বা়ংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সাহিত্য পত্রিকা

ভূমিকম্পের উপত্যকায় একলা এক মেয়ে

কতটা মায়া থাকলে এভাবে একটা ধ্বংসস্তূপকে ভালবাসতে পারে মানুষ? আমরা, শহরের মানুষরা তো শিখেছি কেবল ভাঙতে। পছন্দ না হলে ভুলে যেতে, চিড় ধরলে ফেলে দিতে। সব হারিয়ে, সব যন্ত্রণা পার করে নতুন করে ভালবাসতে শিখেছি কি?

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

 

অক্টোবর, ২০১৬। সেবার কী জানি কোন পুণ্যের ফলে, বেশ ক’টা দিন ছুটি পাওয়া গেল, একেবারে আচমকা। আগে থেকে ঠিক ছিল না তাই পরিকল্পনাও করা হয়নি তেমন কিছু। কিন্তু পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা এ ছুটিকে কাজে না লাগালে বুঝি পাহাড়গুলো রাগ করবে না? তাই উঠল বাই তো এনজেপি যাই করে টিকিট কেটে ফেলতেই হল। নিকটতম পাহাড়ের দরজা নিউ জলপাইগুড়ি দিয়েই খোলে কিনা!
এনজেপি পৌঁছে সোজা শিলিগুড়ি, হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন অর্থাৎ ন্যাফের অফিসে। সেখানে আছেন অনিমেষ বসু, ন্যাফের কোঅর্ডিনেটর। বৃদ্ধ মানুষটি অবশ্য আমার কাছে অনিমেষদা এবং ন্যাফের মতোই, আমারও কো-অর্ডিনেটর। তাঁর কাছেই আবদার পেড়ে বসলাম। “দিন সাতেকের ছুটি। সঙ্গীসাথী কেউ নেই। কোথায় যাব, বলে দাও না!”
প্রথমে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও শেষে আমার ঘ্যানঘ্যানের কাছে হার মেনে, বেশ খানিকক্ষণ ভেবে, অনিমেষদা চোখ সরু করে বললেন, “লাংট্যাং ভ্যালি যাবি? নেপালে? গতবছর ভূমিকম্পের জ়িরো পয়েন্ট। স্ম্যাশড হয়ে গিয়েছিল উপত্যকাটা, এ বছর থেকে মনে হয় ফের রুট খুলছে। যাবি?”
বললাম, “যাব।” একটা ছোট্ট চিরকুটে খসখস করে ক’লাইন ব্রিফ করে দিলেন অনিমেষদা। বললেন, ‘‘যা দেখে আয়, কেমন আছে ভ্যালিটা।’’
তখনও নিশ্চিত জানি না, লাংট্যাঙের ট্রেক রুট কতটা খোলা, ট্রেক করার উপযুক্ত পরিকাঠামো আছে কিনা, থাকা-খাওয়ার জায়গা কোথায়, কেমন বা আদৌ আছে কিনা, গাইড পাব কিনা।জানি না, একা একা গোটা ট্রেকটা আদৌ করে ওঠা হবে কিনা। কিন্তু এটা জানি, যে যাবই। তার পরে দেখা যাবে।
ঠিক করলাম পরের দিনই সকালে বেরিয়ে পড়ব কাঠমান্ডু। ফ্লাইটের টিকিট নেই, তাই কাঁকরভিটা থেকে বর্ডার পেরিয়ে বাসেই যেতে হবে। রাতে ভাল করে রুকস্যাক গুছিয়ে নিলাম। ঘুম হল না ভাল। খানিকটা উত্তেজনায় আর খানিকটা লাংট্যাঙের ম্যাপ এবং ভূমিকম্পের খবরগুলো স্টাডি করতে গিয়ে।

