হাসতে হাসতে ফেলে আসা সময়, নিজেদেরই প্রায় ভুলে যাওয়া কত কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে বইটার পাতায় পাতায়।
ঋতা বসু
বাঙালি আড্ডাপ্রিয় জাত— এইটি আমাদের জাতীয় বিশেষণ। অন্তত এই একটি ব্যাপারে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ সবাই যে একমত হবেন এতে সন্দেহ নেই। তার আড্ডা কালচার রক থেকে রাজপ্রাসাদ, সিংহদুয়ার থেকে যমদুয়ার একই রকমের নিরেট ও নিরবিচ্ছিন্ন। আড্ডার স্থান-কাল-পাত্র যাইহোক না কেন, একটা ব্যাপারে আড্ডাচরিত্রের বিস্তর মিল, তা হল হাস্যরসের চর্চা। শ্লেষ, ব্যঙ্গ, অদ্ভুত- হাসিরই যে কতরকম। আড্ডাভেদে সবগুলোরই দেখা মেলে। ঠান্ডা, গরম, হালকা, গভীর, পুরুষ, রমণী— আলোচনার বিষয়বস্তু যা-ই হোক না কেন, হাস্যরসই কিন্তু এইসব আড্ডার প্রাণ। হালুয়া থেকে হুইস্কি, অনুপানভেদেও রসের বিকার ঘটে না। আড্ডা মানেই উঠছে হাসি ভসভসিয়ে সোডার মতো পেট থেকে।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই কথাগুলোই যখন বাঙালি শব্দবন্ধনে বাঁধতে চায় তখনই তা গম্ভীর করুণরসে চপচপিয়ে ওঠে। আড্ডায় মুখের কথায় যা ছিল নির্ভার ডানামেলা প্রজাপতি, সাহিত্যের আঙিনায় তা-ই হয়ে গেল গম্ভীর রামগরুড়ের ছানা। হাসি যে শুধু ‘নেই’ হয়ে গেল তা নয়, তাকে অপাঙ্ক্তেয় ভেবে বিদ্বজ্জনেরাও মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
বঙ্কিমী কায়দায় বলা যায়— বস্তুকথা হইল— হাস্যরস নির্মাণ খুব কঠিন। সামান্য বেচাল হলেই গেল। পপাত চ মমার চ। পাঠক খুবই নির্দয় সমালোচক এ ব্যাপারে। হাসি না কি ভাঁড়ামি? হাসিরও আছে মোটা-সরু। এক দাগ এদিক-ওদিক হলেই প্রাণদায়ী ওষুধ বিষ হয়ে যায়। তবু যদি বা ব্যঙ্গরসের দেখা মেলে, নির্মল হাস্যরস বাংলা সাহিত্যে প্রায় ডোডোপাখি। তারাপদ রায়, নবনীতা দেবসেনের পর নির্মল সহজ সরল হাসিটা যেন আর চোখেই পড়ছিল না। এই সময়ে হাতে এল সুন্দর মুখোপাধ্যায়ের ‘নিছক রসিকতা’। প্রথমেই অবাক হতে হয় বিষয় নির্বাচনে। একেবারে মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রাণের, মনের জিনিস। গৃহশিক্ষক, উপহার, সেকেন্ড হ্যান্ড, দরখাস্ত, টিফিন, ছাদের ঘর, পাড়ার ছেলে, গামছা— আরও কত। শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী— কারে রেখে কারে ফেলি।
হাসতে হাসতে ফেলে আসা সময়, নিজেদেরই প্রায় ভুলে যাওয়া কত কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে বইটার পাতায় পাতায়। টুথপেস্ট, গায়ে মাখা সাবানের শেষ বিন্দু কাজে লাগাতে আমরা সকলেই কমবেশি স্ট্রাগল করেছি। কিন্তু সদ্ব্যবহার কতদূর যেতে পারে নিছক রসিকতায় তার চরম উদাহরণ— চলে যাওয়া মানুষের রেখে যাওয়া বাঁধানো দাঁতের পাটি এমনকি মায়া করে রেখে দেওয়া পোকাধরা দাঁতও যে কখন কীভাবে গৃহস্থের কাজে লেগে যায় তা কে জানে?
