বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

পুণ্যতীর্থ বিঠুর

পুরাণ মতে ব্রহ্মাবর্তের মতো তীর্থ ভূ-ভারতে নেই। সেই মতেই এই স্থানটি পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। বিষ্ণুর নির্দেশ ব্রহ্মা এখানে বসে  ছেষট্টি বার যজ্ঞ করে পৃথিবীর প্রথম মানুষ মনুকে সৃষ্টি করলেন। সেই স্থানটি চিহ্নিত করে বিশ্বাসের পুজো। রাজস্থানের পুষ্করে ব্রহ্মার মূর্তিপুজো হয় আর ব্রহ্মার চরণ পূজিত হয় বিঠুরে।

শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য

 

ব্রহ্মা সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মাণ্ড। এই বিরাট কাজটি সেরে তিনি গঙ্গার ধারে অশ্বমেধ যজ্ঞ করলেন। জায়গার নাম হল ব্রহ্মাবর্ত। গঙ্গার তীরে অতি প্রাচীন এক হিন্দু তীর্থ। বড় সাধ হয়েছিল এমন একটি প্রাচীন তীর্থ দর্শনের। জায়গার অবস্থান বুঝতে বইপত্তর নিয়ে দেখতে গিয়ে দেখলাম, এখানেই নাকি ছিল মহর্ষি বাল্মীকির তপোবন। রাম-রাবণের যুদ্ধের শেষে রাম-সীতা অযোধ্যায় ফেরার পরে রামচন্দ্রের আদেশে লক্ষণ সীতাকে এখানেই রেখে আসেন। বাল্মিকীর আশ্রমেই লব-কুশের জন্ম হয়। এখান থেকে কাছেই, নদীর অপর পাড়ের পরিহারে সীতার পাতালপ্রবেশ ঘটেছিল। বইপত্তর থেকে আরও জানা যাচ্ছে, পেশোয়া শেষ বাজিরাওয়ের দত্তক পুত্র নানাসাহেব এখানে থাকতেন। জায়গার নাম ব্রহ্মাবর্ত আর নেই। বর্তমানে এই স্থানের নাম বিঠুর
ভারতবর্ষে প্রথম স্থান হিসেবে ইতিহাসে দাগ পড়েছিল ৩২৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্বে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময়। ব্রহ্মার সৃষ্টি বা রামচন্দ্রের রাজত্বকালের নির্দিষ্ট সাল-তারিখ পাওয়া যায় না। পুরাণে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি এইভাবে সময়কাল ভাগ করা আছে। সত্যযুগে ব্রহ্মার ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ও ত্রেতাযুগে রামচন্দ্রের কাহিনি বহু প্রাচীন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হওয়ার অনেক আগে এই কথকতার ভৌগোলিক অবস্থান বেশ মিলে যায়। মনস্থির করে ফেললাম, বিঠুর যাব।
দিল্লিগামী ট্রেনে চেপে গিয়ে নামলাম কানপুরে। কানপুর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে গঙ্গার তীরে বিঠুর। কানপুরে ভাল ভাল হোটেল আছে। সেখানে থেকে দেখে নেওয়া যেত। আমি এগিয়ে গেলাম বিঠুরে থাকব বলে। সাধারণ হোটেল ও ধর্মশালার মতো এখানকার নগরজীবনও বেশ সাধারণ। এখানে গঙ্গায় ঢেউ নেই। আমিও এই নিস্তরঙ্গ এলাকায় দুটো দিন নদীর ধারে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দেব।

