সামনে দাঁড়াল। এক কাপ কফি নিয়ে একটা চেয়ারে এসে বসল। এখান থেকে ছাদনাতলা দেখা যাচ্ছে। সিঁদুরদান হচ্ছে। সিঁথিতে সিঁদুর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তনুর মুখটা আরও যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হোমের স্বর্ণাভ আলোর ছটায় বড় মায়াময় লাগছে মেয়েটাকে। লীনার মনে হল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাজপোশাকের কত পরিবর্তন হয় কিন্তু কিছু সৌন্দর্য চিরন্তন।
আরে, ওখানে কী হচ্ছে? এত ভিড় কীসের? লীনা ভিড়ের মধ্যে উঁকি মেরে দেখল, বাড়ির যত অল্পবয়েসি মেয়ে-বউ আছে, সব এক এক করে নিজেদের স্বামীকে নিয়ে তনুর সিংহাসনটায় বসছে আর মুঠোফোনে নিজেদের বন্দি করছে। লীনারও মনের কোণে ইচ্ছেবুড়ি উঁকি মারল। তাদের সময়ে কনে বসানোর জন্য এত সুন্দর সিংহাসন ছিল না। খাটেই বসানো হত। একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে সুব্রতকে খুঁজল। পরমুহূর্তে ইচ্ছেটাকে দমন করল।
৪
“হ্যাঁ রে বড়দা, শ্বশুরবাড়ি কখন যাবে তনু?” লীনা জিজ্ঞেস করল।
“পাঁচ মিনিটের তো রাস্তা। বিকেলের দিকে বের হলেই হবে।”
তনু নিজেই পছন্দ করেছে পাশের পাড়ার ছেলেকে। সাধারণত মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার দিন কনের বাড়িতে একটা দুঃখের পরিবেশ থাকে। এ বাড়িতে কিন্তু সেটা নেই। সবাই বেশ হাসিখুশি। লীনার মনে আছে, তার বিয়ের এক মাস আগে থেকে কান্নাকাটি শুরু হয়েছিল। পিসির বাড়ি, কাকুর বাড়ি, মামার বাড়ি যেখানেই লীনা আইবুড়ো ভাত খেতে গেছে সেখানেই গিয়েই কেঁদেছে। সবসময় যে অন্তর থেকে কান্না পেয়েছে তা নয়। কাঁদতে হয়, তা না হলে লোকে বলবে, মেয়েটা কী নির্লজ্জ! এই ভেবে কেঁদেছে।
তনুর ব্যাগ গোছাতে গোছাতে লীনা জানতে চাইল, “তোকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে কখন লোক আসবে?”
“আজ আসবে না পিসি।”
“তাহলে! কে সাজাবে তোকে?”
“আমি নিজেই সেজে নেব।”
তনুর কথা শুনে লীনা অবাক। তাদের সময় তো শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় মেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যেত। আর এ মেয়ে বলছে নিজেই সেজে নেবে!
বিকেলবেলা সত্যি সত্যিই তনু নিজেই সেজেগুজে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি। সবাইকে বার বার বলে রেখেছে, “কেউ কান্নাকাটি করবে না কিন্তু…। আমার সব সাজ নষ্ট হয়ে যাবে।”
দাদা-বউদির মুখ দেখে মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে একটু কষ্ট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কান্নাকাটির ব্যাপার নেই। লীনা ভাবল, পাশের পাড়ায় বিয়ে হচ্ছে বলেই হয়তো।
ঠাকুরঘরে বর-কনেকে পিঁড়িতে বসিয়ে কিছু নিয়ম সারা হচ্ছে। বাড়ির বড়রা এক এক করে মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করছে। এবার বড়দার পালা। মা পাশে দাঁড়িয়ে বড়দাকে বলল, “তনুর হাতটা জামাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বল, আজ থেকে আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিলাম।”
লীনা দেখছে, বড়দার ঠোঁট কাঁপছে। পুরো কথাটা বলার আগেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। সুব্রত এসে তাড়াতাড়ি বড়দাকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
বউদি তনুকে কোলে নিয়ে বসেছে। মায়ের কোল থেকে কনেকে নিয়ে যাবে বরপক্ষ। এতক্ষণের চেপে রাখা কান্না বুকফাটা আর্তনাদ হয়ে বেরিয়ে এল। বউদির অমন কান্না দেখে বাড়ির সবার চোখে জল। লীনা তনুর দিকে তাকিয়ে দেখল, তনু ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে।
এবার তনুকে কনকাঞ্জলি দিতে হবে। পিছন ফিরে মায়ের আঁচলে চাল ছুড়ে বলতে হবে,-তোমাদের সব ঋণ আমি শোধ করে গেলাম। তনুর দু’চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা। সব সাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। দৃঢ় স্বরে বলল, “না, এ কথা আমি কিছুতেই বলব না।”
লীনা এগিয়ে গিয়ে বলল, “অবাধ্য হস না তনু, এটাই নিয়ম।”
“এইসব ফালতু নিয়ম আমি মানি না পিসিমণি।”
“ইস, এত রাগ করিস না। তোর এমন রাগী রাগী মুখের ছবি উঠছে। বিচ্ছিরি হয়ে যাচ্ছে ভিডিওটা।”
“দরকার নেই আমার ভাল ভিডিওর। এভাবে বাবা-মায়ের ঋণ শোধ করা যায় না কি?” বলে দু’চোখ ভরা জল নিয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে তনু এগিয়ে চলল ফুল সাজানো গাড়িটার দিকে।
ক্যামেরা চলছে। চারদিকে তখন শুধু ঝাপসা চোখের জলছবি। কারও আর খেয়াল নেই, ছবি উঠছে। ক্যামারাম্যান ছেলেটার মুখেও কোনও কথা নেই। এককোণে দাঁড়িয়ে, মুখ কালো করে সে শুধু শাটার টিপে যাচ্ছে।
গল্পটা বেশ ভালো লাগলো। অনেক অনেক শুভেচ্ছা।