সুন্দর মুখোপাধ্যায়ের বৈশিষ্ট্য হল একটি রসালো মন নিয়ে দুলকি চালে পথ চলা। তাঁর সঙ্গে প্রসন্ন মনে স্মিত ঠোঁটে পাঠকও চলছেন। প্রসন্ন রসই হল এ লেখার প্রাণ। পথ চলতে গিয়ে লেখক এমন সব দুর্মূল্য মণিমানিক্য সংগ্রহ করেছেন যা দেখেছি সবাই, কিন্তু কারও নজরে পড়েনি। বইটার পাতায় পাতায় উদ্ধৃতি দেবার মতো ঝিকিমিকি হিরে, অন্যকে দেখানোর লোভ সামলানো দায়। সর্বনাশ সামান্য চেহারা পাল্টে যে এমন সব্বোনেশে হতে পারে তা তো আগে জানাই ছিল না। এমন কত বুকের পাটাওলা সংলাপ যা অনায়াসেই প্রবাদ হবার যোগ্যতা রাখে। ফাইনাল পরীক্ষার বুকচাপা ভয় কত সহজে নস্যাৎ করা যায়, তাকে সেমিফাইনাল ভাবলে— এই অসাধারণ জ্ঞানটি তো মনোবিদদের কাজে লাগার মতো।
তবে সম্ভাব্য পাঠকের জন্য একটি সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি না দিলেই নয়। এত সরস জিনিসের সবটা আস্বাদন করলে যতটা তৃপ্তি, খণ্ডিত চেহারায় রসের হানি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। তবু মিষ্টান্ন বিতরণের লোভ সামলানো মুশকিল। একটি শিহরণ জাগানোর মতো লিফলেট—
“সন ১৩৫৭, বৈশাখ
বোকা ছেলেও সসম্মানে পাশ দিবে
সতীন ও শাশুড়ি উভয়েই হার মানিবে
পরস্ত্রী আপনাকে স্বামী জ্ঞানে দেখিবে
এবং
গেঁড়ে বন্ধ্যা মহিলারও সন্তান হইবে।।
(নিজ স্বামীকৃত)”
ভাবা যায়?
একসময় বাঙালির পাড়া ছিল এবং তার অবশ্যম্ভাবী অলংকার হিসেবে পাড়ার ছেলেও ছিল। তাদের বীরত্ব, ত্যাগ, প্রেম নিয়ে মহাকাব্য রচনা হতে পারে। সুন্দর মুখোপাধ্যায় তার দু-একটা অনবদ্য নমুনা তুলে এনেছেন। তার সঙ্গে উপরি পাওনা ষাটের দশকের পাড়া। খুব হালকা হাসির ছলে বলা হলেও সেই সময়ের মনটা ধরা আছে অনবদ্য একটি ছবিতে যেখানে কোনও একটি মেয়ের ওপর বন্ধুর দুর্বলতা জানতে পারলেই সে বাকি সকলের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যেত। সেই দূরবর্তিনী জানতেই পারল না, সে সমবেতভাবে বন্ধুপত্নীর মর্যাদা লাভ করেছে। আজ সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই।
শেষ দুটি লেখা ‘রাতের স্টেশন’ আর ‘আমার মতো দেখতে’ পড়লে হাসতে হাসতেই হঠাৎ মেঘ ঘনিয়ে আসে চিতে।
রাতের ওয়েটিং রুমের সেই মহাজ্ঞানী ভদ্রলোকের অসাধারণ সংলাপ— “সংসারে দুই সংখ্যাটা খুব গোলমেলে। সবসময় ঠোকাঠুকি লেগেই থাকে— প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, শাশুড়ি-বউমা— অবিশ্বাস করলে বিবেকযন্ত্রণা, বিশ্বাস করলে ঠকবার সমূহ সম্ভাবনা। ভেবে দেখেছেন?”
যথারীতি সুন্দরের স্পেশাল বাচনভঙ্গিতেই প্রসন্ন হাসির প্রসাদগুণ অক্ষরে অক্ষরে ছড়িয়ে এগিয়েছিল আমারই মতো দেখতে আর একজনের অস্তিত্বের অনুভব। হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম সাধারণ বিশেষত্বহীন মানুষের ভিড়ে।
“গাছে একইরকম দুটো গোলাপ পাশাপাশি ফুটে থাকে, একইরকম দুটো আম দিব্যি পাশাপাশি দোল খায়। তাহলে ঈশ্বরের বাগানে নিশ্চয়ই দুটো আমিও আছে।
আমার মত আর যারা আছেন তাঁদের চুপিচুপি বলি, একটু চোখ কান খোলা রাখবেন। আমি আছি আপনার সামনে পেছনে, আশেপাশে কোথাও না কোথাও। শুধু দেখা হচ্ছে না এই যা।”
বইটা বন্ধ করে ভাবলাম— সত্যিই কি এটা নিছক রসিকতা?
গুরুগম্ভীর সভার মতো এটা বলে শেষ করি, লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট— বইটার ইউনিক উৎসর্গপত্র বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। মা-বাবা, স্ত্রী, আত্মীয়-বন্ধু, জীবিত-মৃত এমনকি অদেখা মানুষকেও বই উৎসর্গ করতে দেখেছি। কিন্তু গৃহপরিচারিকাকে এই প্রথম। তিনি স্বাক্ষর কি নিরক্ষর জানি না। কিন্তু এই অমূল্য দান তাঁর প্রতিই নিবেদিত। কেউ ভাবতে পারেন লেখার জন্য প্রতি পদে নিরবচ্ছিন্ন সুবিধে করে দেবার জন্য হয়তো আপন গৃহসেবিকার প্রতি এই কৃতজ্ঞতা। কিন্তু সকলের জ্ঞাতার্থে জানাই— এই মহীয়সী মহিলা বহুদূরের বাসিন্দা এক বন্ধুর বাড়ির পরিচারিকা। সেইজন্যই উৎসর্গপত্রটি এত ইউনিক।
নিছক রসিকতা
সুন্দর মুখোপাধ্যায়
সৃষ্টিসুখ
১৯৯ টাকা