ভারত-নেপাল সীমান্ত, কাঁকরভিটা

৪ অক্টোবর, ২০১৬। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়া। শিলিগুড়ি থেকে বাসে করে পানিট্যাঙ্কি, সেখান থেকে রিকশা করে মেচি নদী পেরিয়ে কাঁকরভিটা বর্ডার। কাঠমান্ডুর বাস মেলে সেখান থেকেই।
ঝকঝকে নীল-সাদা আকাশের তলা দিয়ে, মাঝে মাঝে কাশফুলের বন পেরিয়ে বাস ছুটে চলেছে অন্য দেশের সীমান্তের দিকে। কন্ডাক্টর দাদার “পানিট্যাঙ্কি পানিট্যাঙ্কি” চিৎকার শুনে গোদা রুকস্যাক সামলে হুড়মুড়িয়ে নামতে যাব বাস থেকে, রুখে দিলেন তিনি। বললেন, “তুমি তো ওপারে যাবে, নেপালে?” বললাম, “হ্যাঁ তো।”
“বোসো, লাইন পেরিয়ে গিয়ে স্ট্যান্ডে নেমো।“ একজনকে ডেকে তিনি বললেন, “ইরশাদ, দিদিকে একটু নিয়ে যাও তো সঙ্গে, একা আছেন। কাঠমান্ডুর বাসে তুলে দিয়ো।”
ইরশাদ দাদার সঙ্গে নামলাম কাঁকরভিটা। তখনও আমি জানি, এবার বাস ধরতে হবে কাঠমান্ডুর। লম্বা জার্নি সারারাত ধরে। কিন্তু ওই যে, পথের দেবতা মাঝেমধ্যেই প্রসন্ন হেসে ওঠেন! বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার ঠিক আগে ইরশাদ দাদা বললেন, “দাঁড়াও বইন, একটা চান্স নিয়ে দেখি তোমার জন্য।” কী চান্স? একটা ফোন করলেন কাকে যেন, আর ভদ্রপুর থেকে কাঠমান্ডু ফ্লাইটের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন একটা। খুব ভাল হল, অনেকটা সময় বাঁচল।
কাঁকরভিটা থেকে ভদ্রপুর এয়ারপোর্ট ঘণ্টা দেড়েকের পথ। কীসে যাব? ইরশাদ দাদা বললেন, ‘‘আমার বড় গাড়ি আছে, পৌঁছে দেব।’’ তখনও বুঝিনি, বড় গাড়ি মানে তেলের ট্যাঙ্কার! নেপাল অয়েল নিগম লিমিটেডে কাজ করেন ইরশাদ দাদা। ট্যাঙ্কার চালিয়ে তেল পারাপার করাই কাজ।

এই ট্যাঙ্কারে করেই নিয়ে গেলেন ইরশাদ দাদা

ভদ্রপুরে এয়ারপোর্টে ঢোকার মুখে নীল ইউনিফর্ম পরা এক অফিসার হাতে টিকিট নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আমার জন্য। সিনেমার টিকিট কাটার মতোই ওঁর হাতে টাকা দিয়ে, টিকিটটা নিয়ে ঢুকে পড়লাম এয়ারপোর্টে। খেলনা প্লেনের মতো ছোট ছোট প্লেনের ওঠা-নামা চলছে সমানে।
এক ঘণ্টার জার্নিতে কানে গোঁজার তুলো ছাড়াও মিলল বাদামভাজার প্যাকেট, লেবু-লজেন্স, কোল্ডড্রিঙ্কস। গোঁ গোঁ করে উড়ে চলেছে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের ছোট্ট প্লেনটা।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে মাছাপোখরি। ওখানকার বাসস্ট্যান্ড থেকেই ছাড়বে বাস স্যাফ্রুবাসি যাওয়ার বাস, সেই বাসে করে স্যাফ্রুবাসি পৌঁছে শুরু হবে ট্রেকিং। মাছাপোখরির বাসডিপো খুঁজে বার করে, স্যাফ্রুবাসির টিকিট কেটে ফেললাম পরের দিন সকালের বাসের।
বাসস্ট্যান্ডের কাছে সস্তায় একটা হোটেল পাওয়া গেল। খুব একটা কুলীন গোত্রের নয় সে হোটেল। ফাটা জিন্স, সোনালি গেঞ্জি আর কাঁটা কাঁটা হেয়ারব্যান্ড চড়ানো হোটেলের ছেলেটাকে একটু চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, “রাতবিরেতে কোনও ঝামেলা করবে না তো কেউ?” এতক্ষণ ধরে নেপালি ছাড়া একটাও অন্য শব্দ না বলা ছেলেটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ম্যায় হুঁ না!”

