উৎসুক পাঠকের কাছে গালিবের শায়েরির বঙ্গানুবাদের চাহিদা আছে কিন্তু সেরকম অনুবাদ গ্রন্থ নেহাতই কম। শায়েরির অনুবাদ ব্যতিরেকে বাংলায় গালিব-চর্চা বিষয়ক গদ্য গ্রন্থ প্রায় নেই বললেই চলে। সেদিক থেকে কমল সরকারের ‘মুঘল অস্তরাগের কবি মির্জা গালিব’ গ্রন্থটি দীক্ষিত পাঠকের কাছে এক পরম প্রাপ্তি।
অনুপম মুখোপাধ্যায়
উর্দু সাহিত্যে শুধু ভারত বা পাকিস্তানের মতো উপমহাদেশে নয়, গোটা বিশ্বেই মির্জা গালিবের জনপ্রিয়তা শীর্ষে থাকার কারণেই জনমানসে তাঁকে নিয়ে কৌতূহলের সীমা-পরিসীমা নেই। গালিব তাঁর দিনলিপি ‘দাস্তাম্বু’-তে নিজের সম্পর্কে এক জায়গায় মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি বেঁচে থাকতে তার গুণকে কেউ স্বীকৃতি না দিলেও পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে মনে রাখবে, তাঁকে স্বীকৃতি দেবে। ইতিহাস এই উক্তির সত্যতা প্রমাণ করেছে। উর্দু কবিদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে চর্চা অন্তহীন।
বাংলায় গালিবকে নিয়ে চর্চা একেবারে হয়নি এমনটা বলা যাবে না কিন্তু সেইসব চর্চায় তাঁর শায়েরির অনুবাদই প্রাধান্য পেয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার যে, বাংলার সঙ্গে গালিবের একটা যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল তাঁর পূর্বসূরিদের সরকারি পেনশন আদায় করার চেষ্টায় কলকাতায় তৎকালীন জেনারেল মেটকাফের সঙ্গে দেখা করার সময়। সে সময় তিনি কিছুদিনের জন্যে কলকাতায় এসেছিলেন (১৮২৮)। সেই সূত্রে কলকাতার একটি রাস্তার নামও মির্জা গালিব স্ট্রিট।
কিছুদিন আগে ‘সাংস্কৃতিক খবর’ কাজল চক্রবর্তীর একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। সেই গ্রন্থটির নামও ‘মির্জা গালিব স্ট্রিট’। গালিবের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা ছাড়াও তিরিশটি শায়েরির অনুবাদ তিনি গ্রন্থিত করেছেন। যতদূর জানা যায়, প্রায় দু’হাজার শায়েরি নির্মাণ করেছেন মির্জা গালিব। বেশ কিছু গজলও রচনা করেছিলেন। এছাড়াও অতি ঝরঝরে মনকাড়া গদ্যে লিখেছিলেন দিনলিপি— ‘দাস্তাম্বু’।
উৎসুক পাঠকের কাছে গালিবের শায়েরির বঙ্গানুবাদের চাহিদা আছে কিন্তু সেরকম অনুবাদ গ্রন্থ নেহাতই কম। শায়েরির অনুবাদ ব্যতিরেকে বাংলায় গালিব-চর্চা বিষয়ক গদ্য গ্রন্থ প্রায় নেই বললেই চলে। সেদিক থেকে কমল সরকারের ‘মুঘল অস্তরাগের কবি মির্জা গালিব’ গ্রন্থটি দীক্ষিত পাঠকের কাছে এক পরম প্রাপ্তি। ভারতের ইতিহাসের একটি অচর্চিত অধ্যায়কে তিনি ধরেছেন গালিবের মতো ক্ষণজন্মা কবির জীবনেতিহাসকে তুলে ধরে। অথবা এ কথাও বলা যায় যে, গালিবের জীবন ও সৃষ্টিকে তিনি অন্য ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলেছেন মুঘল যুগের শেষ দেড়শো বছরের ইতিহাসকে খনন করে। গ্রন্থটি সে কারণেই ব্যতিক্রমী ও অভিনবত্বের দাবি রাখে।
গ্রন্থটির নিবিষ্ট পাঠে পাঠক জানতে পারবেন অওরঙ্গজেবের পতনের পরেও আরও দেড়শো বছরের তৈমুর বংশের উত্থান-পতনের ইতিহাস। তৈমুর বংশের সেই দেড়শো বছরের শেষ পর্যায়ের কবি মির্জা গালিব। বলা যেতে পারে, ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ ও ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে উর্দু ও ফার্সি ভাষার কবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। কমল সরকারের গ্রন্থটি বহু অজানা, অচর্চিত বিষয়কে বেশ ঝরঝরে গদ্যে ও খানিকটা কাব্যিক সুষমায় পাঠক-পাঠিকাদের মুগ্ধতাবোধে আচ্ছন্ন করবে এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়।
