ঝাড়খণ্ডে হয়তো নদীর বুকে হাত পড়েনি কিন্তু অঢেল খনিজের লোভে বুক ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে মাটির। সরল, সাদাসিধে আমাদের আদিবাসী মানুষগুলোকে শুধু দু’বেলা খাবারের লোভ দেখিয়ে ভ্রষ্ট করা হচ্ছে। চলে যাচ্ছে তাদের পাহাড়, জঙ্গল, জল, নারী, প্রেম। সন্ধেয় নদীর জলে গা ধুয়ে এসে আর বুঝি মাদলের সঙ্গে নাচে না সাঁওতাল রমণী, সেখানে তখন চটুল হিন্দি গান আর পীড়াদায়ক নাচ।
অমিতাভ হালদার
কাঁটায় কাঁটায় আটটায় রওনা হয়ে দু’ঘণ্টায় দুর্গাপুর পৌঁছল পূর্বা। পুবের দেশে আসে কিনা, তাই পূর্বা। আপাতত পশ্চিমে। মানে বাপের বাড়ি? দিল্লি। আমি অবশ্য শালির বাড়ি, নিতান্ত অনিচ্ছায় এবং সে কথা মুখ ফুটে বলবার মতো সাহস নেই। তাই মেয়ে, তার দোর্দণ্ডপ্রতাপ মা এবং মেয়ের মুখঝামটা খেতে খেতে তার মা মানে আমার শাশুড়ি সমভিব্যাহারে আপাতত আলিগড় অভিমুখে। আপাতত বলছি কারণ ওখান থেকে কোথায় যাওয়া হবে তার কিছু ঠিক নেই। এমনও হতে পারে কোথাও না গিয়ে শালির বাড়ি চর্বচোষ্য খেয়েদেয়ে ভেবলুর মতো বাড়ি ফিরলুম।
রাজধানীর আগে পূর্বার খুব কদর ছিল। একটা খানদানি ব্যাপারও ছিল। এখন সে দিন গেছে। নইলে হাওড়া থেকে ছেড়ে কামারকুণ্ডু আসতে না আসতে টয়লেটে জল থাকে না কেন? দুর্গন্ধে নাকে কাপড় দিতে হয় কেন? তাহলে এতখানি রাস্তা? কী হবে রে বাবা। আসানসোলে কামরা ফিনাইল দিয়ে সাফসুতরো হল, কিন্তু টয়লেটে জল এল কি? চকচকে রোদ উঠেছে। এতক্ষণ জানলা খোলা যায়নি, এবার খোলা যেতে পারে বোধহয়। ট্রেন এবার চিত্তরঞ্জনের দিকে।
চিত্তরঞ্জন স্টেশনটির আগের নাম ছিল মিহিজাম। এটা কিন্তু ঝাড়খণ্ড। আমরা আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যে প্রবেশ করছি। স্বাধীনতার পর চিত্তরঞ্জন লোকোমেটিভ স্থাপিত হওয়ার পর স্টেশনের নামও বদল করা হয়। এটি খুব পরিচ্ছন্ন শহর। জানা গেল প্রায় আট থেকে দশ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এই রেল ইঞ্জিন কারখানার বিস্তার। শুধুমাত্র রেল কোয়ার্টারই আছে প্রায় দশ হাজার। কী আশ্চর্য! স্টেশন পেরোল আর যেন ভোজবাজির মতো বদলে গেল দৃশ্যপট। রুক্ষতা, কৃশতায় বদলে গেল সবুজাভা। ঘাসজমি, কাঁটাজাতীয় ঝোপঝাড়, হঠাৎ কোনও দীর্ঘ দিঘি, তাতে ডুবে আছে মোষ, মাটির রাস্তায় চলেছে মোষের গাড়ি। চাষাবাদ খুব কিছু নেই। বিস্তীর্ণ মাঠে কাছে-দূরে