দেবর্ষি সারগী
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত এরকম মানুষ দেখা যেত— কলকাতায় যেমন, তেমনই বাংলার গ্রামগুলোয়। গ্রাম্য পোশাক, সরল জীবনযাপন, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা, মানবপ্রেম, প্রীতিপূর্ণ ঠাট্টা-তামাশা এবং সর্বোপরি হৃদয়ের কোমলতা— যে বৈশিষ্ট্যগুলি এখন একটু বিরল— এঁদের মধ্যে প্রবাহিত হত অফুরন্ত ধারায়। পুরুষের ঋজুতা এবং নারীর আবেগপ্রবণতা— এই দু’য়ের অবাধ ও স্বতস্ফূর্ত সংমিশ্রণে নির্মিত এঁদের মানসিক গড়ন। জনসমক্ষে কেঁদে ফেলতে এঁদের পৌরুষ সংকোচগ্রস্ত হত না। ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকটি দেখার জন্য শাঁওলী মিত্র গৌরদাকে টিকিট দিতে গেলে তিনি শাঁওলীকে বলেন, “দুটো টিকিট দিয়ে যা।” খুশি হয়ে শাঁওলী জিজ্ঞেস করেন, “বউদিকেও নিয়ে যাবেন বুঝি?” জবাবে গৌরদা বলেন, “না না, একাই যাব। শুধু পাশের সিটটা যাতে খালি থাকে তাই দুটো টিকিট চাইছি, কারণ তোর নাটক দেখে অনেক কান্না আসবে তো— পাশে কেউ থাকলে সে বিরক্ত হবে।”
কান্না যেমন লুকোতেন না, তেমনই কেউ নিন্দা বা অপমানসূচক কোনও মন্তব্য করলে সেটাও জনসমক্ষে নিঃসংকোচে প্রকাশ করতেন। তখন ‘আজকাল’ পত্রিকা সবে বেরিয়েছে। জনৈক পাঠক পোস্টকার্ডে এই কথাগুলো লিখে ‘আজকাল’-এর দপ্তরে পাঠালেন : “আনন্দবাজার পত্রিকায় বিরক্ত হইয়া ‘আজকাল’ রাখিতে শুরু করিয়াছিলাম। এক্ষণে আবার ‘আনন্দবাজার’-এ ফিরিয়া যাইতেছি, কারণ গরুরা কাগজ সম্পাদনা করিবে আর মানুষেরা তাহা পড়িবে ইহা মানবেতিহাসে বেশিকাল যাবৎ চলে নাই।” নিজের দপ্তরে যে টেবিলের পেছনে গৌরদা বসতেন, চিঠিটা তিনি ওটার কাচের নীচে বহুদিন রেখে দিয়েছিলেন, যাতে সবাই পড়তে পারে। ঠিক এরকম অকৃত্রিম সংকোচহীনতা তাঁর মধ্যে ফুটে উঠেছিল যেদিন একটা চিঠি অ্যাটেস্ট করার জন্য তাঁর ঘরে ঢুকি। চিঠিটা হাতে ধরে তিনি বললেন, “অ্যাটেস্টেশন বানানটা বল।” আমি বললাম। ঘরে তখন বসে ছিলেন অম্লান দত্ত, শিবনারায়ণ রায়, স্বপন মজুমদার প্রমুখেরা।
তাঁর সঙ্গে প্রথম যেদিন মুখোমুখি হই, সেদিনই বুঝেছিলাম আমি এমন একজন মানুষের সামনে উপস্থিত হয়েছি, যিনি ঠিক এ যুগে নন, বাস করেন যেন বিংশ শতাব্দীর গোড়া বা মধ্যভাগের কোনও সময়ে। আর কলকাতার লোক তো ননই। বস্তুতপক্ষে, পরেও গৌরদাকে আমার কলকাতাবাসী বলে মনে হত না।
প্রথম দর্শনের ঘটনাটা বলি। আমি তখন এমএ পাশ করে বসে আছি। তাঁর লেখা তিনখানা কালজয়ী বই পড়ে অভিভূত পাঠক হিসেবে আবু সয়ীদ আইয়ুবের বেগবাগানের বাড়িতে প্রায়ই যেতাম আমি এবং পার্কিনসন রোগে আক্রান্ত আইয়ুবের অনতিস্পষ্ট কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। একদিন তিনি বললেন তাঁর বন্ধু গৌরকিশোর ঘোষ একটা বাংলা দৈনিক বার করছেন, আমি তাতে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিতে রাজি কিনা। আমি রাজি হলাম। এর