আকাশ থেকে দেখা নেপাল

পরের দিন, ৫ অক্টোবর। সকাল সাতটায় বাস ছাড়বে হোটেলের পাশ থেকেই। পৌনে সাতটা নাগাদ স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি, শহরের সমস্ত মানুষ যেন সকাল সকাল ওই স্ট্যান্ডেই জড়ো হয়েছে। সব  বাসের গায়েই নেপালিতে নম্বর লেখা। আমার টিকিটেও নেপালিতেই লেখা নম্বর। ভাবছি কাউকে জিজ্ঞেস করব, এমন সময় একটা বাচ্চা ছেলে নিজে থেকেই এগিয়ে এসে দেখতে চাইল টিকিট। চিপস বিক্রি করছিল ছেলেটা। টিকিট দেখেই বলে, “আরে, ওই তো, ওই বাসটা, ছেড়ে দিচ্ছে!” দৌড়ে গিয়ে চড়ে বসলাম! কিন্তু বাজে তো পৌনে সাতটা, সাতটার বাস ছাড়বে কেন? মনে পড়ল, নেপালের সময় পনেরো মিনিট এগিয়ে, আর আমার ঘড়ি ভারতের সময়েই পড়ে আছে। সুতরাং…।
যাইহোক, শেষে ওঠার কারণে বাসের লাস্ট সিটই জুটেছে। পাহাড়ি রাস্তায় যাঁরা বাসে চড়ে লংজার্নি করেছেন তাঁরা এই শেষতম সিটের মাহাত্ম্য বুঝতে পারবেন নিশ্চয়ই। ভাইব্রেশন নয়, জার্কিং মোডে শুরু হল যাত্রা। হিসেব ছিল, দুটো-তিনটের মধ্যে স্যাফ্রু পৌঁছে যাব। কিন্তু সাড়ে পাঁচটায় ধুঞ্চে অবধি পৌঁছনোর পর বাস বলল আর যাবে না। সব যাত্রী নির্বিকারভাবে নামতে শুরু করে দিলেন। বুঝলাম, এই রুটের বাসগুলোর এরকম যতটা খুশি চলে তার পর না যেতে চাওয়ার মধ্যে অবাক হওয়ার কোনও ব্যাপারই নেই।
ধুঞ্চেতে লাংট্যাং ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার পারমিশন করাতে হল ১৬৯৫ টাকা দিয়ে। ধুঞ্চে থেকে স্যাফ্রুর দূরত্ব বারো-তেরো কিলোমিটার। বাসেই আলাপ হয়েছিল লিরান আর স্যামের সঙ্গে। ওঁরাও লাংট্যাং ট্রেক করতে এসেছেন, ইজ়রায়েল আর ইংল্যান্ড থেকে। সঙ্গে ওঁদের গাইড, শিবরাজ আর সুনীল। সবাই মিলে কথা বলে ঠিক হল, বাকি রাস্তা হেঁটেই যেতে হবে। তবে মেন রোড নয়, পাহাড় বেয়ে, জঙ্গল দিয়ে নেমে গেলে সময় কম লাগবে অনেক।
প্রায় অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারছি না রাস্তার পাশের ঢালাও খাদ বেয়ে জঙ্গলে নেমে গিয়ে হেঁটে হেঁটে এতটা পথ পেরোনো আদৌ কতটা সম্ভব! অথচ উপায়ও তো নেই! নামা শুরু হল।
গাছ সরিয়ে, ঝোপে পা ডুবিয়ে, কাদায় প্যাচপেচিয়ে চলছি আমরা। কখনও নামছি, কখনও উঠছি। কখনও অনেকটা এগিয়ে গিয়ে দেখছি এগোনোর পথ নেই, আবার ফিরে এসে অন্য পথ খোঁজা। ঘণ্টা দেড়েক পর দূরে একচিলতে আলো দেখিয়ে শিবরাজ বলল, ওই দেখা যায় স্যাফ্রু! আমার তো মাথায় হাত, আজ রাতে পৌঁছব তো! তবে আরও ঘণ্টা দেড়েক পরে এসে গেল স্যাফ্রু।

স্যাফ্রুবাসি

যেকোনও ট্রেকিং শুরু হওয়ার পয়েন্টগুলো যেমন হয়, না শহর না গ্রাম, স্যাফ্রুও তাই। সামনেই যে হোটেলটা পাওয়া গেল, দেবেন্দ্র থাপার ইয়ালা পিক গেস্টহাউস— শিবরাজরা ঢুকে পড়লেন ওটাতেই। আমিও তাই। সারাদিনের শেষে রাত ন’টায় হোটেলে পৌঁছে, নুডুলস স্যুপে চুমুক দিয়ে, আরামের বিছানায় ঢলে পড়লাম।
পরের দিন, ৬ অক্টোবর। সকাল সাতটা নাগাদ স্যাক গুছিয়ে, জুতো পরে তৈরি আমি। পাঁউরুটি আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া গেল। বড্ড দাম সব খাবারের। মানে, এই যেমন ২০০ টাকায় দুটো পাঁউরুটি আর ৫০ টাকায় লাল চা! ভারতীয় মুদ্রায় অবশ্য একটু কম।
হাঁটা শুরু হল। মেন রোড দিয়ে মিনিট কুড়ি হেঁটে গিয়ে, ডানদিকে একটা ব্রিজ বরাবর নেমে যেতে হয়। ত্রিশুলি নদীকে ডানহাতে রেখে উঁচু-নিচু জঙ্গল-পাহাড় পথে হাঁটা। মাঝে মাঝেই ঝুলন্ত ব্রিজ পেরোতে হচ্ছিল, নদী কখনও ডানদিকে, কখনও বাঁয়ে। গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে গায়ে পড়ছে ঝিলমিলিয়ে। তার মাঝেই এমন এক-একটা জায়গা আসছে, গাছ ঘেরা, আলো-ছায়া, নিস্তব্ধ— মনে হয় যেন সময় থেমে গিয়েছে এখানেই। ফুরিয়ে গিয়েছে রাস্তা। মুখের ওপর ঝুঁকে পড়া গাছের ডালগুলো পার করে আলো দেখা হবে না বুঝি আর!