গঙ্গার ঘাট

খুব সকালে উঠে ব্রহ্মাবর্ত ঘাটে চলে এসেছি। নদীর পাড়ে হালকা মিষ্টি হাওয়া বইছে। অনেক ভোর থেকেই মন্দিরে আরতি, পুজোপাঠ শুরু হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ জানান দিচ্ছে ভক্তদের উপস্থিতি। এটাই বিঠুরের প্রধান ঘাট। সকাল থেকেই গঙ্গা পূজন, মস্তক মুণ্ডন, স্নান, কাঠের চৌকিতে ছাতার নীচে পুজাপাঠ চলছে। ফুল, ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভক্তির আবহাওয়া তৈরি হয়েছে।
গঙ্গার ধারে ব্রহ্মাবর্ত ঘাটের প্রধান স্থান হল ব্রহ্মা খুঁটি। এখানে স্নান সেরে সবাই প্রথমে পুজো দিচ্ছেন। ছোট একটি মন্দিরের মূল জায়গাটি রুপোর পাতে মোড়া। পুরাণ মতে ব্রহ্মাবর্তের মতো তীর্থ ভূ-ভারতে নেই। সেই মতেই এই স্থানটি পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। বিষ্ণুর নির্দেশ ব্রহ্মা এখানে বসে  ছেষট্টি বার যজ্ঞ করে পৃথিবীর প্রথম মানুষ মনুকে সৃষ্টি করলেন। সেই স্থানটি চিহ্নিত করে বিশ্বাসের পুজো। রাজস্থানের পুষ্করে ব্রহ্মার মূর্তিপুজো হয় আর ব্রহ্মার চরণ পূজিত হয় বিঠুরে। মূল এই কেন্দ্রকে ঘিরে আশপাশে তৈরি হয়েছে অনেক শিব মন্দির, কৃষ্ণ মন্দির, রাম মন্দির প্রভৃতি।

গঙ্গার ঘাটে পুজোপাঠ

মন্দির থেকে একটু দূরে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। পরনে ধুতি, গায়ে গেঞ্জি, মাথায় পাকা চুল, মুখে বেশ বড় একটা গোঁফ, আচার-আচরণে বেশ ভরসার ছাপ। বড় মাটির ভাঁড়ে চায়ের সঙ্গে আলাপ জমে উঠল। হিন্দিতে বলা কথাগুলোর বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা এইরকম।
“আপনাদের কি মনে হয় এটাই মনু সৃষ্টির স্থান?”
“হ্যাঁ, এটাই তো। আমার বাপ-ঠাকুরদার মুখ থেকে শুনে আসছি।”
“আরে না না। বাপ-ঠাকুরদা তো সেদিনের ব্যাপার। আমি প্রাচীনকালের কথা বলছি।”
“হ্যাঁ বাবু, আপনি দু-চার দিন থাকলে আর ভোরবেলা এলে বুঝবেন।”
“কিন্তু পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু এটা হয় কী করে?”
“বিশ্বাস বাবু। আমরা যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস করি, পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করুন, ওরাও তাই বলবেন।”
চায়ের দোকানি গোপীনাথজি দু’হাত তুলে মাথায় ঠেকালেন। বিশ্বাসের জায়গায় এই মানুষগুলো এগিয়ে আছে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার অথবা রাজস্থানের মানুষগুলোকে দেখেছি, এই বিশ্বাস তাঁরা ধরে রাখেন, রাখতে চান। এই বিশ্বাসই কখনও কখনও রাজনৈতিক দলের টোপ হয়ে দাঁড়ায়। আমি ওই বিশ্বাসটা আনার চেষ্টা করছি, পারছি না। তীর্থক্ষেত্রের নদীতে একটা ডুব দিয়ে যে প্রশান্তি তাঁদের মুখে দেখি সেই প্রশান্তি আমি চেষ্টা করেও আনতে পারছি না
ব্রহ্মাবর্ত ঘাটের পাশ দিয়ে নদীর পাড় বরাবর হাঁটা যায়। এই পথে প্রচুর মন্দির, প্রাচীন ভবন, ঘাট, বহু পুরনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। ব্রহ্মেশ্বর, নীলকণ্ঠেশ্বর প্রভৃতি নানা ছোট ছোট শিব মন্দির পথের ধারে।
হাঁটতে হাঁটতে এলাম পত্থরঘাটে। বেশ জমজমাট ঘাট। লম্বা-চওড়ায় প্রশস্ত। বহু মানুষ স্নান করছেন। ঘাটে ছোট ছোট কাঠের চৌকি পাতা, মাথায় ছাতা, তার নীচে পুরোহিত। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষজনের জটলা। পাশেই নাপিতরা মস্তক মুণ্ডনের কাজে ব্যস্ত। ফুল, দীপ, বাতির দোকান। একসঙ্গে কত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এখানে। বেনারসের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা যায়।
একটা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে হালকা চালে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কাঁধের ঝোলায় জল আর একটা বিস্কুটের প্যাকেট। একধারে বসে শুধুই দেখছি।

