বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

একে ইলিশ, দুইয়ে কই, তিনে ট্যাংরা

তিনি এখন আর নেই। তাঁর প্রয়াণ হয়েছে ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। আর তাঁর কর্তা একমেবাদ্বিতীয়ম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন ১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ। তিনি নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদুষী, সুন্দরী, সুকণ্ঠী। ২০১৫ সালে নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল। সেদিনের আলাপে সংগত করেছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন দেবশংকর মুখোপাধ্যায়। এযাবৎ অপ্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হল ‘সুখপাঠ’-এর এই শারদ সংখ্যায়।   

সময়কাল ২০১৫। মাঝবেলা। ঠিকানা ৪২ এ, চারুচন্দ্র অ্যাভিনিউ। সাবেক ধাঁচের জানলা, দরজা, বারান্দাওয়ালা মেটে রঙের তিনতলা বাড়ি। নীচতলার বারান্দাটি লোহার খাঁচায় বন্দি। রাস্তা থেকে উঠে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই সবুজ দরজা। দরজার ওপরে পাথরে খোদাই করে লেখা ‘সঙ্গীতশ্রী’। ভেতরে কালো বর্ডার দেওয়া লাল মেঝে। ডানদিকে ঢাউস বসার ঘর। সামনে দালান। উঠোন। বাঁদিকে সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উঠে ডানদিকে একচিলতে বসার ঘর। সোফা। সোফায় বসলে সামনে যে ঘরটি দেখা যায় সেখানেই শেষজীবন কাটিয়েছেন বাঙালির পরম প্রিয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২২-এ এসে সেই পুরনো বাড়ি খুঁজলেও পাবেন না। তার জায়গায় ঝাঁ চকচকে অ্যাপার্টমেন্ট। নাম ‘ভানুশ্রী’। নীলিমা দেবী গত হওয়ার পর এই বাড়ির দোতলায় রয়েছেন অকৃতদার, পঁচাত্তর বছরের সুরসিক, একদা সিনেমা-প্রযোজক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়। সময়ের পথে ফিরে যাই সেই কথালাপে। আমার সামনে নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে পুত্র।