তাল, খেজুর, শাল, সেগুন, পলাশ, শিমুলের পাড়া। বুক চিরে কালো পিচের রাস্তা। ছোট ছোট কাঁচা-পাকা বাড়ি। কী একটা ছোট্ট স্টেশন পেরোল, অথচ দু’দিকেই চোখ যতটা গেল জনবসতির চিহ্ন নেই। কারা যে কোথা থেকে ট্রেন ধরতে আসে! কোন ট্রেন কখন থামে তা এখানকার মানুষরাই জানে। পিচের রাস্তাটা ডানদিক থেকে বাঁদিকে চলে গেল। এখনও পাল্লা দিচ্ছে আমাদের সঙ্গে। দেখা যাক ওর দৌড় কত।
“মধুপুরে পাশের বাড়িতে তুমি থাকতে।” শ্রাবন্তী মজুমদারের গান। ট্রেন মধুপুর স্টেশন ছেড়ে এগোচ্ছে যশিডির দিকে। প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু নিয়মিত উশ্রীর তীরে পায়চারি করতে যেতেন না? এখান থেকে কিছু দূরেই দেওঘর। এসব জায়গার নাম শুনলেই মনে হয় নেমে পড়ি কোনও একটায়। উনিশ, বিশ শতকের বহু বাঙালির স্বাস্থ্যোদ্ধারের, ছুটি কাটানোর জায়গা এসব। বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায় এসব জায়গার বর্ণনা। এখনও বহু পরিত্যক্ত প্রাসাদোপম বাঙালির বাড়ি স্রেফ ভূতের বাড়ি হয়ে পড়ে রয়েছে। বাঙালির পর্যটন বদলে গিয়ে হয়েছে তীর্থ পর্যটন। দেওঘরের শিবের জন্য, অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ বিহারের জন্য।
জশিডির আশপাশের এলাকা সত্যিই নয়নাভিরাম। উঁচু-নিচু ঢেউখেলানো মাটি, হালকা জঙ্গলের মতো গাছপালা, মাঝে মাঝেই তালাও, শীর্ণ জলধারা। পা ডুবিয়ে বসে থাকা যায় শীতকালে রোদ পিঠ করে, গরমে গাছের ছায়ায়। মনে হয় দেশের অবিরাম অস্থিরতা থেকে পালিয়ে এরকম প্রকৃতি আশ্রয় করে দিন কাটিয়ে দেওয়া যেত যদি? সুন্দর, শান্ত রাজ্য এই ঝাড়খণ্ড। প্রকৃতি উদার, মগ্ন। পরপর কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে তিন-চারটি ছোট-বড় নদী পার হলাম। ঠিক যেন আমাদের ছেলেবেলার দামোদর। মানুষের লোভী হাত বুক খুঁড়ে তুলে নিয়ে গেছে বালি, তাই দামোদর আরও বিধ্বংসী এখন। ঝাড়খণ্ডে হয়তো নদীর বুকে হাত পড়েনি কিন্তু অঢেল খনিজের লোভে বুক ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে মাটির। সরল, সাদাসিধে আমাদের আদিবাসী মানুষগুলোকে শুধু দু’বেলা খাবারের লোভ দেখিয়ে ভ্রষ্ট করা হচ্ছে। চলে যাচ্ছে তাদের পাহাড়, জঙ্গল, জল, নারী, প্রেম। সন্ধেয় নদীর জলে গা ধুয়ে এসে আর বুঝি মাদলের সঙ্গে নাচে না সাঁওতাল রমণী, সেখানে তখন চটুল হিন্দি গান আর পীড়াদায়ক নাচ। এরই নাম বুঝি উন্নয়ন, এটিই বুঝি সভ্যতা। আগম্তুক ছবিটির কথা বড় মনে পড়ে। মনে পড়ে তথাকথিত সভ্য, শিক্ষিত মানুষের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে স্বয়ং বিদ্যাসাগর শেষজীবনটা কাটিয়েছেন কর্মাটাঁড়ে।