ভাঙা পথে

রাস্তায় যতজনের সঙ্গে দেখা, প্রথমেই বিস্ময়ে প্রশ্ন করে ‘‘আকেলো ছ?’’ আমি মাথা নাড়তেই আবার প্রশ্ন, ‘‘সাথী ছাই না? গাইড ছাই না?’’ অর্থাৎ ‘‘একাই আছ? সাথী নেই? গাইড নেই?’’ এবারও ঘাড় নেড়ে বলি, “আমার কেউ নেই, একাই চলেছি।” তখন হেসে বলে, ‘‘নেপালি ছোড়ি ছ।’’ নেপালি মেয়ে। আমি দাঁত বের করে ফের জবাব দিই, “কলকাতা থেকে আসছি, নেপালি নই।” একা একা, ইন্ডিয়ান মেয়ে, লাংট্যাং চলল—এরকম কথা ভেসে আসা বিস্মিত মুখগুলোকে পার করে হাঁটতে থাকি আমি।
কিছু পরে পেরোয় ডোমেন বলে একটা জায়গা, তার পর পাইরো। ছোট ছোট জনপদ পেরোতে পেরোতে হাঁটছি, থামছি, বসছি, ছবি তুলছি, যাকে পাচ্ছি তার সঙ্গে গল্পও করে নিচ্ছি খানিক ভাঙা ভাঙা নেপালিতে। একটাই রাস্তা, তাই হারিয়ে ফেলার ভয় ছিল না। পাইরোর পর থেকে গোটা রাস্তাটাই চড়াই। কোনও কোনও জায়গা প্রাণান্তকর। পিঠে ভারী রুকস্যাক আর গলায় ক্যামেরা নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে চলেছি।
আর কিছু পরেই আসবে ব্যাম্বু। ওখানেই থাকার কথা প্রথম দিন। কিন্তু তখন বারোটাও বাজেনি। তাই আমি ঠিক করে নিলাম, আরও একটু এগিয়ে লামা হোটেল বলে পরের জায়গাটায় চলে যাব। ব্যাম্বুর পরের জনপদ লামা হোটেল। এগোচ্ছি আর ভাবছি বেশ মজাই লাগছে তো একা একা ট্রেক করতে। বেশি বেশি করে ভাল লাগছে পাহাড়। এতদিন যেন দলবেঁধে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম, এবার যেন প্রথমবার বেরিয়েছি, প্রেমিকের সঙ্গে। যতটা বুক ছমছম, ততটাই ভাললাগা। পাহাড় তো নিজেই প্রেমিক!
তবে ব্যাম্বু পৌঁছনোর কিছু আগে থেকে এই একা চলা বেশ অন্যরকম হয়ে গেল। হঠাৎ শুনি কলকল করে কথা বলছে কারা। একটু এগোতেই একটা বাঁক পেরিয়ে চোখে পড়ল ওদের। একদল কচিকাঁচা, স্কুলের ছুটিতে পিঠে বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে কাঠমান্ডুর রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। লাংট্যাং ভ্যালি আর সংলগ্ন এলাকায় থাকে ওরা। বয়স ছয় থেকে পনেরোর মধ্যে। আমি ছবি তুললাম, গল্প করলাম হেসে হেসে। ওরাও ভারি মজা পেয়েছে, বেশ ‘নতুন বন্ধু’ টাইপের খাতির করে বলছে, ‘‘দিদি, আমাদের সঙ্গেই চলো, আমাদের সঙ্গেই খাবে, আমাদের সঙ্গেই থাকবে।’’

