বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

মিশমিদের দেশে

যত এগিয়েছি জঙ্গলের ভেতরে একটু একটু করে, জঙ্গল আমাদের সামনে নতুন নতুন চমক নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। পাহাড়ি ঝোরা, বিভিন্ন রকমের পাখি আর প্রজাপতি দেখে বা গুনে শেষ করা প্রায় অসম্ভব এই নামদাফার জঙ্গলে।

মনোজ গঙ্গোপাধ্যায়

 

পুজো আসছে, বেড়াতে যেতে হবে। নতুন জায়গার খোঁজ করতে গিয়ে অরুণাচল বা নেফার কথা আবার মনে পড়ল। তবে এবার একটু অন্যদিকে অন্যরকমভাবে নেফা বা অরুণাচলকে দেখার ইচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের একেবারে শেষ সীমানায় রয়েছে এক গহন অরণ্য। এই অরণ্যের নাম ‘নামদাফা’। এক অচেনার দেশ, এখানে মিশমি উপজাতির বাস। ট্যুরিস্ট খুব একটা আসে না এদিকে। প্রধানত বিজ্ঞানী আর অভিযাত্রীদেরই আনাগোনা এই দিকটায়। হরেক রকমের প্রজাপতির দেশ, আর আছে বিভিন্ন রকমের পশু, পাখি, নানা সরীসৃপ। সব থেকে বেশি আকর্ষণ করে উড়ন্ত কাঠবিড়ালি আর হুলকগিবন।
বন্দোবস্ত সেরে সপরিবার এ বছর অক্টোবরের তেরো তারিখে উঠে বসলাম কামরূপ এক্সপ্রেসে। গন্তব্য তিনসুকিয়া। পনেরো তারিখ ভোর চারটে নাগাদ পৌঁছে গেলাম নিউ তিনসুকিয়া জংশন। ওখানে আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন দীপংকর ফুকন। আগামী যাত্রা পথে ইনিই আমার সারথি। যেমন ভালো ড্রাইভার তেমনই ওঁর ব্যবহার আর ওই রাস্তার পাখি এবং বন্যপ্রাণ সম্বন্ধে অগাধ জ্ঞান। নিজগুণে অল্প সময়েই দীপংকর আমার পরিবারের বন্ধু হয়ে গেলেন।

মার্গারিটার পথে, ভোরের চা বাগান।

সকাল ছ’টার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম ডিগবয়। সবুজ চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে কালো মসৃণ পথ। একটু চা-বিস্কুট খেয়ে এগিয়ে চললাম মার্গারিটার দিকে। যতদূর চোখ যায় ঢেউ খেলানো সবুজ চায়ের বাগান। টাউনে ঢোকার মুখেই ডিহিং নদী। নদীর ব্রিজের ওপর থেকে ফটোসেশন কমপ্লিট করে নদীর পাড়ে ছোট্ট পিৎজার দোকানে ব্রেকফাস্ট সেরে এগিয়ে চলা মেও- এর দিকে। পথে নামচিক চেকপোস্টে আইএলপি দেখিয়ে অরুণাচলে প্রবেশ করতে হল।
মেও পৌঁছে ফিল্ড ডিরেক্টরের অফিস থেকে জঙ্গলে ঢোকার অনুমতি আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের রেস্ট হাউসে থাকার বুকিং সংগ্রহ করে এগিয়ে চললাম জঙ্গলের দিকে। পথে নোয়াডিহিং নদীর পাড়ে Pisi’s রেস্তোরাঁ এক অপূর্ব খাবার জায়গা। সেখানেই সেরে নিলাম আমাদের আজকের লাঞ্চ।
এই সুন্দরের দেশে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে চলে গেলাম মপেন চেকপোস্টের দিকে। সেখানে ঘরের ভাড়া আর এন্ট্রি ফি জমা করে এগিয়ে গেলাম ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট রেস্ট হাউসের দিকে। অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম শান্ত, নির্জন, জঙ্গলে ঘেরা নদীর পাড়ের ফরেস্ট গেস্ট হাউসে। নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে আর পাখিদের আওয়াজ শুনে কেটে গেল বেশ খানিক সময়। সন্ধে নামল যেন পাহাড়, জঙ্গলের গা গড়িয়ে। পাখিদের ঘরে ফেরার সময় তাদের আওয়াজ আরও বেড়ে গেল। অন্ধকার গাঢ় হতেই ভেসে আসতে থাকল নানা জন্তুর আওয়াজ। সঙ্গে টানা ঝিঁঝিপোকার ডাক। অন্ধকার জমাট হতেই ক্যামেরা হাতে, সার্চলাইট নিয়ে গাছের ওপরে খোঁজ চলছিল উড়ন্ত কাঠবিড়ালির। দেখাও পাওয়া গেল তাদের। রাতের অন্ধকারে বাংলোর হাতায় বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। চাঁদের আলোয় এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়েছিল জঙ্গলে। রাত ন’টায় রাতের খাওয়া শেষ করে আশ্রয় নিয়েছিলাম বিছানায়।