ঝাঁঝার পরে বেশ কিছু চাষাবাদ দেখা গেল। মূলত সরষে, গম। ঝাঁঝা বিহারে। পরের স্টেশন জামুইয়ে এলাম যখন, ট্রেন আধ ঘণ্টা মতো দেরিতে চলছে। জামুই থেকে কাছাকাছি এক বহু প্রাচীন জৈন মন্দির রয়েছে ক্ষত্রিয় কুণ্ড্ গ্রামে যেখানে মহাবীরের কষ্টিপাথরের মূর্তিটি নাকি প্রায় বাইশশো বছরের পুরনো। ওই গ্রামেই মহাবীরের জন্ম বলে দাবি করলেন ট্রেনের সহযাত্রীরা যাঁরা বারবার অনুরোধে আমাদের রিজার্ভ করা সিটে বসে যাওয়ার অনুমতি আদায় করেছেন।
কিউল স্টেশনটি বিখ্যাত কিউল নদীর নামানুসারে। ঝাড়খণ্ডের গিরিডি জেলার তিসরি পাহাড় এলাকায় এর উৎপত্তি। এই কিউল নদী উপত্যকায় বহু প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং কালের নিয়মে ধ্বংসও হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাজের আদর্শ ক্ষেত্র এই উপত্যকা। প্রাগৈতিহাসিক প্রত্ন নিদর্শনও পাওয়া গিয়েছে। বৌদ্ধ স্তূপ, বৌদ্ধ বিহারের কথা উল্লেখ করেছেন হিউয়েন সাং। বহুবছর পাল বংশের শাসন ছিল এখানে। একটানে এতটা পথ এলাম, সবুজ দেখে যাচ্ছি। সরষে, গম। আসলে নদী যেখানে সেখানে শস্য, মানুষ, সভ্যতা।
মোকাম শব্দটি থেকে মোকামা। মোগল ও বৃটিশদের সময়ে সেনাবাহিনীর দীর্ঘ যাত্রাপথে বিশ্রামস্থল বা অবশ্য গন্তব্য হিসেবে ব্যবহৃত হত মোকামা। পুরাণকথায় ঋষি বিশ্বামিত্রের সাধনস্থল ছিল এই স্থান। এ অঙ্গ দেশ। যুবরাজ দুর্যোধন মিত্র কর্ণকে এই দেশের রাজা করেছিলেন। খুব দূরে নয় সীতার দেশ মিথিলা। জানা গেল মোকামায় বিশ্বামিত্রের মন্দির আছে। আর আছে বিখ্যাত মাদার মেরির চার্চ। ডিসেম্বরে চার্চের চৌহদ্দি জুড়ে মাতা মেরির মেলা হয় খুব জমজমাট।
এই মোকামায় ধরা পড়েন প্রফুল্ল চাকী। বলা হয়, তাঁর নাকি মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল। দাহ হয় মুণ্ডহীন শরীরটুকু। সভ্য ইংরেজ। মোকামায় গঙ্গার জলবিধৌত এক বিশাল তালাও রয়েছে যা কিনা এই এলাকার শস্যশ্যামলিমার মূল কারণ। পাশাপাশি রয়েছে অপরাধপ্রবণতা যার ইতিহাস বহু প্রাচীন। ধনী-নির্ধনের চিরায়ত দ্বন্দ্ব আর অসম যুদ্ধ। উচ্চবর্গের ভূমিহার ও নিম্নবর্গের কৃষি-মজুরদের মারামারি। নিম্নবর্গের জাত্যাভিমান