ক্রাইম আছে, হয়তো থ্রিলারও। কিন্তু শুধু তাই নয়। আর পাঁচটা ক্রাইম থ্রিলারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই উপন্যাসের বিষয় এবং উপস্থাপনা।
বিশ্বজিৎ পাণ্ডা
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নৈর্ব্যক্তিক’ বাংলা সাহিত্যের সীমানাকে কিছুটা ব্যাপ্ত করল। ফরেনসিক মেডিসিন, ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিকে বিষয় করে শুদ্ধেন্দু বিন্যস্ত করেছেন এই আখ্যান। এরকম একটি বিষয় নিয়ে বাংলায় সম্ভবত এর আগে কোনও উপন্যাস লেখা হয়নি। ডাক্তার লেখকের অভাব নেই বাংলায়। সেই সূত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয় হয়ে এসেছে বহু গল্প-উপন্যাসে। কিন্তু এখানে উঠে এল চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্য একটি স্তর, যার কিছুটা জানা, অনেকটাই অজানা।ন
লেখকের বিষয় নির্বাচনের মতো আঙ্গিক এবং বিন্যাসও অভিনব। অধ্যায় নয়, কুড়িটি ‘ভাগ’-এ বিন্যস্ত কাহিনি। প্রতিটি ভাগের স্বতন্ত্র নামকরণ। নামকরণের মধ্যে ঘটনাসূত্রের ইঙ্গিত। যেমন, প্রথম ভাগ ‘জগতে রহিবে নিত্য’; দ্বিতীয় ভাগ ‘আশুদার বাড়িঘর’; তৃতীয় ভাগ ‘ময়নাতদন্তের রিপোর্ট’; চতুর্থ ভাগ ‘একটি আশ্চর্য চিঠি’ ইত্যাদি।
বিখ্যাত ডাক্তার ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্ট আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন অজানা কারণে। ছাত্রাবস্থায় চমৎকার অভিনয় করতেন। তাও বন্ধ এখন। প্রায় অন্তরালে চলে যাওয়া মানুষটি আবারও সামনে আসেন সহপাঠী বন্ধুর একটি নাট্য প্রযোজনা ‘নৈর্ব্যক্তিক’-এর মঞ্চায়নের সূত্রে। সেই অভিনয় দেখতে আসেন আশুতোষ। সেখানে দেখা হয়ে যায় তাঁর কয়েক বছরের জুনিয়র কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক ডাক্তার অর্কপ্রভ সান্যালের সঙ্গে। একসময়ের দাপুটে সাড়া জাগানো অভিনেত্রী নাট্যসম্রাজ্ঞী কুসুমকুমারী দাসীর প্রত্যাবর্তন এই অভিনয়ে। মঞ্চে গান্ধারীর চরিত্রে অভিনয়ের সময় শেষ দৃশ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। দর্শকদের জানার কথা ছিল না যে কুসুমকুমারীর সত্যি মৃত্যু ঘটেছে নাকি অভিনয়ের জন্য পতন ও মূর্ছা। এই মৃত্যু স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক তাই ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই অর্কপ্রভ বিপদের মধ্যে পড়ে। আশুতোষ এই মৃত্যুর অন্তর্তদন্তে যুক্ত হয়ে যান। অর্কও আশুতোষের তদন্তের সঙ্গী হয়ে ওঠে। মোটামুটি এটাই কাহিনি।
উপন্যাস শেষ হয়েছে অর্কপ্রভর ভাবনায়— “…নৈর্ব্যক্তিকের কেন্দ্রীয় চরিত্র এমন কিছু, যার কোনো লিঙ্গ নেই, সে একাধারে পিতা ও মাতা, বিদেহী পুত্র ও কন্যা। তার সন্তান একাধারে ঋক, প্রমিতি, কিংশুক, নন্দন ও অগ্নিভ। সে বিশ্বরূপেণ! সে অজেয়। আমি অজান্তেই চোখ মুছি। পেরেছি আমি! মৃতদেহের মতো আমি আজ হয়তো খানিকটা হলেও অবচেতনের ব্যবচ্ছেদে পারদর্শী হতে পারলাম। ধন্য আশুতোষ!”