দেবদূতের দল সঙ্গী হল পথে

ওদের নাম নরচুম, সোপেমা, শিরিং, সোনাম বুট্টি, রিশে, পানজোর আর পেম্বা। পেম্বার ভাল নাম সন্দুপ। ও-ই সবচেয়ে বড়, চিল্লার পার্টির নেতা আর কি। একসঙ্গে ব্যাম্বু পৌঁছে লাঞ্চ করা হল। ভাত, কলাই ডাল, কী একটা তরকারি। তার পর ফের হাঁটা। এবার রাস্তা বেশ চড়াই। নরচুম নামে খুদেটার জ্বর, হাঁটতে পারছে না। ওর বইয়ের ব্যাগ আমার কাছে নিলাম। আমার ক্যামেরাটা নিল পেম্বা। পাহাড়ে এলে পাহাড়ি মানুষগুলোকে দিয়েই তো নিজেদের  লটবহর বওয়াই আমরা। উল্টোটার সুযোগ পেয়েছি, মন্দ কী! গল্প করতে করতে চলেছি। পড়াশোনা, ফুটবল, এনরিক, শাহরুখ খান— কিছু বাকি নেই। ভাবছি, এদের সঙ্গে নাকি ঘণ্টাখানেক আগে পরিচয় হয়েছে আমার!
লামা হোটেলে পৌঁছনোর পরে পেম্বা বলল, ওরা লামা হোটেলে থাকবে না, থ্যাংশ্যাপ অবধি এগিয়ে যাবে। আরও ঘণ্টা দুয়েক দূরের জনপদ। তিনটে বেজেছে তখন, সূর্য মুখ লুকিয়েছে। মেঘের দল নেমে নেমে আসছে পাহাড়ের গা বেয়ে। কনকনে হাওয়া তৈরি হচ্ছে মাঠ কাঁপাবে বলে। আমারও ক্লান্ত লাগছে খুব। তাই ওদের বললাম থ্যাংশ্যাপ চলে যেতে, পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পৌঁছে যাব আমি।
অর্ধ শতক আগে শিরিং লামা বলে এক ভদ্রলোক ছোট্ট একটা হোটেল খুলেছিলেন এখানে, নাম দিয়েছিলেন লামা হোটেল। তার পর আরও অনেক হোটেল-গেস্ট হাউস হয়েছে। কিন্তু গোটা জায়গাটার নাম থেকে গিয়েছে লামা হোটেল। পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ শিরিং লামার ‘অরিজিনাল লামা হোটেল’-এ উঠলাম খুঁজে খুঁজে। সন্ধেয় একটা রুটি আর অমলেট খেয়ে ঘুমোলাম। স্বপ্ন দেখলাম ভূমিকম্প হচ্ছে। কাঠের মেঝে দুলছে, টিনের চাল কাঁপছে।

এই সেই লামা হোটেল

ভোরে উঠে দেখি, ভাঙা গলায় অনর্গল নেপালিতে কীসব বলতে বলতে, হাত-পা নেড়ে কুয়াশা তাড়াচ্ছেন বৃদ্ধ লামা দাজু। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন শ্যাম তামাঙ্গ, একই হোটেলে থাকা এক ফরাসি দম্পতি ট্রেকারের গাইড। চোখ ঘষতে ঘষতে ঘর থেকে নেমে ভাবলাম, আমিও একটু কুয়াশা তাড়াই। কাছে পৌঁছে শুনি, কাল রাতে ঘর-বাড়ি নড়ছিল! সেই গল্পই করছেন হাত-পা নেড়ে। আমি ভাবলাম, বাহ্! আমিও তো বেশ পাহাড়ের মানুষের মতোই একই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি! তার পর ওই ফরাসি দম্পতি হন্তদন্ত হয়ে বলতে বলতে এলেন, কাল রাতে যে আর্থকোয়েক হয়েছে তা আমরা বুঝতে পেরেছি কিনা। দেখতে দেখতে ভিড়টা জমতে শুরু করল আর আমার ঘুমটাও কাটতে শুরু করল। সত্যিই নাকি হালকা ভূমিকম্প হয়েছিল রাতে!
সকালে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম শ্যাম তামাঙ্গের সঙ্গে। বেশ মন দিয়ে লাংট্যাং ভ্যালির ইতিহাস-ভূগোল বোঝালেন আমায়। ওঁর মাধ্যমেই ইন্টারনেটের বাইরে বেরিয়ে প্রথম পরিচয় হল উপত্যকাটার সঙ্গে। তিব্বত থেকে দলাই লামার নির্বাসন, এই পথে, এই উপত্যকা পেরিয়ে নেপালে আসা, তাঁর অনুগামীদের থাকতে শুরু করা, তিব্বতি সংস্কৃতির সঙ্গে নেপালি সংস্কৃতি মিশে গিয়ে স্বতন্ত্র এক উপত্যকা-সংস্কৃতি গড়ে ওঠার কথা।
৭ অক্টোবর। সাতটা নাগাদ হাঁটা শুরু। কুয়াশামাখা ভোরের ঠান্ডা চাদরে তখনও জড়িয়ে রয়েছে আলিস্যি। নরম সবুজ পাতার ডগায় জ্বলজ্বল করছে শিশিরকুচি। পাথর-মাটি চড়াই ভেঙে এগিয়েছে ভেজা ভেজা রাস্তা। ডানদিকের লাংট্যাং নদী কখনও পায়ের পাশে পাশে ছুটছে, কখনও আবার অনেক নীচে চলে যাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক হাঁটতেই একটা জায়গা এল, নাম তার ‘রিভারসাইড’।
হাঁটতে হাঁটতে রোদ উঠল কিছু পরে। পাহাড়ে সবসময়ই দেখেছি, একটুকু রোদ উঠতে শুরু করলেই মুহূর্তেই যেন কেমন যেন নরম হয়ে ওঠে চারপাশটা। কে বলবে তখন পাহাড় নাকি কঠিন, পাহাড় নাকি গম্ভীর!