নিয়ে প্রচলিত কাহিনি চুহারমল ও রেশমার কথা বিহার জুড়ে সংগীত ও নৃত্যে অভিনীত হয়। চুহারমল হলেন নিম্নশ্রেণির মানুষের বীর প্রতিনিধি যিনি ভূমিহারদের সঙ্গে লড়েন ও জয়লাভ করেন এবং ভূমিহার কন্যা রেশমাকে বিবাহ করেন। কিন্তু এই কাহিনির নানান পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যায় ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বিহারে চারটি ভয়ানক জাতিদাঙ্গা হয় যার ফলে মূলত নিম্নবর্গের মানুষের প্রাণ যায়।
এই মোকামা ও সন্নিহিত অঞ্চলকে বিহারের শস্যভাণ্ডার বলা যেতে পারে। চারদিকে চোখ জুড়োনো সবুজ। ফলাচ্ছেন যাঁরা তাঁরা হয়তো এখন হাতজোড় করে মালিকের উঠোনের বাইরে দিনের সামান্য মজুরিটুকুর জন্য অপেক্ষমান।
হ্যাঁ, এটা জানিয়ে রাখি, মোকামার পর থেকে আমরা রিজার্ভ সিটে কোণঠাসা হয়ে বসে। বাকিরা বেশ আরামে ঠেস দিয়ে বসে যাচ্ছেন। অন্য অনেকে আমাদের দিকের লোকাল ট্রেনের মতো দাঁড়িয়ে চলেছেন। সম্ভবত সকলের গন্তব্য পাটনা।
দশম শিখ গুরু গোবিন্দ সিং পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন ১৬৬৬-তে। আনন্দ সাহিব চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি এখানে ছিলেন। তাঁর স্মৃতিতে রণজিৎ সিং পাটনা সাহিব গুরুদ্বার নির্মাণ করেন। এই পাটনা সাহিবে গুরু নানকও এসেছেন।
পৌরাণিক সময় থেকেই বিহার এক অতি পবিত্র তীর্থ, মহান সভ্যতা। পূর্বতন মগধের রাজধানী পাটলিপুত্র। সম্ভবত অজাতশত্রু নির্মাণ করেন এই নগরী। তামিল শব্দ পত্তম বা পতনম্ থেকে পাটনা হয়ে থাকতে পারে, যার অর্থ বন্দরনগরী। আমাদের সিঙ্গুরে সিংহলপাটন বলে একটি গ্রাম রয়েছে যেখানে রাজা সিংহবাহু রাজত্ব করতেন। তাঁর পুত্র বিজয়সিংহ সিংহল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সিংহলপাটনও একসময় সরস্বতী নদীতীরস্থ বন্দর ছিল। মৌর্য ও গুপ্ত বংশ এই মগধে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। অবশ্য কারা নন? কুষাণ, পাল, পরবর্তীকালে সুলতান, মোগল, বৃটিশ, কে নেই এই সুপ্রাচীন ইতিহাসে? কত না উত্থানপতন সে ইতিহাস জুড়ে। প্রাণহানি, রক্তক্ষরণ। আবার পাশাপাশি গৌতম বুদ্ধ, তীর্থংকর মহাবীরের অহিংসার মন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও প্রচারে পাটলিপুত্র অধুনা পাটনার মাটি এখনও কথা কয়ে যায়। শোনার মতো সময়, মন আর কান আধুনিক মানুষের ক’জনেরই বা আছে?