রাতের অন্ধকারে উড়ন্ত কাঠবিড়ালী

পরের দিন ভোরবেলায় ময়ূরের ডাকে ঘুম ভাঙল। অল্প সময়ে জলখাবার খেয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ি জঙ্গলের পথে আরও এগিয়ে দেখে আসার জন্য। যত এগিয়েছি জঙ্গলের ভেতরে একটু একটু করে, জঙ্গল আমাদের সামনে নতুন নতুন চমক নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। পাহাড়ি ঝোরা, বিভিন্ন রকমের পাখি আর প্রজাপতি দেখে বা গুনে শেষ করা প্রায় অসম্ভব এই নামদাফার জঙ্গলে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ গেছে নোয়াডিহিং নদীর পাশাপাশি বিজয়নগর অবধি। আমরা গিয়েছিলাম পঁচিশ মাইল পর্যন্ত। হালকা পান্না রঙের নদী আর ঘন সবুজ জঙ্গল হাতের ক্যামেরা আর মনের ক্যামেরা— দুটোকেই ব্যস্ত রেখেছিল পুরো যাত্রাপথ। কী দেখলাম তা যদি কিছুটাও লিখে বোঝানো যায়, কী পেলাম তা লিখে বোঝানো আমার পক্ষে অসম্ভব।
দুটো নাগাদ বনবাংলোয় ফিরে এসে লাঞ্চ সেরে রওনা হলাম পরশুরাম কুণ্ডের উদ্দেশে। পথ প্রায় দেড়শো কিলোমিটার, সময় লাগার কথা চার ঘণ্টা। পরশুরাম কুণ্ডের কাছেই ওয়াকরো টাউন। লোহিত নদীর পাড়ে ওয়াকরো পার করে অল্প দূরে নিনাসি হোম স্টে-তে আমাদের আজকের রাত্রিবাস। হোম স্টে-র মালিক নিনাসি, নিজের নামেই হোম স্টে-র নাম রেখেছেন। অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার আর যারপরনাই অতিথিবৎসল মহিলা।

রাস্তার ধারে চরছে মিথুন।

রাতের অন্ধকারে যখন পৌঁছেছি তখন থাকার জায়গাটাকে ঠিক অনুধাবন করতে পারিনি। পরদিন সকালে আবিষ্কার করলাম, আমরা রয়েছি একটা আস্ত চা-বাগানের মধ্যে। এটাকে হোম স্টে না বলে বোধহয় ফার্ম হাউস বলাই ভালো। গাছগাছালি আর চা-বাগান নিয়ে এক অনবদ্য তৃপ্তিদায়ক পরিবেশ। গৃহপালিত হিসেবে গোরু বা মোষ এখানে খুব একটা দেখা যায় না। যেটা পাওয়া যায় সেটা হল মিথুন। পুজো-পার্বণের সময় এরা এই মিথুন বলিও দেন।
সুস্বাদু খাবার সহযোগে এক রাত্তিরের এই অনবদ্য স্থান ছেড়ে সকাল আটটা নাগাদ রওনা হলাম পরশুরাম কুণ্ড দেখে ওয়ালং-এর দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। মাত্র বারো কিলোমিটার দূরে লোহিত নদীর কোলে পরশুরাম কুণ্ড ও পরশুরামের মন্দির। সময় লেগেছিল আধ ঘণ্টার মতো। মন্দিরে কাটালাম বেশ খানিকক্ষণ সময়। মনোরম পরিবেশ পাহাড়ের বেশ খানিকটা ওপরে, একদম কোলাহলবিহীন শান্ত জায়গা। মন্দির থেকে একটা পথ একটু ঘুরে নীচে নদীর ধারে চলে গিয়েছে। ওখানেই নদী ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দূর পর্যন্ত। লোহিত নদীর এই অংশটাকেই পরশুরাম কুণ্ড বলা হয়। এখানে স্নান করে মন্দিরে গিয়ে পুজো দেওয়াই এখানকার রীতি।