পর তিনি গৌরী আইয়ুবকে দিয়ে একটি চিঠি লিখিয়ে বললেন গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে। আমর্হাস্ট স্ট্রিটে অবস্থিত ‘আজকাল’-এর দপ্তরে চিঠি হাতে ধরে উপস্থিত হলাম। একটা চেয়ারে গেঞ্জি গায়ে বসে এক আঙুলে টোকা মেরে মেরে খুব সাবধানে যিনি টাইপরাইটার চালাচ্ছেন তিনিই গৌরকিশোর ঘোষ। আমার চিঠিটা পড়ে তিনি বাঘের মতো পলকহীন দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে (এরকম বাঘের মতো পলকহীন দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ কারও দিকে তাকিয়ে থাকার অভ্যেস তাঁর আমৃত্যু ছিল), তার পর বললেন, “আবু সয়ীদ চিঠি দিক বা বাবু সয়ীদ, এখানে চাকরি হবে পরীক্ষায় পাশ করলে।” আমি সব শর্ত মানতে রাজি হলাম এবং যথারীতি পরীক্ষায় বসলাম এবং পাশ করার পর চাকরি পেলাম।
এই আমার গৌরদাকে চেনার সূত্রপাত। তার পর তো তাঁকে দেখেছি এবং চিনেছি অফিসে, অফিসের বাইরে, তাঁর বাড়িতে, ভিড়ের মাঝে, একান্তে। আর অনেক ঘটনায় বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় অভিভূত হয়ে গিয়েছি। ধুতি-ফতুয়া বা পাঞ্জাবিই ছিল তাঁর প্রিয় পোশাক, তবে একবার জিন্সের প্যান্ট পরা অবস্থাতেও তাঁকে দেখেছি। কফি হাউসে সন্ধেবেলায় বসে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ দেখি গৌরদা প্যান্ট পরে কফি হাউসে ঢুকলেন, সঙ্গে ছিলেন সম্ভবত জ্যোর্তিময় দত্ত। আমি তাঁর দিকে এগিয়ে যেতে বললেন, “প্যান্টটা নতুন বানালাম। দ্যাখ তো ফিট করেছে কিনা।” বলে তিনি নানা টেবিল, নানা চেয়ার ও মানুষজনকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখালেন কিছুক্ষণ ধরে। তার পর জানতে চাইলেন ঠিক আছে কিনা। আমি জানালাম খুব ভাল ফিট করেছে। খুশি হয়ে বললেন, “প্যান্ট পরার অভ্যেস করব ভাবছি। বিলেতে কী লজ্জাজনক কাণ্ডই না ঘটিয়ে ফেলেছিলাম!” বিলেত থেকে ফিরে এসে গৌরদা ‘আজকাল’ অফিসে আমাদের বলেছিলেন, “শোন, বিলেতে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করে এলাম আর পাকিস্তানের মুখে কালি মাখিয়ে।” ঘটনাটা হল ওখানকার মেট্রো স্টেশনে এসকেলেটর থেকে প্ল্যাটফর্মে নামতে গিয়ে ধুতি পরিহিত গৌরদা পা বেধে প্ল্যাটফর্মে পড়ে যান। কেয়ারটেকার এক ব্রিটিশ মহিলা ছুটে এসে তাঁকে তোলেন এবং জিজ্ঞেস করেন, “ইন্ডিয়ান? ইন্ডিয়ান?” গৌরদা চটপট জবাব দেন, “নো নো— পাকিস্তানি!” হাসতে হাসতে গৌরদা আমাদের বললেন, “ওই মহিলা নিশ্চয়ই আমার কথা বিশ্বাস করে ভেবেছে, ভারতীয়রা এসকেলেটর চড়তে জানে, পাকিস্তানিরাই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।”