সেই পাটনা ছেড়েছি। দানাপুর ছেড়ে ট্রেন এখন আরার পথে। দানাপুর নামটি সম্ভবত দানবপুর থেকে তৈরি হয়ে থাকতে পারে। ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম সেনা ছাউনি দানাপুরে, প্রথমটি পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে।
অরণ্য থেকে আরা বলা হয়ে থাকে। ঋষি বিশ্বামিত্রের আশ্রম ছিল এই অরণ্যে যেখানে রামচন্দ্র এসেছিলেন বলে কথিত। মহাভারতে ভীমসেন আরায় বকাসুরকে বধ করেন। সেই থেকে আরা বন প্রসিদ্ধ হয়। আবার অন্য একটি মতে, রাজকুমার সিদ্ধার্থ এই অঞ্চলে এসেছিলেন সন্ন্যাসী আরাদ- এর টানে। যাঁর প্রভাবে তিনি বিলাসব্যসন ত্যাগ করে গৃহত্যাগ করেন বোধিলাভের জন্য। সিপাহি বিদ্রোহের সময় বাবু কুঁয়র সিং বৃটিশের বিরুদ্ধে সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে বহু জায়গায় তাদের পরাস্ত করেন। তখন তাঁর বয়স আশি বছর। তাঁর নামে আরায় বীর কুঁয়র সিং বিশ্ববিদ্যালয় আছে।
আরা ছাড়িয়ে ট্রেন ছুটছে বক্সারের দিকে। সন্ধ্যা নেমেছে ইতিহাসের মগধ জুড়ে। মুখের ওপর কালো ওড়না টেনেছে পৃথিবী। ঠিক সময়ে ছুটছে ট্রেন। এই প্রথম চাইছি অন্তত দু’ঘণ্টা লেট করুক, নইলে ছ’ডিগ্রি ঠান্ডায় ভোর সাড়ে তিনটেয় নামতে হবে কাল।
নামতেই হল সেই। আলিগড়। শহরটা সেরকম কিছু উল্লেখের দাবি রাখে না। প্রচুর মানুষ, প্রচুর ইট, পাথর, সিমেন্টের গাঁথনি। সবুজের অভাবের কারণেই মানুষগুলোও যেন কেমন একটু ম্রিয়মাণ। প্রাণের, আনন্দের অভাব যেন। অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, খোলা নর্দমা, মাঝে মাঝে জঞ্জালের স্তূপ, ধুলো, নিজের নিয়মে গাড়ি চালানোর প্রবণতায় রাস্তায় ভয়ঙ্কর জ্যাম। মোড়ের মাথায় ট্রাফিক পুলিশও সেরকম নেই। অনেকটা যেন যা হয় হোক গে যাক, এরকম মনোভাব প্রশাসনের।
সময় কাটানোর জন্য একবার শহরের একটি পাইকারি সবজি মান্ডিতে যাওয়া হল। বাজার খুব একটা করা হয় না কিন্তু গ্রামের এই মাটিমাখা মানুষজন যাঁরা সবজি বিক্রি করেন, দরদাম নিয়ে হাঁকাহাঁকি করেন তাঁদের বড় আপন মনে হয়। আর ভাল লাগে বাজারের গন্ধ, মশলা পেষাই কলের গন্ধ, গম ভাঙানোর গন্ধ, এমনকি তেলকলের গন্ধও। জানি, এই মানুষগুলো আমাদের আপন মনে করেন না। আবার সমাজের অভিজাত শ্রেণির মধ্যেও আমাদের প্রতি অনপনেয় অবজ্ঞা। তাই মধ্যবিত্ত মানুষগুলো ঘরেও নহে, পারেও নহে, ঘাটের কিনারায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নিয়ে কী করবে ঠিক করে উঠতে পারে না। সবজির দাম বাংলার চেয়ে কিছুটা চড়া। নতুন আলু ১৭০০ টাকায় ৫০ কেজি, মাঝারি সাইজ ফুলকপি ১৭ টাকা। বাঁধাকপি দেখলাম না। প্রচুর শালগম রয়েছে আর গদার মতো সাদা মুলো। শাক রয়েছে অনেকরকম তবে আমাদের ওখানের বাজারে আরও বেশি রকমের শাক পাওয়া যায়। পেঁয়াজ ৫৫ টাকায় নেওয়া হল। পাইকারি বাজারের হইহুল্লোড়, দরাদরি, জল-কাদা, ভাঙা রাস্তা, মানুষ আর গোরুর পাশ কাটিয়ে চলা দায়। বাজারের জিনিস খেয়ে খেয়ে গোরুগুলোর