পরশুরাম কুণ্ড

পুজোপাঠের পরে লোহিত নদীর ধারে ধারে সোজা ওপরের দিকে উঠে যাওয়া। গন্তব্য হাইলং। লোহিত নদী, পাহাড়ি ঝরনা, প্রজাপতির ঝাঁক আর সবুজ পাহাড়ি প্রান্তর দেখতে দেখতে বার বার গাড়ি থামাতে বাধ্য হলাম। মাঝে মাঝে কয়েক জায়গায় রোড কাটিংয়ের জন্য দাঁড়াতে বাধ্য হলাম। অবশেষে হাইলং পৌঁছে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি।
অল্প কয়েকটা বাড়িঘর আর ছোট্ট একটা বাজার নিয়ে হাইলং। আর আছে আর্মি ক্যাম্প। মোমো, চাওমিন দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে কিছু সময়ের বিরতির পর আবার এগিয়ে চললাম ওয়ালং-এর দিকে। হাইলং-এর কাছেই খুপা, এই রাস্তার শেষ পেট্রোল পাম্প এখানেই, অগত্যা গাড়ির পেট্রোল এখান থেকেই ভরে নিতে হল। এদিকে রাস্তা সম্প্রসারণের বিরাট কাজ চলছে বি আর ও-র মাধ্যমে। তাই রাস্তায় বেশ কয়েক বার আরও দাঁড়াতে হল। অবশেষে ওয়ালং পৌঁছলাম সন্ধে নাগাদ।

পথের ধারে ঝরনা।

রাত্রিবাসের জন্য কয়েকটা হোম স্টে আছে এখানে, তবে সেখানে স্থান সংকুলান হল না। একদল  অ্যাডভেঞ্চারিস্ট সায়েন্টিস্ট আস্থানা গেড়েছেন একটু লম্বা সময়ের জন্য। তাই আরও ছ’কিলোমিটার এগিয়ে ডং রিসর্টে রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত করতে হল, একটু বেশি পয়সা দিয়ে। থাকার জায়গা হিসেবে এবং বন্দোবস্তর দিক থেকে ডং রিসোর্ট বেশ ভালো, তবে নগদ গুনতে হয় একটু বেশি।
এখানে পৌঁছতে একটু অন্ধকারই হয়ে গিয়েছিল, তাই আশপাশটা বিশেষ নজরে আসেনি। ডং-কে আবিষ্কার করলাম পরদিন ভোরে। এখানে একটা উষ্ণ প্রস্রবণ ধারা আছে। একেবারে লোহিতের পাড়ে হওয়ায় নদীটাও হাতের কাছেই। ভোরের মিঠে রোদে নদীর পাড়ে বেশ অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি চলল, সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে কেরামতি। শেষে উষ্ণ ধারায় অবগাহন সেরে রওনা দিলাম কিবিট আর কাহ দেখতে।

প্রজাপতির রঙের বাহার।

এই দুটো গ্রামই চিন বর্ডারের খুব কাছাকাছি। অসম্ভব সুন্দর এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য। দু’জায়গাতেই ইন্ডিয়ান আর্মির ঘেরাটোপ আছে, তাই চিনের আন্তর্জাতিক সীমান্তের বেশি কাছে যাওয়া যায় না। এই রাস্তায় পাহাড় অনেকটা লাদাখের মতো। বেশ রুক্ষ এবং পাথুরে। খয়েরি, কালচে, সাদা, ধূসর, সবুজ, কখনও বা হলুদ পাহাড়ের রঙের বাহার দেখার মতো। প্রকৃতি এখানে শুধুই সবুজ নয়, সবুজের সঙ্গে খেতগুলো পাকা ফসলের হলদে রঙে রাঙানো।