শিবলিঙ্গ অর্চনা

“দাদা, ব্যাগটা একটু দেখবেন? স্নান করেই চলে আসব।”
“ঠিক আছে।” দায়িত্ব নিতে না চাইলেও এসে যায়।
স্নান সেরে তিনি বলে চলেছেন গঙ্গাস্তোত্র।
“দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে
ত্রিভুবনতারিণী তরল তরঙ্গে।”
“আপনি কি রোজই এইভাবে পুরোটা বলেন?”
“যখনই সকালে স্নান করি তখনই শঙ্করাচার্যের এই স্তোত্র না বললে সারাদিন কেমন অস্বস্তি হয়।”
আলাপে জানলাম এঁর নাম পতিতপাবন দাস। বাবা কানপুরের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতে এসেছিলেন। ধর্মপ্রাণ মানুষ। অবসরের পরে বিঠুরের টানে এখানেই বাড়ি করে থেকে গেছেন।
বারোশো বছর ধরে চলে আসা গঙ্গার স্তুতি, এখনও তার সমান কদর। কী সুন্দর সুর! এমন কত কথা, সুর বহুবছর ধরে উচ্চারিত হচ্ছে, তার কতটুকুই বা জানি।
ঘাটের পাশেই বিঠুরের সবচেয়ে সুন্দর শিব মন্দির। বিঠুরের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মহত্বের কথা ভেবে এখানে বহু রাজা মন্দির, ভবন ও ঘাট নির্মাণ করেছেন। অযোধ্যার নবাব গাজিউদ্দিন হায়দরের মন্ত্রী টিকতরায় লাল বেলেপাথরের মন্দির ও ঘাট নির্মাণ করেছিলেন যা এখনও সকলকে আকর্ষণ করে।
গঙ্গার ধার থেকে বেশ কিছু সিঁড়ি ভেঙে মন্দিরে যেতে হয়। মূল মন্দিরের মাঝে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। মাঝে মন্দির রেখে চারপাশে প্রশস্ত অঙ্গন। রাজস্থানের ধাঁচে চার কোণে চারটি ছত্রী। সবচেয়ে আকর্ষণ করে শিব মন্দিরের গায়ে লাগানো লাল বেলেপাথরের বিশাল এক ত্রিশূল। মন্দিরের ওপর থেকে চারপাশের দৃশ্য বেশ ভাল লাগে। মন্দির থেকে সিঁড়ি সোজা নদীর ধারের ঘাটে নেমে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে এসেছি বাল্মিকী আশ্রমে। সাল-তারিখের ইতিহাসে এই আশ্রমের কথা খুঁজতে যাওয়া বৃথা হবে। ইতিহাসের তথ্যকে গুরুত্ব না দিলেও বাল্মিকী রামায়ণের ভৌগোলিক গুরুত্ব আমার কাছে আছে। রামায়ণের যাত্রাপথ বা ভ্রমণপথ এখনও ভৌগোলিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মহাকাব্যে বর্ণিত স্থান আজও অদ্ভুতভাবে মিলে যায়।

মহর্ষি বাল্মীকি

বলা হয়, আজ থেকে বহু আগে এখানে ছিল বাল্মিকীর তপোবন। এখানে বসেই তিনি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। অযোধ্যায় সীতাদেবীর কোনও স্থান হয়নি। লঙ্কার যুদ্ধ থেকে ফেরার পর বাল্মিকী স্থান দিয়েছিলেন সীতাকে। এখানেই লব-কুশের জন্ম হয়েছিল। তাদের শিক্ষাদীক্ষায় পারদর্শী করে তুলেছিলেন ঋষি। তাই তো অশ্বমেধের ঘোড়া আটকাতে সক্ষম হয়েছিল লব-কুশ। বাল্মিকী মন্দির, লব-কুশের জন্মস্থান, সীতার রান্নাঘর ইত্যাদি দেখে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু প্রাচীন মূর্তিরও দেখা পেলাম। পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও এই স্থানে একটি বিরাট তোরণদ্বার নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। তাঁর তৈরি পাথরের সুউচ্চ দীপদানটিও দেখার মতো।