চেহারা কী রে ভাই। সাহসও খুব, ব্যাগ থেকে টেনে শাক খেয়ে নেয়। দু-একটাকে বেশ বদমেজাজি মনে হল। ঘোড়ার গাড়িও অনেক, ওই সরু রাস্তায় রিকশা, টোটো সব ঢুকে পড়ছে। মোটরসাইকেলে বড় বড় বস্তা চাপিয়ে পাইকাররা ঘোরাঘুরি করছে। কেউ কাউকে পাশ দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আবার নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে রাস্তা বের করছে। মুসলিম প্রধান শহর (সেনসাস রিপোর্ট তা বলে না, সেখানে ৫৩ শতাংশ হিন্দু বলা হচ্ছে)। ফেজ টুপি, চোগা-চাপকান, মুখে দাড়ি অনেক ব্যবসাদার, ফড়ে, নিতান্তই সাধারণ বিক্রেতা ইতিউতি ঘুরছেন, বেচাকেনা করছেন। বেশ একটা মধ্যপ্রাচ্যের বাজার বা আরব্য রজনী বর্ণিত জায়গাগুলো বা পুরনো দিল্লি, আগ্রা এসবের কথা মনে পড়ায়।
আলিগড়ে বহু প্রাচীন এক দুর্গ বা কেল্লা রয়েছে। সে কেল্লার কোনও জেল্লা তো দূরস্থান, সামনের পরিখা ঘেঁষা বেশ শক্তপোক্ত প্রাচীর আর ইতিউতি দু-একটা ইট-পাথর ছাড়া আর কিচ্ছুটি নেই। অথচ দিল্লি তো বহুত দূর নয়। সেখানে অনেক কেল্লাই সযত্নে রক্ষিত। যেটুকু জানা গেল, ইব্রাহিম লোদীর শাসনকালে এখানকার শাসক মহম্মদ এই দুর্গটি বানান। নাম দেন মহম্মদগড়। সময়টা ১৫২৪-২৫। এর প্রায় দুশো বছর পরে মূলত দুর্গটির আধুনিকীকরণ সম্পন্ন হয় ১৭৫৯ সালে প্রথম মাধবরাও সিন্ধিয়ার নেতৃত্বে ফরাসি জেনারেল বেনোঁ দ বোয়েঁর কর্মকুশলতায়। অত্যন্ত দক্ষ আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত এক সেনাদল গড়ে তোলেন তিনি। এর পর ১৮০৩ সালে বৃটিশ-মারাঠা যুদ্ধে আলিগড় দুর্গের মালিকানার হাতবদল হয়। বৃটিশ জেনারেল লর্ড জেরার্ড লেক জয়লাভ করেন। ১৮৫৭- র সিপাহি বিদ্রোহে সিপাহিরা এক অসাধারণ মানবিকতার নিদর্শন রাখেন। দুর্গ দখল করলেও তাঁরা বৃটিশ অফিসারদের হত্যা করেননি বরং তাঁদের পরিবার পরিজন-সহ নিরাপদে হাথরাসে বৃটিশ সেনা ছাউনিতে ফিরে যেতে দেন। সম্ভবত সিপাহি বিদ্রোহের রক্তাক্ত পরিণতির পর পুরো কেল্লাটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং পরিত্যক্ত হয়। জানা যায়, এই আলিগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁজখবরে সুপ্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার খোঁজ মিলেছে, নিদর্শন রয়েছে হিন্দু মন্দিরেরও। এইসব নিদর্শন কিছু রাখা আছে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির মিউজিয়ামে। দুর্গটিও তারাই দেখভাল করে। ওখানে বর্তমানে বোটানিক্যাল গার্ডেন তৈরি হয়েছে যার পরিচালনার দায়িত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ। দুটো জায়গাতেই ঘুরেফিরে দেখতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরের অনুমোদন প্রয়োজন।