ফরেনসিক মেডিসিনের ডাক্তার অর্কপ্রভর কাজ শব ব্যবচ্ছেদ, মৃত মানুষের ময়না তদন্ত করা। আর ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্ট আশুতোষ করেন মনের ব্যবচ্ছেদ। সত্যের ব্যবচ্ছেদ। শব ব্যবচ্ছেদকারী ডাক্তার অর্কপ্রভ শেষ পর্যন্ত মানুষের মন ব্যবচ্ছেদে সক্ষম হয়েছে। বাইরের ময়না তদন্ত থেকে অন্তর্জগতের ময়না তদন্তে উন্নীত হয়েছে তার পারদর্শিতা। মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার উন্নতি ঘটেছে একটি অনুশীলনের মধ্য দিয়েই। এই অনুশীলন, এই যাত্রাই উপন্যাসের আখ্যান। এর মধ্যে অদ্ভুত একটি দার্শনিকতা আছে। ময়না তদন্ত এবং মনের তদন্ত স্বতন্ত্রভাবে জায়গা করে নিয়েছে এখানে। শেষ পর্যন্ত অন্তর্গত ব্যবচ্ছেদকেই লেখক প্রাধান্য দিয়েছেন।
“সত্যি মানুষের মনে ব্যবচ্ছেদ করা শিখতে হবে আমায়”; “সত্যের ব্যবচ্ছেদ আপনার মতো আর কেউ কখনও করতে পারেনি”; “ব্যবচ্ছেদের নীচে ব্যবচ্ছেদ কর”; “মনের ব্যবচ্ছেদ করতে শেখ”; “শরীরের ওপর পারে থাকে মনের ব্যবচ্ছেদ” ইত্যাদি কথাগুলি বার বার এসেছে। এর মধ্য দিয়ে লেখক চিহ্নিত করতে চেয়েছেন কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুকে। আর এখান থেকেই লেখকের অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়।
এহেন একটি উপন্যাসকে প্রকাশক ‘ক্রাইম থ্রিলার’ বলেছেন। না বললেই ভাল হত। আমরা লেখক, পাঠক, সমালোচক, প্রকাশক একটি সাহিত্য সৃষ্টিকে সবসময় সুনির্দিষ্ট খাঁচায় ফেলে দেখতে পছন্দ করি। কখনও থ্রিলার, কখনও ব্ল্যাক ম্যাজিক, কখনও ছোটদের লেখা, কখনও আঞ্চলিক সাহিত্য ইত্যাদি। এই প্রবণতা ঠিক নয়। আগের থেকে দাগিয়ে দিলে পাঠকও সেইমতো ভাবতে শুরু করেন। পাঠক্রিয়ায় উদগ্র হয়ে থাকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ। অন্তত শুদ্ধেন্দুর এই উপন্যাসটিকে শুধু ক্রাইম থ্রিলার হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না। ক্রাইম আছে, হয়তো থ্রিলারও। কিন্তু শুধু তাই নয়। আর পাঁচটা ক্রাইম থ্রিলারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই উপন্যাসের বিষয় এবং উপস্থাপনা। থ্রিলারে প্রাধান্য পায় বাহ্যিক ঘটনা ও তার অনুসন্ধান। আর এই আখ্যানে প্রাধান্য পেয়েছে মনস্তাত্ত্বিক একটি অনুসন্ধান। তা আপাত সত্যের থেকেও বড় সত্য।
কাহিনির অনেকটাই এগিয়েছে অর্কপ্রভর ভাবনায়। অর্কের চোখ দিয়েই দেখি আশুতোষকে। তাঁর অতীত। ২০১৩ সালে ইউএন এমব্যাসি উড়িয়ে দেওয়ার ছক করেছিল একটি জঙ্গি সংগঠন। আশুতোষের কৃতিত্বে সেই প্ল্যান বানচাল হয়। ইন্টারপোল, ইউনাইটেড নেশনসের ফেলিসিটেশন পাওয়া ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্টের অন্তরালে চলে যাওয়ার কারণ আবিষ্কার করে অর্কপ্রভ তাঁর কৃষ্ণনগরের বাড়িতে গিয়ে। একমাত্র ছেলে ঋক অজস্র স্কলারশিপ, মেডেল এবং অধ্যাপকদের প্রশংসা পেয়েছিল। মেডিসিন ছিল তার কাছে বেঁচে থাকার নেশার মতো। হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডেই দিনরাত পড়ে থাকত। তখন সে ইন্টার্ন। রাতে ঘুরতে ঘুরতে দেখেছিল একটি বেডের বয়স্ক মানুষ ঠিক মতো শ্বাস নিতে পারছেন না। তখন তার ডিউটি ছিল না। ছুটে গিয়েও সিস্টারদের বা সিনিয়র হাউসস্টাফ দিদিমণিকে পায়নি। কারণ তখন ডিউটি শিফ্ট হচ্ছিল। সে নিজেই একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার বয়ে এনে রোগীর নাকে নল লাগিয়ে রিসাসিটেশন করতে শুরু করে। এ বিষয়ে সে পারদর্শী। কিন্তু ততক্ষণে অবনতি হয়েছে পেশেন্টের। এরই মধ্যে অন-ডিউটি ডাক্তার, নার্স এসে ঋকের তৎপরতায় মুগ্ধ হন। কিন্তু রোগী মারা যান। রোগীর বাড়ির লোক স্থানীয় ছেলেদের সঙ্গে এনে ঋককে আক্রমণ করে। অক্সিজেন সিলিন্ডার আছড়ে মারে তার মাথায়। এর পর পাকাপাকিভাবে কোমায় চলে যায় সে। নানান স্তরের তৎপরতায় ধামাচাপা পড়ে যায় সব। তার পর থেকে আশুতোষ ছেলেকে নিয়েই থাকেন। ডাক্তারদের ওপর আক্রমণের খবর পেলে ছুটে যান।