র্দায়, মঞ্চে আপনার কর্তামশাই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখলেই লোকে হাসেআদতে মানুষটা ছিলেন নাকি খুব গম্ভীরতাই?
খুবই গম্ভীর। বাড়িতে বিশেষ কথা বলতেন না। আমিও খুব চুপচাপ ছিলাম।
কিন্তু ওঁর অল্পবিস্তর যত লেখাপত্তর দেখেছি, উনি আপনার প্রসঙ্গ এলেই দেখি, খুব গদগদ!
(হেসে ফেললেন) সেটা ঠিক বলতে পারব না।
হতে পারে আপনি সুন্দরীতাই?
কোনও দিন জিজ্ঞেস করিনি (সলজ্জ হাসি)।
আপনাদের কি প্রেমের বিয়ে?
আরে আমি তো তখন ওকে চিনতামই না। দেখেছি, এই যা। কিন্তু কী করে, না করে কিছুই জানতাম না।
দেখেই ভাল লেগেছিল?
(আঙুল তুলে দেখিয়ে) ও তো তখন এক্কেবারে এই ডিগডিগে!
এ তো পাশের বাড়ী’-র ডায়লগ হয়ে গেল! খ্যাংরা কাঠি আলুর দম!
(হাসি) সেই! তবে ওটা বিশেষ বলে লাভ নেই।
লাভ ম্যারেজ নয়তা হলে কি বাড়ি থেকে ধরেবেঁধে বিয়ে?
বলছি ব্যাপারটা। আমি তখন সিদ্ধেশ্বর মুখার্জির কাছে গান শিখি। সিদ্ধেশ্বর, রত্নেশ্বর দুই ভাই। ওঁরা তখন নামকরা গায়ক। চেনেন নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় যাঁদের ভাইপো
হ্যাঁ। তো, ওরা থাকতেন বাঙালপাড়ায়। আর আমার বাপের বাড়ি বাঙ্গুর হাসপাতালের কাছে। আমি গান শিখতে আসতাম বাড়ি থেকে। আমার হবু শ্বশুরের বাড়ি তখন চারু অ্যাভিনিউতে। বাঙালপাড়ার কাছে। তো, উনি (ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়) সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আড্ডা দিতেন। সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছেই উনি আমাকে বিয়ে করার পারমিশন চান। বলতে গেলে আমাদের বিয়ে সেই সূত্রেই।
মানে, মাস্টারমশাই ছাত্রীর বিয়ের ঘটকালি করলেন!
(গৌতমবাবু সায় দিলেন কথায়, তার পর উনিও) ঠিক তাই। এর পর যা করেছেন সিদ্ধেশ্বরবাবুই। উনিই আমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সব বলেন-টলেন। তার পর বিয়ে।
আপনার বাড়ি থেকে কোনও আপত্তি?
ওসব কিছু না। উল্টে একটা কারণে বিয়েটা খুব হুড়োতাড়ার মধ্যে হয়েছিল।
সেটা আবার কী?
সময়টা বললে বুঝবেন। ১৯৪৬। দাঙ্গা। কোথায় কী হয়, বোঝা যাচ্ছে না। ও তখন ‘আয়রন অ্যান্ড স্টিল কনট্রোল’-এ চাকরি করে। অফিস কলকাতার ক্লাইভ স্ট্রিটে। শোনা যাচ্ছে, সেখান থেকে ওকে বাইরে কোথাও ট্রান্সফার করে দেওয়া হবে। সে একেবারে দিল্লি। ফলে ওদের বাড়ি থেকে একটা তাড়া ছিল।
ব্যাস? তাতেই বিয়ে?
হ্যাঁ। তাতেই বিয়ে। ওই বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে।
মানে, আপনার কিছু মনে হয়নি? কে তখন তো তেমন চেনেনই না!
তখন অতশত ভাবত নাকি মেয়েরা!
আপনাদের দেখাসাক্ষাৎ বলতে গেলে ওই সিদ্ধেশ্বরবাবুর বাড়িতেই?
তার আগে একটা ফাংশনে। ইছাপুরে গেলাম, সিদ্ধেশ্বরবাবু নিয়ে গেলেন। সঙ্গে ও (ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়)। সারাটা রাস্তা আমি চুপচাপই ছিলাম। কোথায়  যাচ্ছি, কী বৃত্তান্ত, কিছুই জানি না। গিয়ে দেখি, কোর্ট চত্বরে ফাংশন। শুনে আমার তো বেশ অদ্ভুত লাগল। তো, আমি গাইলাম। সিদ্ধেশ্বরবাবু গাইলেন। শেষে দেখি, হঠাৎ ও তড়াক করে বেঞ্চিতে উঠে ‘কমিক’ শুরু করে দিল। আর তাতে একেবারে অট্টহাসি। সেই ওকে আমার প্রথম দেখা।
তখন উনি সিনেমায় চলে এসেছেন?
না না। সে তো বিয়ের পরে।
ও হ্যাঁসেই গল্পটা মনে পড়ল বিভূতি চক্রবর্তীর জাগরণপ্রথম ছবিবিয়ের পর জোড়েযেদিন গেলেন, সেদিন প্রায় না বলেকয়ে আপনাকে আপনাদের বাড়ির দরজায় নামিয়ে চলে গিয়েছিলেন শ্যুটিংয়ে!
কী অবস্থা ভাবুন। আমায় নামিয়ে বলে গেল ‘রাধা ফিল্ম স্টুডিও’-তে কাজ আছে, আসছি। ব্যাস, সেই যে গেল,  আর আসেই না। শেষে অনেক রাতে বাবা খোঁজ করতে গিয়ে জামাইকে আবিষ্কার করে ছেঁড়া চট গায়ে, কালিঝুলি মাখা চেহারায় শ্যুটিং ফ্লোরে। বাড়ি ফিরে বাবা তো রাগে গরগর করছিল। তারও কত বাদে ও এল! আমি তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।