এই আলিগড় সেই কবে থেকেই রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে। স্যার সৈয়দ আহমেদ খান যে আলিগড় আন্দোলনের সূচনা করেন সেটিই পরে পরিচিত হয় দ্বিজাতি তত্ত্বের সূতিকাগার হিসেবে। অনেকে বলে থাকেন এই বিষয়টিকে গ্রহণ করলে তাঁকেই পাকিস্তান গঠন ও দেশভাগের প্রবক্তা বলা যেতে পারে। তবে ইতিহাস সবসময় পাঠ ও আলোচনা করা উচিত সেই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। সেই পরিপ্রেক্ষিত কীভাবে তৈরি হয়েছিল অর্থাৎ পূর্বতন ঘটনাপঞ্জিকেও অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে। জাতি শব্দটিরও নানান সংজ্ঞা রয়েছে। বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক এর হাজারো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ভাষাগত, ধর্মগত, ভৌগোলিক অবস্থানগত, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত নানা পরিচয় মানুষের। মুসলিম অস্মিতা নিন্দনীয় হলে হিন্দু অস্মিতাও তাই। কে না জানে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তবেই জাতিগত অস্মিতা নিজেকে উন্নত করে চিন্তায়, যা ক্রমশ বৃহৎ জাতি গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করে। স্যার সৈয়দ আহমেদ খান এই কাজটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তার ফসল আজকের আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি। এখন যিনি যে শিক্ষায় শিক্ষিত তিনি সেভাবেই নিজের মনোমতো ব্যাখ্যা সাজাবেন।
এই যে আলিগড় তার প্রাচীন নাম কিন্তু কোল (kol)। স্থাননাম নিয়ে জানতে আর ভাবতে বেশ লাগে। এই বিষয়টায় বিশেষ আনন্দ পাই। এই কোল বা কোইল (koil) শব্দটির উৎস সন্ধানে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন এরা একটি পাহাড়ি উপজাতি। সেই পাহাড়টির নামই ছিল কোল, তাদের ভাষাও কোল ভাষা। কেউ বলেন এ এক সন্ন্যাসীর নাম। আবার এ নাম কোনও দানবের, এই মতও পাওয়া যায়। পুরাণেও কোল জাতির উল্লেখ আছে। স্কন্দপুরাণে বলা হচ্ছে এরা হিমালয়ে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর উপজাতি, ব্রহ্মবৈবস্বতে এদের বর্ণসংকর বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। শিবপুরাণে বলা হচ্ছে এটি সৌরথ রাজ্যের রাজধানী যা একসময় শাসন করতেন রাজা বিরাটের পুত্র। মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে কৃষ্ণের দাদা বলরাম এখানে কোলাসুরকে বধ করেন আহীরদের সাহায্যে।
আর একটি মত হল, দেবপ্রয়াগে চন্দ্রবংশীয় রাজা কোশাব রাজত্ব করতেন, তিনিই শহরের নাম দেন কোশাবি। পরে মথুরায় যখন রাজা কংস তখন তার প্রতিনিধি হয়ে এখানে শাসন করতেন রাজা কোল। কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করার পর বলরাম কোলকে পরাজিত করে এই রাজ্য দখল করেন। যে আলিগড় কেল্লার কথা এতক্ষণ বললাম সেটি নাকি তৈরি হয়েছিল একটি বিরাট উঁচু ঢিবির ওপর এবং স্থানীয় লোকজন জানতেন এটি ‘বলাই কেল্লা’-র ধ্বংসাবশেষ। বলরামের ডাকনাম বলাই। ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলজনক। আর এই কেল্লার নামও বেশ কয়েক বার পরিবর্তন হয়েছে। মহম্মদগড়ের পরে নাম হয় সাবিথগড়। পরে মারাঠারা কেল্লা দখল করলে নাম রাখে রামগড় (১৭৫৭), আবার ১৭৭৫-এ মুঘলদের কবজায় এসে পড়লে নামকরণ হয় আলিগড়।