এই সূত্রে এসেছে বর্তমানে ডাক্তারদের প্রতিমুহূর্তে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকা, জুনিয়ার ডাক্তারদের মার খাওয়ার ঘটনা। হাসপাতালে চাকরিরত ডাক্তারের নানা সমস্যার কথা। লেখক দেখিয়েছেন ডাক্তারদের নিরাপত্তার অভাবের সাম্প্রতিক চিত্র। চিকিৎসাকেন্দ্রিক এই বাস্তবতার ভাষ্য তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে কাহিনিতে। অক্ষৌহিণীর গোটা বাহিনীর সামনে ‘নিধিরাম সর্দার’ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা পুরো পেশা। একসময় ‘মেঘনাদবধ’ অভিনয় করা আশুতোষ মধুসূদন আওড়েছেন— “আনায়-মাঝারে বাঘে পাইলে কি কভু/ছাড়ে রে কিরাত তারে? বধিব এখনই,/অবোধ তেমতি তোর! জন্ম রক্ষঃকূলে/তোর ক্ষত্রধর্ম্ম পাপি, কি হেতু পালিব/তোর সঙ্গে ? মারি অরি, পারি যে কৌশলে।” সত্যি যেন নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ডাক্তারদের সকলকে ঘিরে ধরেছে শত্রুপক্ষ। সেখানে ন্যাশানালের তরুণ ডাক্তার বা বিষ্ণুপুরের গ্রামীণ চিকিৎসকের সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পার্থক্য প্রায় নেইই।
উৎসর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘গান্ধারীর আবেদন’ থেকে উদ্ধৃতি— “তোমরা, হে মহারথী, জড়মূর্তিবৎ/বসিয়া রহিলে সেথা চাহি মুখে মুখে…”। উপন্যাস পড়তে পড়তে বোঝা যায় এই উদ্ধৃতির গুরুত্ব।
কথাসাহিত্যে কবিতার এত সুন্দর প্রয়োগ ইতিপূর্বে চোখে পড়েনি। উপনিষদের শ্লোক, জয়দেব, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, ভাস্কর চক্রবর্তী, অনন্য রায়, জালালুদ্দিন বলখি রুমি প্রমুখ কবির কবিতার চরণকে চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন লেখক। সেই সঙ্গে গানের ব্যবহারও। নিধুবাবুর টপ্পা থেকে কুড়মালি ভাষার গান কাহিনিতে পৃথক মাত্রা যুক্ত করেছে। উপমাগুলিও কাব্যময়, ব্যঞ্জনাধর্মী। কাহিনিতে দুই ডাক্তারের ছাত্রাবস্থা থেকেই কবিতাপাঠের অভ্যেস থাকায় কবিতার প্রয়োগ অস্বাভাবিক মনে হয়নি।
কাব্যিক উপমার ব্যবহার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। উপন্যাসের পঞ্চম ভাগটির নাম ‘হে আমার সিন্ধুসারস’। এখানে সুন্দরী প্রমিতির সঙ্গে অর্কপ্রভর দেখা। কবিতাপ্রেমী ফরেনসিক ডাক্তার সুন্দরীর প্রেমে পড়ছে। এই অংশে জীবনানন্দ দাশের কবিতার উদ্ধৃতি এবং উপমা দেখা যাচ্ছে। যেমন—“উত্তরে আশুদা হেঁয়ালি করে বলল, ‘পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই-আর তার প্রেমিকের ম্লান/নিঃসঙ্গ সুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ/জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না…।” অথবা “পরিমলের আঁকা দুটি বিলীয়মান চোখ হয়তো গমন্যোদ্যত প্রমিতির প্রতি বলতে চাইল ‘নিঃসঙ্গ মুখের রূপ। বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ, জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না;’ বলা হল না।”