সকালের কৈশোরে…

থ্যাংশ্যাপ এল একটু পরে। দেখা হয়ে গেল পেম্বাদের দলের সঙ্গে। কী হাসি, কী আনন্দ! যেন কতকালের পরিচিত মানুষের সঙ্গে কতযুগ পরে দেখা! ওরা একটু পরে রওনা দেবে। বলল, পেম্বার মামার গেস্টহাউস রয়েছে লাংট্যাং ভ্যালি পেরিয়ে মুন্ডু বলে একটা জায়গায়। লাংট্যাং থেকে মিনিট তিরিশ চড়াই। বার বার করে বলল, ওখানেই যেন উঠি। ওরা সবাই ওখানেই থাকবে।
আমি এগোতে লাগলাম। লাংট্যাং ভ্যালিটা ভাল করে ঘুরে দেখতে হবে আমায়। লক্ষ করলাম ভূমিকম্পের পরিস্থিতি। কয়েক জায়গায় রাস্তা একেবারেই ভেঙে গিয়েছে। গুঁড়ো পাথরের খাড়াই ঢাল। পা ফেললেই নেমে নেমে যায়। কোথাও আবার অনেকটা নেমে যেতে হয় পথ বেয়েই। সেখানে হয়তো নদীর একটা স্রোত বেঁকে গিয়ে এমনভাবে পথ আড়াল করেছে যে তা পেরোনোর উপায় নেই। ইতিমধ্যে মুখ দেখাতে শুরু করেছে বরফ-চুড়োগুলো। রোদ-মেঘের কনট্রাস্টে আস্তে আস্তে রূপ খুলছে প্রকৃতির।
বেলা বাড়তেই লুকোচুরি খেলতে শুরু করল রোদ্দুর। মেঘের দল এসে লুটোপুটি খেতে শুরু করল পায়ের কাছে, যেন কতদিন পর দেখা!
লাংট্যাং পৌঁছনোর কিছু আগে দেখা হল শিরিং দোলমা লামার সঙ্গে। আঠারো বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে। ওর গোলাপি জামার সঙ্গে মিলিয়ে যেন গোলাপি রোদে পুড়েছে গোলাপি গাল। একাই হাঁটছে মেয়েটা, পিঠে একটা বড় ব্যাগ। প্রথমে হাসি, তার পর কথা। বসলাম এক জায়গায়। দূর থেকে তখন একটা পাথুরে ধ্বংসস্তূপ দেখতে পাচ্ছি, সেটাই লাংট্যাং।

এই মৃত মহাদেশে… লাংট্যাং

পথের ধারে পাথরে বসে মেঘ মেখে গল্প করছি আমরা দু’জন। ও বলছে, আমি শুনছি। গতবছর, ২০১৫ সালের এপ্রিলে ক্লাস ইলেভেনের পরীক্ষা ছিল, তাই কাঠমান্ডুতে ছিল দোলমা। ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে ভয় পেয়েছে, স্কুল থেকে মাঠে বেরিয়ে এসেছে, সারা শহর জুড়ে আতঙ্ক দেখেছে। জেনেছে, লাংট্যাং উপত্যকাটা আর নেই। নেই মানে সত্যিই নেই। উপত্যকা ঘিরে থাকা লাংট্যাং লিরুং, লাংট্যাং টু— এই শৃঙ্গগুলো থেকে একাধিক দৈত্যাকার পাথর-মাটি-বরফ-ধুলোর তাল নেমে এসে চেঁছে ফেলেছে সবুজ উপত্যকাটাকে। একটা বাড়িও দাঁড়িয়ে নেই, বেঁচে নেই একজন মানুষও। দোলমার মা, বাবা, দিদি, কাকু, কাকিমা, মাসি, দাদু— কেউ বাঁচেননি সেদিন। সেই থেকে মেয়েটার কেউ নেই।
দোলমা সহজেই কথাগুলো বলছিল। মেঘ-রোদ্দুরে চোখের চিকচিক একবারের জন্যও উপচে পড়ল না ওর গোলাপি গালে। ভূমিকম্পের ক’দিন পরে উপত্যকায় ফেরার কথা, প্রিয়জনের ছিন্নভিন্ন দেহগুলো দেখার কথা, পাথরের স্তূপে নিজের বাড়ির চিহ্নও খুঁজে না পাওয়ার কথা, ঘনঘন আফটারশকের কথা বলে যাচ্ছিল।
দোলমা ছবিও দেখাচ্ছিল মোবাইলে। যেসব ছবিতে এখনও হাসিমুখে রান্না করছেন তার মা, দোলমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে দিদি। যেখানে এখনও দোলমার বাবা-মামা-কাকারা একসঙ্গে প্রার্থনা করছেন গুম্ফার পিঁড়িতে বসে। দাদু জপযন্ত্র ঘুরিয়ে চলেছেন আজও। কাকিমার চায়ের কাপ থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে। দোলমার ছোট দুই তুতো ভাইবোনের চোখের কোণ এখনও কুঁচকে রয়েছে উপচে ওঠা পাহাড়ি হাসির তোড়ে। সেইসব ছবিতে উপত্যকার রং আজও ঘন সবুজ। উপত্যকা আজও জমজমাট পাহাড়ি যাপনে।