এই আলিগড়ের অতি পরিচিত শিল্পসামগ্রী হল তালা। ভারতবিখ্যাত তো বটেই, এ তালার ভুবনজোড়া নাম। কবে থেকে শুরু হল আলিগড়ের এই গৌরব সামগ্রী উৎপাদন? ১৮৭০ সালে এক ভাগ্যান্বেষী ইংরেজ জনসন অ্যান্ড কোম্পানি নামে এক ফার্ম খোলেন ইংলন্ড থেকে তালা আমদানি করে আলিগড়ে বিক্রি করার জন্য। এর কুড়ি বছর পরে তারা নিজেরাই লোহার পাত কেটে, মোল্ডিং করে তালা তৈরি শুরু করে। ১৯৩০ সাল নাগাদ এই কোম্পানি ও আরও কতকগুলো কোম্পানি জার্মান তালার অনুকরণে লোহার শিট কেটে তালা উৎপাদন করতে থাকে। এই তালাগুলিই আলিগড় তালা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৫০-এ সুরিন্দর কুমার নামে এক আইনজীবী বিদেশ থেকে প্রযুক্তি, মেশিন ও ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে এসে আলিগড়ে তালা উৎপাদন শুরু করেন। তাঁর কোম্পানির তালা ভারত ছাড়িয়ে বিদেশেও পাড়ি দেয়। কিন্তু কোম্পানি বড় হতে পারিবারিক বিবাদ বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৯৭৫ সালে কোম্পানিতে লালবাতি জ্বলে। কোম্পানির কাজ হারানো কর্মীরা প্রায় সকলেই ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে তালা তৈরি শুরু করেন। পরবর্তী কালে বহু মুসলিম কর্মী পারিবারিকভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। অবশ্য দেশভাগের পরে সাময়িকভাবে এই শিল্প সমস্যায় পড়েছিল বেশিরভাগ দক্ষ কারিগর পাকিস্তানে পাড়ি দেওয়ায়। তবে সে শূন্যতা ভরাট হয় পাকিস্তান থেকে এদেশে আসা পাঞ্জাবি কারিগরদের দ্বারা। ১৯৭০-এ আলিগড় তালা কোম্পানিগুলি স্কুটার ও মোটরসাইকেলের তালা বানানো শুরু করে। বর্তমানে আলিগড়ে তালা শিল্প একটি হাব হিসেবে গড়ে উঠেছে।
আলিগড়ের আশেপাশে আরও অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে সিমেন্ট কারখানা, চিনি কল, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দেখা গেল। আশেপাশে চোখজুড়োনো সবুজ আর হলুদ শস্যপূর্ণ খেতের মাঝেই গড়ে উঠছে এইসব কারখানা। আলিগড় থেকে ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে নারোরায় গড়ে উঠেছে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প। তার জন্য গঙ্গা থেকে ক্যানাল কেটে জল আনার ব্যবস্থা করা আছে। ক্ষুদ্র শিল্পের মধ্যে বহু লোক জড়িয়ে আছেন কাচ ও চিনামাটির জিনিসপত্র তৈরিতে। আলিগড় থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে খুর্জা নামে একটি জায়গায় এই ক্রকারি শিল্প গড়ে উঠেছে এবং সেখানকার জিনিস নাকি বেশ সস্তা, শুনলুম গিন্নির মুখে।
সুতরাং ফিরতি পথে ব্যাগ বেশ ভারী হবে টব, কাপ, ফুলদানি গোত্রের জিনিসপত্রে আর আলিগড়ের তালা-সহ পিতলের গিফ্ট আইটেমে। ঠিক হ্যায় ম্যাডাম, আপকা সামান লেনে কে লিয়ে ইয়ে দুবলা কুলি হাজির হ্যায়।
Comments are closed.