দীপদান

স্থান মাহাত্ম্যের কারণে বহু ছোট ছোট আশ্রম তৈরি হয়েছে এখানে। বাংলায় লেখা একটা বোর্ড দেখে পায়ে পায়ে গিয়ে দেখি শ্রীশ্রীসীতারামদাস ওঙ্কারনাথ দেব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রীলবকুশ আশ্রম। বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে আশ্রমের মধ্যে গড়ে উঠেছে গুরু মন্দির, রাম-সীতা-লব-কুশ মন্দির, রাধাকৃষ্ণ, সংকটমোচন মন্দির প্রভৃতি। এখানে একটি আবাসিক বৈদিক বিদ্যালয় আছে।
কোনও মুনি-ঋষির আশ্রম দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আরুণির কথা ছোটবেলায় পাঠ্যে পড়েছি। দুপুরে বিদ্যালয়ের মধ্যাহ্নভোজনের সময় একঝাঁক বালক, কিশোরদের দেখার সুযোগ পাওয়া গেল। দূরে ঝোলা নামিয়ে অলসভাবে ওদের দেখছিলাম। সবাই ধুতি পরা, গায়ে গেঞ্জি, কেউ বা খালি গায়ে। কারও উপবীত আছে, কারও নেই। মাথা কারও পুরো মুণ্ডিত, কারও বা মোটা শিখা মাথার পিছনে। খাওয়ার আগে সবাই একসঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণ করছিল। চোখ বন্ধ করে প্রাচীন বৈদিক আশ্রমের অনুভুতি নেওয়ার চেষ্টায় ছিলাম। চোখ খুলতে দেখি এখানেও কিছু বিচ্ছু ছেলে আছে। খাওয়ার মধ্যেই দুষ্টুমি শুরু করে দিয়েছে।
আগে যখন বৈদিক আশ্রম ছিল তখন ছিল গ্রামীণ ভারতবর্ষ। আজকের ডিজিটাল ভারতের বৈদিক বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোররা ধুতি পরে মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ওরা শচীন তেন্ডুলকর, বিরাট কোহলির খেলাও দেখছে। এরাও হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক জানে। একটা স্মার্টফোন পেলে ওদের চোখ-মুখের ভাষা পাল্টে যায়। বিকেলে ধুতি পরে জমিয়ে ফুটবল খেলতে পারে। সে খেলা কলকাতাতেও দেখেছি আমি। ধুতি-ফুটবল।

লবকুশ মন্দির

বিঠুর থেকে একটা অটো ভাড়া করে গঙ্গার সেতু পেরিয়ে প্রায় ছ’কিলোমিটার দূরে পরিহার গ্রামে গেলাম। বিঠুর কানপুর জেলায়। সেতু পেরোলেই জেলা উন্নাও। মূল রাস্তা থেকে অনেকটা ভেতরে কয়েক বিঘা জমি নিয়ে মন্দির ও আশ্রম। এখানে অক্ষয় বট, রামসীতা মন্দির ও সীতার পাতালপ্রবেশের স্থান রয়েছে। সমস্ত রাজসুখ ছেড়ে রাগে, দুঃখে, অভিমানে সীতা স্বেচ্ছায় মাটির নীচে সমাধি নিয়েছিলেন। আজ আধুনিক যুগেও, এই ক’দিন আগে উন্নাও জেলার আর এক জানকী লালসার শিকার হয়েছিল। সেই ঘটনায় সারা ভারত কেঁপে উঠেছিল। ভাবলে মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। অল্প সময় কাটিয়ে বিঠুরে ফিরে এলাম।
পরদিন খুব সকালে হেঁটে রওয়ানা দিলাম। চলেছি আধুনিক ইতিহাসের পেশোয়াদের দুর্গে। রাস্তায় কাউকে জিজ্ঞাসা করলে জানায়, “মনু বেটি কা ঘর আগে হ্যায়।”
যেতে চাইছি পেশোয়া নানাসাহেবের দুর্গে। উত্তর আসে ‘মনু বেটি কা ঘর’। কৌতূহলের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল।