কোলে মেয়ে বাসবী, বাঁদিকে ছোট ছেলে পিনাকী, ডানদিকে গৌতম

আচ্ছা, এই যে অদ্ভুত মানুষ, পরে যিনি দুই পুত্র ও এক কন্যার বাবা হলেন, ছেলেমেয়েদের দেখভাল কতটুকু করতেন?
(পাশ থেকে গৌতমবাবু বললেন, ‘সব মা। সব মা’। মৃদু হেসে নীলিমা দেবী বললেন) ও তেমন সময় পেত কই! আমিও তেমন বুঝতাম না। জ্ঞানগম্যি ছিল নাকি! তাও যা করার…।
কী বলছেন! জ্ঞানগম্যি ছিল না মানে! আপনি তখনকার দিনের আইএ পাশ
ওই হল আর কী!
ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে ভর্তি করানো?
ওটা নোরা, মানে আমার এক ননদের মেয়ে করেছে। তবে ও (গৌতমবাবুর দিকে দেখিয়ে) যখন আশুতোষ কলেজে ভর্তি হল তখন ওর বাবা সঙ্গে গিয়েছিল। বা, ছোট ছেলে পিনাকী যখন যাদবপুরে ফিজিক্স নিয়ে পড়তে ঢুকল, তখনও। মেয়ে বাসবীর বেলাটা ঠিক মনে পড়ে না। ওদের পড়াশোনা ওরা নিজেরাই করেছে। মাস্টারমশাই ছিল। আর ছোটবেলায় আমার শাশুড়িও ওদের নিয়ে বসতেন। বাবাকে ওরা এ ব্যাপারে পায়নি।
আচ্ছা, আপনারা কখনও একসঙ্গে বেড়াতে গিয়েছেন?
বেড়াতে যাব বলে বেড়ানো কখনও হয়নি। কিন্তু অনুষ্ঠান করতে গিয়ে গিয়েছি। কানাডা, শিকাগো। তখন আরও কেউ ছিলেন দলে। শ্যামল মিত্র, গায়ত্রী বসু। সেটা ১৯৭৬ সালে। আর ছোটখাটো ফাংশনে তো অনেক গেছি, এদিক-সেদিক।
একসঙ্গে সিনেমানাটক দেখাটেখা
সে আর হত কই! সিনেমা হল বলতে বসুশ্রী তো ওর ঘরবাড়ি ছিল। ওখানে কিছু হলে যেতাম।
ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গপ্পোগুজব করা?
কখনই না। টাইম ছিল কই! প্রচণ্ড খাটতেন। (গৌতবাবু এবার বললেন, মানিক গোস্বামীর কথাটা বলো। শুনেই বলতে লাগলেন) চুনী গোস্বামীর ভাই মানিক গোস্বামী কী বলত জানেন ওকে?
কী?
বলতেন, একটা লোক আড়াইশো বছর বেঁচে থাকলে যা কাজ করে, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এক জীবনে তাই করেছেন!
সকালে উঠতেন কটায়?
সাতটার আশেপাশে।
তার পর?
(এবার মাকে বলতে না দিয়ে গৌতমবাবু বলে উঠলেন, চা-টা খেয়ে বেরিয়ে গেল। বারোটায় ফিরল। একটু ঘুমিয়ে আবার বেরোনো। রাত দশটা-সাড়ে দশটায় ফিরে খেয়েদেয়ে ঘুম। শুনে কেমন যেন আহত গলায় নীলিমা দেবী বললেন) অমন বোলো না। সকালে উঠে তেমন খেতেন না। আটটা কী সাড়ে আটটায় অফিস যে! (আবার কথা কাটলেন ছেলে, মা, এটা তুমি প্রথম দিককার কথা বলছ। যখন বাবা চাকরি করত। এবার যেন ছেলের কথায় ভরসা পেলেন নীলিমা দেবী। বললেন) সেটা ঠিক। চাকরি করার সময় একরকম রুটিন ছিল। চাকরি ছাড়ার পর আরেক।
চাকরিটা ছাড়লেন কেন? সেটা কি কাজের চাপে, না কি অন্য কিছু ব্যাপার ছিল?
কিচ্ছু অন্য ব্যাপার না। কাজের চাপে। ’৫৬ সালে যখন চাকরি ছাড়ল, তখন সতেরোটা ছবি। বছরে একশোটা কমিক শো, স্টারে থিয়েটার। পেরে উঠছিল না।
হঠাৎ একটা স্টেডি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, বাড়িতে তো ভয় পেয়ে যাওয়ার কথা
আমার শাশুড়ি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তখনকার দিনে দু’শো পঞ্চাশ কী দু’শো পঁচাত্তর টাকা মাইনের চাকরি। সোজা কথা!
শুনেছি, খুব খেতে ভালবাসতেন
মাংস! রবিবার হলে মাংস চাই-ই। (গৌতমবাবু বললেন, ইলিশের কথাটা বলো। বললেন) ইলিশ যে কী ভালবাসত, বলার নয়! শুকনো ভাতের ওপর ইলিশটা রাখত। একটু পরে মাছটা সরিয়ে অন্য জায়গায় ভাতের ওপর। আর মাছের অল্প তেল মাখা আগের ভাতটা খেয়ে নিত। তার পর আবার একই কাণ্ড! (হেসে ফেললেন, মা-ছেলে দু’জনেই। তার পর নীলিমা দেবী বললেন) এক নম্বরে ইলিশ। দু’নম্বরে কই। তিন নম্বরে ট্যাংরা।