কবি মির্জা গালিবের জীবন ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা, নানা বিড়ম্বনা ও তাঁর সৃজনকর্মের খুঁটিনাটি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। মনোযোগী পাঠকের কাছে মুঘল যুগের শেষ দেড়শো বছরের দিল্লি শহরের জনজীবন, সংস্কৃতি ও সামাজিক অবস্থা যেমন সামনে আসে তেমনই তাঁদের কাছে এক বড় প্রাপ্তি হয়ে ওঠে ‘মির তকি মির’ ও আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় উর্দু ও ফার্সি কবিদের কাব্যময় জীবনের দ্যোতনা।
কোনও মহান স্রষ্টার জীবন নিয়ে লেখা গ্রন্থে সাধারণত লেখক সেই স্রষ্টার জীবনের নানা দিকে আলোকপাত করার চেষ্টা করেন। এই গ্রন্থে সেই চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে লেখক অত্যন্ত মুনশিয়ানায় তুলে ধরেছেন কালজয়ী কবি মির্জা গালিবের পারিবারিক ইতিহাস ও তাঁর জীবনপ্রবাহে ঘটে যাওয়া বহু মূল্যবান সুখ-দুঃখের রসসিক্ত ছবি।
গ্রন্থটি আরও যে কারণে উপভোগ্য তা হল, এর গদ্যভাষা আদ্যন্ত এক কাব্যিক দ্যোতনায় উজ্জ্বল। সেই সময়ের দিল্লি শহরের ‘মিনা বাজার’-এ সবদিক থেকেই মহিলাদেরই প্রবেশাধিকার থাকত। এমনকি খাসমহলের বেগম, বিভিন্ন নবাব ও অন্যান্য আমির বাড়ির মহিলারাও সেখানে আসতেন। লেখক আশা করেছেন লালকেল্লায় আজও ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ অনুষ্ঠানে তার খানিকটা আভাস পাওয়া যেতে পারে। এইখানে লেখকের কাব্যিক বর্ণনার খানিকটা উদ্ধৃতি দিই : ‘‘কাচ ও চিনেমাটির বাসন, চুড়ির শব্দ, পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে-আসা একদিনের আজাদি— খিলখিল হাসির শব্দ… দোকানদার-খরিদ্দারের কথোপকথন… শাহজাদির কাচের চুড়ি পছন্দ হয়েছে… রানিসাহেবা তাকে চাপা পরিশীলিত উচ্চারণে বলছেন যে, বাদশাহের ঘরের মেয়েরা কাচের চুড়ি পরে না… ধুরন্ধর দোকানির গলায় মধু ঢেলে কাতর অনুরোধ…
মেয়েটার নাজুক ইরাদা এইভাবে ভেঙে দেবেন না… খেলনা বই তো অন্য কিছু নয়… বিহ্বল রানিসাহেবা শেষে হেরে গিয়ে মেয়ের জন্য দু’গাছা কাচের রঙ্গিন চুড়ি কিনছেন একমুঠো সোনার আশরফি দিয়ে, তার শব্দ শুনতে পাবেন।’’
এইরকম আরও আছে। দশম অধ্যায়েও দেখা যায়, “…উনিশ শতকে গোড়ার দিকে দিল্লি শহরের জনজীবন সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরিতে সচেষ্ট হব” বলে লেখক প্রায় পুরো অধ্যায়টি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার গদ্যভাষা কাব্যময়তায় ভরপুর।
এই সুষমামণ্ডিত ভাষার গুণে যাবতীয় তথ্যকে ছাপিয়ে এক বিশেষ সময়ের সমাজজীবন, এক ক্ষতবিক্ষত ইতিহাসের করুণ কাহিনি আর সেই অনুসঙ্গে মির্জা গালিবের মতো জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা কবি-জীবনের আখ্যান গ্রন্থটিকে যে সুখপাঠ্য ও পাঠকপ্রিয় করবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
দেবব্রত ঘোষের মানানসই প্রচ্ছদ ও প্যাপিরাসের সযত্ন প্রকাশনা গ্রন্থটিকে আকর্ষণযোগ্য করেছে।
মুঘল অস্তরাগের কবি মির্জা গালিব
কমল সরকার
প্যাপিরাস
১২০ টাকা