জীবন তবু বয়ে চলে

দোলমা বলছিল, ফেরার লড়াইয়ের কথা। কোথায় ফেরা? কার কাছে ফেরা? আমার কষ্টকে বার বার ছাপিয়ে যাচ্ছিল বিস্ময়। এই এক বছরের চেষ্টায় দোলমা উপত্যকায় ফিরে একটা বাড়ির মতো কাঠামো খাড়া করেছে। কিছু বিদেশি আর ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং নেপাল সরকার এখনও ত্রাণ সামগ্রী পাঠায় উপত্যকায়। তাদেরই সাহায্যে নীল ফাইবারে ছাওয়া ছোট্ট কাঠের ঘরে হোম স্টে খুলে বসেছে মেয়ে।
“কেন দোলমা? এখানে কে আছে তোমার? লেখাপড়া করে কাঠমান্ডুতেই তো থাকতে পারতে, বাঁচতে পারতে শহরে।”
“এখানে আমার ঘর আছে দিদি, এটা আমার জায়গা! আমরা যদি কেউ না ফিরি তবে তোমরা কার কাছে আসবে বলো তো? উপত্যকাটা কী নিয়ে বাঁচবে তবে?”
লাংট্যাং ভ্যালিতে পৌঁছে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরলাম এদিক-ওদিক। পাথর-মাটির ভাঙাচোরা পেরিয়ে পেরিয়ে এক-একটা নতুন করে তৈরি করা ঘর। সব ঘরেই একই হাহাকার। কোনও রকমে বেঁচে যাওয়া গুটিকয়েক মানুষ প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে উপত্যকা সাজাচ্ছেন।

এভাবেই জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে এসে ঘর বানাচ্ছেন উপত্যকার মানুষ