রাজকন্যা ছবির একটি দৃশ্যে

যারা খেতে ভালবাসে, তারা সচরাচর বাজার করতে ভালবাসেউনি?
কস্মিনকালেও না। এ নিয়ে একটা গল্প আছে।
কী?
আমাদের এক ঠাকুর ছিল। নাম, যজ্ঞেশ্বর। সে-ই বাজারহাট করত। সে আমার বিয়ের আগে থেকে। এদিকে শাশুড়ি মাঝে মাঝেই বলতেন, কী যে ছাইপাশ বাজার করে যজ্ঞেশ্বরটা! একদিন ওকে বললেন, বাজারটা তুই গ্যালে, কী ভাল হয়, ক’ তো! শুনে বলল, ঠিক আসে। কাল থিকা অগো সাথে আমি যামু। তো ক’দিন তো গেল। শাশুড়িও খুশি। বলেন, দ্যাখছস তো, অহন কী সুন্দর বাজার হইতাসে! একদিন হল কী, বাজারের ব্যাগ থেকে আনাজপাতি বের করতে করতে শাশুড়ি বললেন, এইডার কী দাম লইসে রে। বলতে পারে না। শাশুড়ি আবার বলেন, হেইডার? তাও পারে না। অন্যদিন সব বলে দেয়। আজ পারে না কেন! ব্যাস, ধরা পড়ে গেল রহস্যটা। আসলে ও থলি হাতে বাড়ি থেকে বেরোতই শুধু। কিছুটা এগিয়ে থলে যজ্ঞেশ্বরকে দিয়ে দিত। সে-ই বাজার করত। ফেরার পথে দামটা জেনে নিত ও! এদিন যজ্ঞেশ্বর থলি ওর হাতে ধরিয়ে কোথায় যেন ভেগে পড়েছিল। দাম আর জানা হয়নি। ব্যাস, ধরা পড়ে গেল!
আচ্ছা, একটা অন্য কথাএই যে আপনি এত ভাল গান করতেন, রেডিয়োতেও গাইতেন, ফাংশনে গাইতেন, উনি কোনওদিন আপনার কাছে গান শুনতে চাইতেন না?
চাইত। একটা গান খুব শুনতে চাইত। ‘বাঁশি বাজাবে কবে আবার বাঁশুরিয়া’। নজরুলের গান। নজরুলের গান খুব ভালবাসত।
নজরুল ছাড়া?
পল্লিগীতি। শচীন কর্তার গান।
শচীনদেব বর্মনের সঙ্গে তো খুব ভাল সম্পর্কও ছিল
হ্যাঁ। দু’জনেই ইস্টবেঙ্গলের ভক্ত। তো, খেলা দেখতে গেলে শচীন কর্তার সিগারেটটা, পানটা ও-ই কিনে এনে দিত।
আচ্ছা, একটা কথা বলিভানু বন্দ্যোপাধ্যায় মদ্যপান করতেন, এ নিয়ে তো অনেক গল্প শোনা যায়!
(বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে) করত। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে খুব কড়া ছিলাম। তাই বাড়িতে খেত না। বাইরে খেত। এটা নিয়ে একটা গল্প আছে!
বলুন না
আমরা তখন অন্য একটা বাড়িতে থাকি। সেখানে দেড়তলায় আমাদের শোবার ঘর। ওর ফিরতে খুব রাত হত। তিনটে-চারটে বেজে যেত। আমি খেতাম না। মানে, ও না ফিরলে খেতে ইচ্ছে করত না। একদিন হয়েছে কী, দেখি একটা গাড়ি কেবলই আমাদের বাড়ির সামনে একটু দাঁড়াচ্ছে, আবার চলে যাচ্ছে। খেয়াল করে বুঝলাম, ওটা ছবি বিশ্বাসের গাড়ি। তার পর দেখি, কে একজন যেন লুকোচ্ছে অন্য বাড়ির গেটে। অনেকক্ষণ বসে দেখলাম। ব্যাপারটা ধরতেও পারলাম। ওই লুকোনোর চেষ্টা করা লোকটা ও-ই। নেশা করে এত রাতে বাড়িতে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। খুব রাগ হল আমার। এবার সেই রাগটা দেখাব কী করে? তো, কী করলাম, দিলাম দরজা বন্ধ করে। ওর মাথার বালিশ, পায়ের বালিশ সব বাইরে রেখে দিলাম। এবার কোন ফাঁকে বাড়িতে ঢুকে আমার দরজায় ডাকাডাকি শুরু করল। আমি তো টুঁ শব্দটি করছি না। নীচ থেকে আমার শ্বশুরমশাই দেখি চেঁচাচ্ছেন, ‘দেখো তো কী হল? দেখো তো! তার পর আমি দরজা খুললাম।

‘কাঁচামিঠে’ ছবিতে রেনুকা রায়, ছবি বিশ্বাস, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