বর্ণনা এবং সংলাপকে ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে কবিতার ব্যবহার। এই ভাগের কয়েকটি উপমা— “বিষণ্ণ পৃথিবী ছেড়ে দলে দলে নেমে আসা সিন্ধুসারসদের মতো লাগছিল ওকে”; “প্রমিতির বামদিকের অনুপস্থিত দাঁতের ক্ষতিপূরণ করেছে তার শঙ্খমালাবৃত ঠোঁট”; “অবিচল শালিকের মতো প্রমিতি সেনের চোখেমুখে দৃঢ়তা ফুটে উঠছে”; “প্রমিতির চোখে আবার পদ্মপাতার জলকণা” ইত্যাদি। ঘটনাক্রম অনুযায়ী কোনও কোনও ভাগে মাইকেল মধুসূদন বা ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা বেশি করে ব্যবহৃত হয়েছে।
পরিবেশ অনুযায়ী উপমারও ব্যবহার করেছেন লেখক। যেমন ডুয়ার্সের জঙ্গলে মাঝরাতে হঠাৎ ট্রেন থেমে যাওয়া প্রসঙ্গে বলছেন— “বাইরে জোনাকিমিশ্রিত ঘন শাল-টিক-শিশু-শিরীষের পাহারাদারিতে অসহায় দলছুট হস্তিশাবকের মতো লাগছিল ট্রেনটিকে।”
ঘটনাক্রম অনুযায়ী উপমার ধরনও বদলে গেছে। যেমন ত্রয়োদশ ভাগ ‘যন্তরমন্তর’-এ রানাঘাটের ধ্বস্ত প্রতুল রত্নসেনের বাড়িতে গেছেন অর্কপ্রভ এবং আশুতোষ। সেখানে লেখক ব্যবহার করছেন—“ঊরুভঙ্গপ্রাপ্ত দুর্যোধনের মতোই আমাদের স্বাগতম জানালেন”; “মামলা-মকদ্দমায় আদ্যন্ত বিলাসবহুল মানুষটি যে চূর্ণিপারের মতোই ভেঙে পড়েছেন তা তার চোখমুখ দেখেই স্পষ্ট বলে দেওয়া যাবে”; “রত্নসেনের উদ্বিগ্নতা ক্রমশ উপচে ওঠা দুধের বাটির মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে লক্ষ করলাম”; “অশরীরীসুলভ স্বরে রত্নসেন বলে উঠল” ইত্যাদি। কবিতা ও কাব্যিক উপমার পাশাপাশি পৌরাণিক অনুষঙ্গের ব্যবহারও যথেষ্ট মুনশিয়ানার সঙ্গে করেছেন লেখক।
শুদ্ধেন্দু একজন কবিও। তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। তিনি সঙ্গীতচর্চাও করেন। তাই তাঁর গদ্যে এসেছে লিরিক মূর্ছনা। লেখকের পক্ষে এরকম কাব্যময় উপন্যাসটি লেখা সম্ভব হত না যদি না কবিতার প্রগাঢ় চর্চা থাকত। কিন্তু কাব্যিক অনুষঙ্গের কোথাও আবেগ বা দুর্বলতা নেই। আখ্যান কবিতার কাছে আত্মসমর্পন করে বসেনি।
উপন্যাসটি পাঠের ক্ষেত্রে পাঠকদের কাছে কিছু সমস্যা হতে পারে অপ্রচলিত, অচেনা শব্দের প্রয়োগে। ‘এরিকসনীয় দ্বন্দ্ববিধ্বস্ত’, ‘প্যারাপ্রাক্সিস’, ‘ওমেগা চিহ্ন’, ‘ডাউন সিনড্রোম’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। লেখক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণের কাছে অপরিচিত এসব শব্দের ব্যাখ্যা দেননি। দিলে ভাল হত। লেখক হয়তো চেয়েছেন পাঠকের অনুশীলন ও অভিনিবেশ। শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষা নয়, শুদ্ধেন্দু তৎসম শব্দ, অপ্রচলিত শব্দ, বিলুপ্তপ্রায় শব্দকেও বিশেষ গুরুত্ব-সহ প্রয়োগ করেন লেখায়। শব্দগুলিকে উদ্ধার করতে চান। তাঁর এহেন অনুসন্ধানী মননের জন্য সাহিত্যচর্চা উন্নীত হয় ভাষাচর্চায়তেও।
শুদ্ধেন্দু একজন ডাক্তার। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তাই অনায়াসে চরিত্রের মনের গহীনে প্রবেশ করতে পেরেছেন। অবচেতনের বিভিন্ন স্তরে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন তিনি। এ নিয়ে তাঁর যে অভিজ্ঞতা তা অন্য লেখকের নেই। এই অভিজ্ঞতা এবং যাপনচর্যা আলোচ্য উপন্যাসটিকে সমৃদ্ধ করেছে। তা সত্ত্বেও লেখক নিজে মগ্ন চরিত্র হয়ে যাননি। বাস্তব অভিজ্ঞতার রূপায়ন করেছেন সজাগ ও সচেতনভাবে। লেখকের এই নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গি উপন্যাসটিকে স্বমহিম করে তুলেছে। শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর ‘নৈর্ব্যক্তিক’ একটি সার্থক কাব্যিক এবং মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হয়ে উঠেছে।
নৈর্ব্যক্তিক
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
অভিযান পাবলিশার্স
৩০০ টাকা