কর্তব্যবোধ ও নৈতিকতার প্রতি নিষ্ঠা থেকে একচুলও তাঁকে নড়ানো যেত না। ছোট ছোট ব্যাপারেও এটা তিনি কঠোর নিয়মে পালন করতেন। একদিন সকালের দিকে তাঁর বাড়িতে গিয়েছি কোনও কাজে। তখন তিনি ‘আজকাল’ ছেড়ে আবার ‘আনন্দবাজার’-এ ফিরে গিয়েছেন। সেদিন একটু দেরিতে বেরোবেন। অফিসের সাদা গাড়িটা তাঁর বাড়ির নীচে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ তাঁর ছেলে এসে বলল, “বাবা, তোমার বেরোতে তো একটু দেরি আছে। ততক্ষণে গাড়িটা নিয়ে আমি উল্টোডাঙার মোড় থেকে একটু ঘুরে আসব? একটা জিনিস কিনতে হবে।” গৌরদা বললেন, “গাড়িটা অফিস আমাকে অফিসের কাজের জন্য দিয়েছে। উল্টোডাঙা যেতে হলে ট্যাক্সি করে যা।”
বিহার প্রেস বিলের বিরুদ্ধে কলেজ স্কোয়ার থেকে রাজভবনে মিছিল করে যাওয়া হবে রাজ্যপালকে স্মারকপত্র দেওয়ার জন্য। মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন গৌরদা। জুলাই মাস, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আমরা সাংবাদিকরা ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর দল কলেজ স্কোয়ারে জড়ো হলাম। গৌরদার জ্বর। তবু এসেছেন। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছিল বলে আমি আমার ছাতাটা খুলে গৌরদার মাথার ওপর ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। যাত্রা শুরু হতে একটু দেরি আছে। কেউ একজন রাস্তার ধারের কোনও একটা দোকান থেকে একটা টুল এনে অসুস্থ গৌরদাকে বসতে দিল। হঠাৎ খবর এল— মিছিল প্রস্তুত, এবার যাত্রা শুরু হবে, পুরোভাগে থাকবেন গৌরদা। কয়েকজন ছুটে এসে বলল, “গৌরদা চলুন— মিছিল রেডি।” গৌরদা নড়েন না। কী ব্যাপার? তাঁর বক্তব্য, এই টুলটা যে দোকান থেকে আনা হয়েছে সেটা আগে ফেরত দিতে হবে। একজন টুলটা তুলে দোকানে ফেরত দিয়ে জানাল ফেরত দেওয়া হয়ে গিয়েছে। এর পর গৌরদা নিজে গেলেন দোকানটায়, দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন সে টুলটা ফেরত পেয়েছে কিনা। দোকানি হ্যাঁ বলল। গৌরদা বললেন, “চল, এবার মিছিল শুরু করা যাক।”
সম্ভবত তৃতীয়বার সেরিব্রাল অ্যাটাক গৌরদার। আগের অ্যাটাকের সময় মজা করে বলেছিলেন, “যতবার অ্যাটাক হয়, আমার আয়ু বেড়ে যায়।” তৃতীয়বারের অ্যাটাকও সামলে নিলেন, তবে একটা অংশ প্যারালিসিস হয়ে গেল। হাঁটতে অসুবিধে হয়, লিখতে-পড়তে অসুবিধে হয়, হাতে বই ধরতে অসুবিধে হয়। হাত কাঁপে। বড়মেয়ে সাহানা আমাকে বললেন, আমার এমন কোনও ছাত্র বা ছাত্রীকে কি পাওয়া যেতে পারে, যে গৌরদার বাড়িতে মাঝে মাঝে এসে তাঁর পছন্দের কোনও বই পড়ে তাঁকে শোনাতে পারে। আমি চেষ্টা করলাম কিন্তু তেমন কাউকে পেলাম না। শেষপর্যন্ত সাহানাকে জানালাম সপ্তাহে দু’দিন আমি গিয়ে গৌরদার পছন্দের বই তাঁকে পড়িয়ে আসব।