ছবি বিশ্বাসের কথাটা যখন উঠলই, সেই গল্পটা আপনার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করছে
কোনটা?
কৃতান্ত বিশ্বাস
(হেসে ফেললেন) ও হো! সে সত্যিই এক কাণ্ড! (গৌতমবাবু বললেন, গল্পটা শোনার আগে একটা কথা বলি, বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বাবা যদি শ্রদ্ধায় এক নম্বরে কাউকে রেখে থাকেন, তিনি ছবি বিশ্বাস! শুনে নীলিমা দেবী বললেন) একদম ঠিক।
এবার গল্পটা
আসলে ছবি বিশ্বাস খুব এক্সট্রা ডায়লগ দিতেন স্টেজে। তো, একটা নাটকে ওর (ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়) নাম ছিল কৃতান্ত বিশ্বাস। এবার ও একদিন ঠিক করল, ছবি বিশ্বাসকে মঞ্চে একহাত নেবে! সেটা সুখেন দাস ছবি বিশ্বাসকে বলে দেয়। সেটা শুনে উনি বলেন, আজ আমি ভানুকে খাব। এর পর তো স্টেজ। ওরা দু’জন মুখোমুখি। ব্যাস শুরু হয়ে গেল। ছবিদা বললেন, তোমার নাম কী? বলল, কৃতান্ত বিশ্বাস। ছবিদা বললেন, কাউকে বিশ্বাস করবে না। উত্তর, আচ্ছা, ঠিক আছে। পাল্টা ছবিদা বললেন, কাউকে অবিশ্বাসও করবে না। ও বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার ছবিদার ডায়লগ, কাউকে বিশ্বাসও করবে না, অবিশ্বাসও করবে না। তাহলে কী করবে? এবার তো ও বিপদে। কী বলবে? এদিকে এত লোক দেখছে। তখন ছবিদার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, খুব অন্যায় করেছি, মাফ করে দিন। ছবিদা চাপা গলায় বললেন, কেন, খুব খেলতে এসেছিলে না? বল, বাড়ি গিয়ে ভাবব। তাই বলে পার পেল ও! এইসব কাণ্ডর জন্য তুলসী চক্রবর্তীর খুব অসুবিধা হত। উনি তো ট্রামে ফিরতেন। রাত ন’টায় শো ভাঙার কথা। সাড়ে ন’টা-দশটা হয়ে যেত।
তুলসী চক্রবর্তীকেও তো খুব শ্রদ্ধা করতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়
ও বাবা! একবার কী হয়েছে! ও (ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়) তখন সদ্য গাড়ি কিনেছে। থিয়েটারের শো হাতিবাগানে। কাছাকাছি পৌঁছে দেখে, এক বৃদ্ধ মানুষকে পাড়ার চ্যাংড়া সব ছেলেপুলে ধুতি ধরে টানছে। মাথায় চাঁটি মারছে। ভাল করে নজর করে দেখে, বৃদ্ধ মানুষটি তুলসীদা। প্রায় পেরিয়ে গেছিলেন। গাড়ি ঘুরিয়ে নেমে পড়লেন। তার পর শুরু করলেন মার। ছেলেগুলো তখন পালাতে পথ পায় না। ওর জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধুনা লুপ্ত বাড়ি