দ্য ল্যান্ড অফ রাইজিং সান, কাহো।

আমরা প্রথম পৌঁছলাম কিবিটে। এক সবুজ মায়াবী প্রান্তর, মাঝে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা এক মনেস্ট্রি। সবুজের রকমফের এখানে মন উদাস করে দেয়। তাকেই ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা ঘণ্টাখানেক ধরে। এর পর এগিয়ে চলা কাহোর দিকে। কাহো হচ্ছে সেই গ্রাম যে গ্রামে ভারতে সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়ে। বড়জোর কুড়ি-পঁচিশটা বাড়ি নিয়ে ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো সুন্দর এই গ্রাম। বড় ইচ্ছে হল এই গ্রামে একটা রাত কাটিয়ে যাওয়ার, যাতে পরের দিন সূর্যের প্রথম আলো এই গ্রামের ওপর পড়তে দেখতে পাই। আমি আর আমাদের ড্রাইভার দীপংকর দু’জনে মিলে একটু খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। উপায়ও বেরিয়ে গেল। গ্রামের সরপঞ্চ তার নিজের বাড়িতে থাকার অনুমতি দিলেন। এ যেন হাতের মুঠোয় স্বর্গ পাওয়া।
ছোট্ট গ্রামের বাড়ি আর সঙ্গে সেই পরিবারের আতিথেয়তা। আমরা প্রায় সম্মোহিতের মতো কাটিয়ে দিলাম একটা রাত সেই অমায়িক মানুষটির বাড়িতে। বাড়ির মহিলারা যত্ন করে আমাদের রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করে দিলেন।

সূর্যের প্রথম আলো।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম ভারতে প্রথম সূর্যের আলো। সে এক অপার আনন্দের অনুভূতি, লিখে বা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সূর্যের সেই আলো যখন গায়ে পড়ল তখন তাকে প্রকৃতির আশীর্বাদ বলেই মনে হচ্ছিল।
গ্রামের সব বাড়িই মূলত বাঁশ এবং কাঠ দিয়ে তৈরি। এরা প্রকৃতিকে ধরে রেখেছেন নিজেদের ভিটেয়, নিপুণ সুন্দর হাতের ছোঁয়ায়। গ্রাম থেকে একটু ওপরেই ভিউ পয়েন্ট। সেখান থেকে চিন সীমান্তের ওপারের বাসিন্দাদের বাড়িঘর দেখা যায়।

সকাল আটটা নাগাদ প্রাতরাশ সেরে লোহিতের পার ধরে ফিরে চলা আর এক সুন্দরের দেশে। এবার গন্তব্য রুইং হয়ে এনিনি-র দিকে। আজকের পথ অনেক লম্বা তাই একটু সকাল সকাল রওনা দিলাম। তেজু পৌঁছতে একটু বেলাই হল। এখানেই সেরে নিলাম দুপুরের খাওয়া। এবার গন্তব্য রুইং। তেজু থেকে রুইং রাস্তা বেশ ভালোই। দু’দিকে চায়ের বাগান। সন্ধের মুখে রুইং পৌঁছে গেলাম। শহরের একটু বাইরে ফোকমাউথ ক্যাম্পের তাঁবুতে আমাদের আজকের রাত্রিবাস। তাঁবু, কিন্তু বন্দোবস্ত পাঁচতারা না হলেও তিনতারার মতো। জঙ্গলের ভেতরে, পাহাড়ের ওপরে সে এক অভিযাত্রিক অভিজ্ঞতা। এক ভালোলাগার অনুভূতি পেলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্রমাগত ঘুরেই চলেছি, শরীর একটু বিশ্রাম চাইছিল, তাই এক দিন এখানে থেকেই গেলাম।