প্রথম দিন তিনি আমাকে আইজ্যাক ব্যাশেভিস সিঙ্গারের একটা গল্পের বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতে বললেন। তার পর একদিন বললেন মার্কেজ থেকে, আর একদিন টলস্টয় ও বোর্হেস থেকে। একদিন বললেন টয়েনবির ‘আ স্টাডি অব হিস্টরি’ বইটি থেকে কিছু পড়ে শোনাতে। তাঁর বইভর্তি শেলফের মধ্যে দেখলাম একটা ছোট কেসের মধ্যে দু’খণ্ডের সংক্ষেপিত সংস্করণ টয়েনবির বইটি। কিন্তু কেসটার মধ্যে বইদুটো এমনভাবে আটকে গিয়েছে যে অনেক চেষ্টা করেও বার করতে পারছিলাম না। গৌরদা বললেন, “খাঁচাটা ভেঙে টয়েনবিকে উদ্ধার কর।” অর্থাৎ ছুরি দিয়ে কেসটা কেটে তিনি বইদুটো উদ্ধার করতে বললেন। আমি তাই করলাম। সাবধানে পিজবোর্ডের কেসটা কেটে বইদুটো বার করলাম। খুশি হয়ে তিনি প্রথম খণ্ড থেকে ‘স্কিজম ইন দ্য সোল’ শীর্ষক অধ্যায় পড়তে বললেন। টয়েনবির ভাষা, যুক্তিবিন্যাস ও বিশ্লেষণ তো যথেষ্ট গভীর এবং ঈষৎ জটিলও, তাই রিডিং শুনে তাঁকে অনুধাবন করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। কিছুক্ষণ পড়ার পর গৌরদা হঠাৎ বললেন, “এত বড় পণ্ডিত। কিন্তু ঈশ্বর, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতায় কী গভীর আস্থা রাখতেন। তাঁর মতবাদই হল একটা সভ্যতার পতন ঘটে সেখানকার অধিবাসীদের আধ্যাত্মিক পতন ঘটলে। এবং মানুষের ইতিহাস নাকি ঈশ্বরেরই স্বরূপ উন্মোচনের ইতিহাস।”
অম্লান দত্ত বা শিবনারায়ণ রায়ের বন্ধু হিসেবে গৌরদাও যে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে গভীর কোনও অনুরাগ দেখাবেন না সেটা স্বাভাবিক। ঈশ্বর বা ধর্ম নিয়ে তাঁকে কখনও আলোচনা করতেও আমি শুনিনি। তবে একবার গান্ধীর সবরমতী আশ্রমে তাঁর ভ্রমণ এবং থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় একটা অসামান্য প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে এক জায়গায় লিখছেন যে এক সন্ধেয় খাওয়াদাওয়া সেরে তিনি নিজের এঁটো বাসনপত্র মাজছিলেন এবং দূর থেকে তাঁর কানে সারাক্ষণ ভেসে আসছিল অনুচ্চ স্বরে হতে থাকা রামধুনের গান। তিনি লিখছেন একটা থালা তিনি ক্রমাগত মেজে যাচ্ছিলেন, কারণ তাঁর মনটা তো বন্দি হয়ে যায় ওই রামধুনে, আর তিনি ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছিলেন।
পরে যখন একদিন ‘আনন্দবাজার’-এর অফিসে গিয়ে লেখাটার প্রসঙ্গ তুলি তাঁর কাছে, তিনি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন। তার পর বললেন, “সেদিন এরকম কেন হয়েছিল আমি নিজেই জানি না। অথচ আমি তো ঈশ্বর মানি না।”
“আপনি ঈশ্বর না মানলেও ঈশ্বর আপনাকে ভালবাসেন।” আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম। “তাই হয়তো সেদিন কাঁদছিলেন।”
আমার দেখা শেষ কান্না গৌরদার আমাকে নিয়ে। ‘আজকাল’-এ সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে কলেজে অধ্যাপনার চাকরি নেব— এ কথাটা তাঁর চুনীবাবুর বাজারের বাড়িতে একদিন সকালে বলতে গেলাম। সব শুনে গৌরদা পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে, তার পর আমার কাঁধে হাত রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। উনি যদি গৌরকিশোর ঘোষ না হয়ে আমার কোনও বন্ধু হতেন তবে সেদিন তাঁকে জড়িয়ে ধরে আমিও অনেকখানি কাঁদতাম।