আচ্ছা, অন্য প্রসঙ্গে যাইঢাকা থেকে কলকাতায় এসে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারকে তো অনেকবার ঠাঁইনাড়া হতে হয়
অবশ্যই। ’৪১ সালে তো ইংরেজ পুলিশ ওর নামে হুলিয়া বার করে দিল। বিপ্লবীদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল। তার ওপর তখন এক ইনফর্মার খুন হয়েছে। সব মিলিয়ে ও সন্দেহভাজনের তালিকায়। বন্ধু গোপাল মিয়ার গাড়িতে কোনওক্রমে লুকিয়ে পালিয়ে এল। তখন ওঠে এক দিদির বাড়ি। এ পাড়াতেই। তার পর একটা সময় জুবিলি পার্কে। সেখান থেকে ৪২ এ, চারুচন্দ্র অ্যাভিনিউ-এ এই বাড়িতে একুশ বছরের লিজে। তার পর তো এই বাড়িটা ও কিনে নেয়। বাড়িতে লোকজনের যাতায়াত এত বেশি, সংসারটাও বড়। সব মিলিয়ে কুলোচ্ছিল না।
শুনেছি এ বাড়িতে পা রাখেননি, বাংলা ফিল্মের এমন কেউ নেই
ঠিক তাই। নাম বলে শেষ করা যাবে না।
তার মধ্যে দুএকজনের গল্প বলুন না সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে শুরু করি?
সাবিত্রীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক আত্মীয়তার। সাবুর বাবা ওর এক মামা। ওরাও বাংলাদেশি। এদিকে এসে বরং  সাবুকে ও আবিষ্কার করে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে। তখন ও ‘নতুন ইহুদী’ নাটকের জন্য একটা বাঙাল ছোট মেয়ের খোঁজ করছে। রাসবিহারী মোড়ের কাছে একদিন দ্যাখে, একটা স্কুলের মেয়ে খালি পায়ে বাঙাল কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। তখন ও তাকে গিয়ে বলে, এই, তুমি পার্ট করবা নাটকে? মেয়েটি তখন বলে, আমার বাবারে জিগান! এবারে ও মেয়েটির বাড়ি গিয়ে দেখে, তার বাবা সেই মামা। মেয়েটি সাবু। তার পর তো তাকে জামা-জুতো কিনে দেওয়া, থিয়েটারে নেওয়া, পরেও অনেক চান্স করে দেওয়া, এসব চলতে থাকে। ও তো আমাদের ঘরের মেয়ে। কিন্তু ঘরের না হয়েও ঘরের মতোই হয়ে গিয়েছিল কত জন যে! কাকে বাদ দিয়ে কার নাম বলব। জহর রায়, পুলু (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়), উত্তমকুমার, বিকাশ রায়, অনুপকুমার…!
মেয়েদের মধ্যে?
সেও ছিল। সুচিত্রা সেন, রুমা (গুহ ঠাকুরতা), গীতা দে, সন্ধ্যা রায়…।