ফোকমাউথ ক্যাম্প।

রুইং বেশ বড় টাউন। সারাদিন শহরের বাজারে আর নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিলাম।  লোয়ার দিবাং ভ্যালি জেলার হেডকোয়ার্টার এই রুইং, দিবাং নদীর পাড়ে। মধ্যাহ্নভোজের জন্য গিয়ে বসলাম নাড়ুকা নামের এক রেস্তোরাঁয় একেবারে নদীর পাড়ে। যেমন এর অবস্থান তেমনই সুস্বাদু  এখানকার খাবার। একেবারে অরুণাচলের দেশজ রেসিপিতে বানানো। ডাইনিং হলে বসার বন্দোবস্ত  অরুণাচলের প্রথাগত কায়দায়।

রুইং-এর রেস্তোরাঁয়।

এ পথের পুরোটাই প্রজাপতি আর পাখিদেরর স্বর্গরাজ্য। গোটা বিকেলবেলা ক্যামেরা হাতে নীচের দিবাং নদী আর জঙ্গলের পাখি, প্রজাপতির সঙ্গে দৌড়োদৌড়িতেই পার হয়ে গেল। ঝিঁঝিপোকার ডাকে রাত ঘনাল।
পরের দিন সকাল সাতটা নাগাদ রওনা হলাম। আজ যাব এনিনি অবধি। ৮৭১১ ফিট উচ্চতার মায়োডিয়া পাস আমাদের আজকের পথের অন্যতম গন্তব্য। ঘণ্টা দেড়েকের যাত্রাপথে সাতান্ন কিলোমিটার পার হয়ে উঠে এলাম মায়োডিয়া পাসে। পাসের ওপর থেকে চারদিকের দৃশ্য বড়ই মনোরম। ঠান্ডাও একটু বেশি। এখান থেকে দূরে হিমালয়ের একটা বরফঢাকা পাহাড়চুড়ো দেখা যায়। প্রথমে মনে হয়েছিল চিন সীমান্তের ওপারে কোনও পাহাড়ের চুড়ো হবে। তবে পরে গুগলের সাহায্যে বুঝতে পারি, এর নাম হাক্কাকাবো রাজি (Hkakabo Razi), উচ্চতা ৫৮৮১ মিটার। মায়ানমার বা বর্মা দেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়চুড়ো।

হাক্কাকাবো রাজি শৃঙ্গ

এই মায়োডিয়া পাসে রয়েছে মায়াদিদির হোটেল। খুবই সাধারণ, তবে চা, জলখাবারের বন্দোবস্ত হয়েই যায়। কাছেই আছে ছোট্ট একটা থাকার আস্তানা, মায়োডিয়া কফি হাউস। দিদির হোটেলে চা, জলখাবার খেয়ে এগিয়ে চললাম এনিনি-র দিকে। দুপুর বারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম ইটালিন।  নদীর পাড়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। এখানেই সেরে নিলাম আজকের মধ্যাহ্নভোজ। নদী পার করে এবার এগিয়ে চলা সোজা এনিনি-র দিকে। এখানে দিবাং নদীকে ছেড়ে পেলাম ডিরি নদী। এদিকেও রাস্তা বানানোর কাজ চালাচ্ছে তাই গাড়ির গতিও অনেকটা কম।

পাহাড়ের গায়ে এনিনি গ্রাম

প্রায় ঘণ্টা তিনেকে পৌঁছে গেলাম এনিনি। বেশ বড়, ছড়ানো, ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। এখানে বেশ বড় আর্মি ক্যাম্প আছে আর আছে হেলিপ্যাড। প্রধানত মিশমি উপজাতির বাস এই গ্রামে। মিশমিদের দুটি ধারা রয়েছে। একটি হল দিগারু মিশমি (তারাওনস), আর একটি মিজু মিশমি (কামানস)। এরা মঙ্গোলয়েড। কথা বলেন তিব্বতি-মায়ানমারের মিশ্রিত ভাষায়। মিশমি ঐতিহ্যের ছোঁয়া পাওয়া যায় তাদের বাড়িঘরেও। তেমনই একটা হোম স্টে পাওয়া গেল যার নাম এনিনি হাট। এখানেই রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত করা হল। সে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। পাহাড়ের একেবারে টঙে মিশমিদের ট্র্যাডিশনাল কাঠের বাড়ি। বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি। অনবদ্য এর অবস্থান। এখান থেকে নীচে পুরো গ্রামটা দেখা যায়। বাড়ির অন্দরের বন্দোবস্ত একেবারে আধুনিক। বাড়ির মালিক অত্যন্ত মিশুকে আর গল্প করার লোক। তার সঙ্গে বসে গল্প শুনতে শুনতে পার হয়ে গেল অনেকটা সময়। অত্যন্ত যত্ন করে পরিবেশন করা রাতের খাবার সেরে যখন বিছানায় গেলাম তখন রাত প্রায় দশটা।
পরদিন ভোরে হালকা সূর্যের আলোয় কুয়াশার চাদর সরিয়ে এনিনি ধরা দিল এক অন্য রূপে। চারদিকে চেনা-অচেনা পাখির ডাক, দূরে কোনও বাড়ির চালার ওপর পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়ার কুণ্ডলী। প্রকৃতি এখানে উজাড় করে দিয়েছে তার সমস্ত রূপ ও সৌন্দর্য। ক্যামেরার লেন্সে চোখ লাগিয়ে ব্যস্ত থাকলাম বেশ খানিকক্ষণ। কিন্তু আমরা শহুরে মানুষ, তাই সমস্ত ভালোলাগা, ভালোবাসাকে পিছনে ফেলে নেমে আসতে হল নীচের দিকে।