নানা রাও পেশোয়া স্মারক পার্ক

সকাল ন’টায় নানা রাও পেশোয়া স্মারক পার্কের গেট খুলতেই ভেতরে চলে গেলাম দুর্গের বিশাল তোরণদ্বার পেরিয়ে। মহারাষ্ট্রের পুণেতে পেশোয়া বাজিরাওদের মূল দুর্গ ছিল। পরে তাঁরা বিঠুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহের সময় নানাসাহেব ও তাঁতিয়া টোপির নেতৃত্বে এই স্থান বড় ভূমিকা পালন করেছিল। একটু এগিয়েই রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের অশ্বারোহী বিরাট মূর্তি।
ইতিহাস বইয়ের পাতায় পড়া ছোটবেলার রোমাঞ্চকর চরিত্রগুলোর কথা মনে পড়ে একটা শিহরণ জাগছে। এই মাটিতে ওঁদের পদচারণা ছিল। সেই মাটিতে প্রণাম করলাম।
লক্ষ্মীবাঈয়ের জন্ম ১৮৩৫-এর ১৯ নভেম্বর। ছোটবেলায় নাম ছিল মনুবাঈ। মাত্র চার বছর বয়সেই এখানে এসে মনুবাঈ নানাসাহেবের কাছে অশ্বারোহণ ও যুদ্ধকলা বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকেন।
১৮৪৯ সালে রাজা গঙ্গাধরের সঙ্গে বিয়ের পর মনুবাঈয়ের নাম হয় রানি লক্ষ্মীবাঈ। ১৮৫৮ সালের ১৯ জুন তাঁর নিজের ঘোড়া সারঙ্গের পিঠে চেপে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে ঘায়েল হওয়ার বিশ্বস্ত সৈনিকরা তাঁকে বাবা গঙ্গাদাসজির কুঠিতে নিয়ে যান। সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন লক্ষ্মীবাঈ। সেখানেই অন্তিম সংস্কার করা হয় তাঁর। ঝাঁসির রানিকে বিঠুর তাদের ঘরের ছোট মেয়ে হিসেবে মানে। তাই তিনি এখানকার মনু বিটিয়া।

দুর্গ তোরণ

কিছুটা হাঁটার পর দ্বিতীয় তোরণ। দু’দিকে সেই সময়ের কামান সজ্জিত আছে। তোরণ পেরিয়ে উদ্যানের মাঝে সুদৃশ্য মঞ্চে পেশোয়া নানাসাহেব ধন্ধুপন্তের মূর্তি। নানাসাহেবের জন্ম ১৮২৪ সালে। ১৮২৭ সালে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও তাঁকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৮৫১ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে বসেন। কিন্তু ইংরেজরা স্বত্ববিলোপ নীতি জারি করে নানাসাহেবকে অস্বীকার করার ফলে বিরোধের সূত্রপাত।
নানাসাহেবের পাশেই রয়েছে তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি তাঁতিয়া টোপির মূর্তি। ১৮১৪ সালে মহারাষ্ট্রে জন্ম। পিতা পাণ্ডুরঙ্গের কাছে অস্ত্রশিক্ষা ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে প্রথমে সেনাবাহিনীতে সিপাহশালার ও পরে প্রধান সেনাপতি হয়েছিলেন। গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম নায়ক। তিনি নানাসাহেবের চেয়ে দশ বছরের বড় ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কর্তব্যে অবিচল ছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে এই দুর্গ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। উদ্যানে থাকা একটি বড় কুয়োয় আত্মবলিদান করেন দুর্গের নারীরা।

সুসজ্জিত পেশোয়া পার্কে তাঁতিয়া টোপির আবক্ষ মূর্তি

দীর্ঘদিন এই দুর্গ পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের সরকারের পর্যটন বিভাগ এটি অধিগ্রহণ করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলে ‘নানা রাও পেশোয়া স্মারক পার্ক’ নামকরণ করেছে। এর ভেতরে উন্নত মানের ট্যুরিস্ট বাংলো রয়েছে। পার্কের মধ্যে রয়েছে সংগ্রহালয়, যোগ-ধ্যান কেন্দ্র, মুক্ত মঞ্চ, নৌকাবিহারের ব্যবস্থা, শিশু উদ্যান, রেস্তোরাঁ প্রভৃতি।
বিঠুরে এসেছিলাম সত্যযুগের ব্রহ্মাবর্ত ও ক্রেতা যুগের রামায়ণের স্থান দেখার জন্য। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে আমার আর একটি মহান তীর্থও দেখা হয়ে গেল

ছবি : লেখক

 

মতামত জানান

Your email address will not be published.