 ‘একতারা’ ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়

আচ্ছা, এত বাঘা বাঘা সব সুন্দরী তখন! কারও সঙ্গে ওঁর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়নি?
(মাকে পাশে রেখে হাসিমুখে পুত্রের উত্তর, কেন, আপনার কাছে তেমন খবর আছে না কি? ততক্ষণে নীলিমা দেবী বলতে শুরু করেছেন) সব কেমন সম্পর্ক ছিল জানেন! জহর রায় আমার মেয়ের বিয়ের মেনু পর্যন্ত করেছেন ওর সঙ্গে কথা বলে। শাশুড়ি যখন মারা গেলেন, সারাটা রাত ছিলেন ওর পাশে। প্রত্যেকদিন শ্যুটিং যাওয়ার সময় ওকে ট্যাক্সিতে তুলে নিতেন। পুলুকে দেখুন। কী যে ভালবাসত ওকে। আর ও-ও খুব মানত পুলুকে। একবারের কথা বলি। ওর তখন খুব শরীর খারাপ। এদিকে ‘রঙ্গনা’-য় থিয়েটার। ১৯৭৯-’৮০ সাল হবে। হরিদাস সান্যাল প্রডিউসার। ও কিছুতেই অ্যাবসেন্ট হতে চাইত না। প্রডিউসারের লস হবে যে, তাই! সেবারও তেমন ব্যাপার। আমি পুলুকে ফোন করে বললাম। ও বাড়ি বয়ে এসে ওকে থামাল। বলল, আমি হরিদাস সান্যালের সঙ্গে কথা বলছি। তুমি চিন্তা কোরো না।
কিন্তু শুনেছি, উত্তমকুমারের সঙ্গে একটা সময় একটু মন কষাকষি হয়
হয়। সেটা অভিনেতৃ সঙ্ঘ থেকে বেরিয়ে উত্তমকুমার যখন ‘শিল্পী সংসদ’ করেন। একটা ভাগাভাগি তৈরি হয়ে যায় শিল্পীদের মধ্যে। কিন্তু সেই সম্পর্ক আবার ফিরে আসে মাস ছয়েকের মধ্যেই। ওটা নিয়ে ও পরে কিছুই মনে রাখেনি। উত্তমকুমারও না।
শেষ প্রশ্ন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে ভাঙনের শেষ নেইআর বিপর্যস্ত মানুষ সব থেকে বেশি ঈশ্বরের আশ্রয় নেন উনি?
কোনওদিনও না। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় শুধু আমার শাশুড়ির ছবিতে প্রণাম করত। পাশে একটা রামকৃষ্ণদেবের ছবি। সেখানে প্রণাম করত। ব্যাস। প্রায়ই একটা কথা বলত, জানেন!
কী?
আমার চেয়ে বড় কমিউনিস্ট আর কে আছে! আমার আসল নাম জান তো, সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়।

(প্রচ্ছদের ছবি : বিয়ের ঠিক দু’দিন পর নীলিমা দেবীর সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়)

ছবি: সৌজন্যে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

 

মতামত জানান

Your email address will not be published.