মিশমি উপজাতির মহিলা

যে পথে উঠে গিয়েছিলাম সেই পথেই নেমে এলাম রুইং অবধি l এখান থেকে নতুন রাস্তা ধরে  লোহিত নদীর ওপরে ভারতের সবচেয়ে লম্বা ব্রিজ, সাড়ে ন’কিলোমিটারের ভূপেন হাজারিকা সেতু পার করে সোজা এসে পৌঁছলাম তিনসুকিয়ায়।
তিনসুকিয়ায় মাগুরি বিলের পারে মাগুরি ইকো ক্যাম্প এক অনবদ্য জায়গা। আমার ড্রাইভার দীপংকরের কথামতো রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত হল সেখানেই। ব্রহ্মপুত্র নদ, ডিব্রু সাইখোয়া ন্যাশনাল পার্ক, ডুমডুমা নদী এখান থেকে একেবারে কাছেই।

মেয়ে হুলকগিবন

কাছে-দূরে অনেক বার ডাক শুনেছি কিন্তু দেখা পাইনি, আর এত পথ ঘুরে এসে এখানেই দেখা পেলাম হুলকগিবনের। বাংলায় গিবন হল উল্লুক। হুলকগিবনের ডাককে ডাক না বলে শোরগোল বলাই বোধহয় ভালো। কেটে গেল অনেকটা সময়। একদিকে নদ-নদী আর বিল, আর একদিকে চা-বাগান। সঙ্গে হুলকগিবন আর নানা রকমের পাখি। পার হয়ে গেল দুটো দিন।
ডিব্রুগড় এয়ারপোর্ট থেকে উড়ে যাব কলকাতায়। তবে এর পরেও বাকি ছিল কিছু। দীপংকর ফুকন আদর করে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। সেখানেই খাওয়ালেন যত্ন করে। তার পরিবারের আতিথেয়তা মুগ্ধ করে দেওয়ার মতোই।

ব্রহ্মপুত্র নদ ওপাড়ে সাইখোয়া ন্যাশনাল পার্ক

ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝে ডিব্রু সাইখোয়া ন্যাশনাল পার্ক। চারদিকে জল দিয়ে ঘেরা একটা দ্বীপ। সেখানে বুনো ঘোড়া দেখতে পাওয়া যায়। সময়ের অভাবে অবশ্য এ যাত্রায় এই ইচ্ছেটা অপূর্ণই রইল। যা পেলাম তাই বা কম কী! অনেকদিন থেকে পুষে রাখা একটা স্বপ্ন তো একেবারে ষোলোকলায় পূর্ণ হল। ভরে রইল মন, ধরা রইল ক্যামেরায়। প্রকৃতির অকৃপণ শোভা আর কিছু ভালো মানুষের সান্নিধ্য তো কম পাওয়া নয়! মন আমাদের পরিপূর্ণ।

ছবি: লেখক 
1 Comment
  1. Udayan says

    Excellent write-up. Informative yet enchanting. Photos are very nice. Planning to explore Namdapha in the near future.

মতামত জানান

Your email address will not be published.