কিছু কিছু ট্রেকার উপত্যকায় পৌঁছতে শুরু করেছেন ততক্ষণে। হোম স্টে থেকে সবাই মুখ বাড়িয়ে ডাকছেন তাঁদের, “আমার ঘরে এসো।” নামমাত্র টাকায় থাকতে দিচ্ছেন। অতিথির সামনে ধোঁয়া ওঠা নুডল স্যুপ এগিয়ে দিচ্ছেন হাসির ভাঁজে সব যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখে।
আমি ভালবাসা শিখে নিচ্ছিলাম আরও একবার। কতটা মায়া থাকলে এভাবে একটা ধ্বংসস্তূপকে ভালবাসতে পারে মানুষ? আমরা, শহরের মানুষরা তো শিখেছি কেবল ভাঙতে। পছন্দ না হলে ভুলে যেতে, চিড় ধরলে ফেলে দিতে। সব হারিয়ে, সব যন্ত্রণা পার করে নতুন করে ভালবাসতে শিখেছি কি?
বিকেল হয়েছে। স্যাক কাঁধে তুলে এগিয়ে গেলাম মুন্ডু যাব বলে। মেঘের দূরত্ব পেরিয়ে হাত নাড়লাম দোলমার দিকে।
মুন্ডুতে হিমালয়ান গেস্টহাউসে পৌঁছলাম। মেঘের ঢেউ ভেঙে ভেঙে তখন পাহাড়ের গায়ে নোঙর করেছে অন্ধকারের জাহাজ। পেম্বা দাঁড়িয়েছিল কাঠের দরজার সামনে। আমায় দেখেই লাফিয়ে উঠল। তার পরেই হইহই করে বেরিয়ে এল বাকিরা।
আগুন জ্বালিয়ে রান্না করছেন পেম্বার মামি আর মাসি। গোল করে ঘিরে বসে আছি সবাই। পাগুলো এগিয়ে রেখেছি আগুনের আঁচে। খিলখিলিয়ে গল্প করছে বাচ্চাগুলো। তার মাঝেই হাত-পা ছোড়া, চুল টানা, মারামারিও চলছে। কথায় কথায় জানলাম, পেম্বার মায়ের লাংট্যাঙে গেস্টহাউস ছিল। গতবছর ভূমিকম্পে শেষ। মা নেই ছেলেটার।
সন্ধে বাড়ছে, গল্পও বাড়ছে। আমি হাঁ করে শুনছি। শীতে-বর্ষায় কেমন করে থাকে ওরা, প্রতিবছর কেমন করে সীমান্ত পেরিয়ে তিব্বতে যায়। সীমান্তে কেমন সুন্দর একটা হাট বসে, সেই হাটে এখনও বিনিময় প্রথায় কেনাবেচা চলে। সেখান থেকে আনা কিছু তিব্বতি গয়না দেখাচ্ছিলেন পেম্বার মাসি। জোর করে দিয়েও দিলেন কয়েকটা জিনিস। এখান থেকে দু’দিনের হাঁটা পথ পেরিয়ে গাড়ি করে সীমান্তে যাওয়া যায়। কিন্তু ওই পথ কেবল নেপালের রসুয়া জেলার লোকেদের জন্যই। কারণ, এখানকার বেশিরভাগ মানুষই তিব্বতি, তাঁদের আত্মীয়স্বজনরা তিব্বতে থাকেন। অনেকের বাড়িও আছে সেখানে। রসুয়া ছাড়া অন্য কোনও জায়গার মানুষ ওই সীমান্ত পেরোতে পারবেন না। আমি তো গল্পে গল্পে তিব্বত প্রায় পৌঁছেই যাই আর কি!

মুন্ডু পৌঁছে, নতুন পরিবার

রাতে বাঁধাকপি আর ইয়াকের মাংস দিয়ে ঝোল ও মোটা মোটা রুটি। শোওয়ার পরে অনেক রাত পর্যন্ত অন্তাক্ষরীও চলল। ওরা নেপালি গান গাইছে একটা করে, আমি বাংলা। সে এক শোনার মতো জিনিস হয়েছিল বটে!
৮ অক্টোবর। সবাইকে বিদায় জানিয়ে পেম্বাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলাম ভোর ভোর। কেনজ়িং যাব। মুন্ডু থেকে ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা। কেনজ়িং ঘেঁষে দুটো ছোট পিক আছে, ম্যাপে দেখেছি। একটা কেনজ়িং রি (৪৭৭৩ মিটার) আর একটা চেরকো রি (৪৯৮৪ মিটার)। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারলে চড়া যাবে পিকে।
মুন্ডু থেকে কেনজ়িং, গোটা রাস্তাটা অসম্ভব সুন্দর ছবির মতো ফ্রেম চারপাশে। পাহাড়ে ভোর থেকে সকাল হওয়ার পর্বটা কী যে মায়াবী! নরম ঘাস আর মাটির হালকা চড়াই পথ। আশপাশে ইয়াক চরে বেড়াচ্ছে। ছানা-ইয়াকগুলো ভারি মিষ্টি। কিন্তু ভীতু, আদর করতে গেলেই মায়ের কাছে পালায়।
মেঘের ক্ষয়াটে চাদর সরে আকাশের চকচকে নীল স্কার্ফ বেরোচ্ছে একটু একটু করে। রোদ্দুর উঠছে খুব আস্তে, যেন মেঘের আড়াল সরিয়ে একটু বেশি মুখ বাড়ালেই শীত লেগে যাবে তার নাজুক গালে!
কিছুক্ষণ পরপরই চোখে পড়ে স্তরে স্তরে পাথর দিয়ে সাজানো, খোদাই করে ধর্মের বাণী লেখা কিছু লম্বাটে কাঠামো। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য প্রেয়ার ফ্ল্যাগে মোড়া, নীল ফাইবারে ছাওয়া সাদা পাথর দিয়ে তৈরি একটা গুম্ফা। ওটাই কেনজ়িং গুম্ফা। গুম্ফা পেরিয়ে আর অনেকটা মেঘ পেরিয়ে টুকি দিচ্ছে কয়েকটা বরফচুড়ো। কী অপরূপ!

মেঘের কোলে

পেম্বার সঙ্গে বকবক করতে করতে আর অজস্র ছবি তুলতে তুলতে সাড়ে ন’টার মধ্যেই কেনজ়িং ঢুকে গেলাম।
তখন সকাল সাড়ে দশটা। সব ঠিকঠাক থাকলে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে কেনজ়িং রি ক্লাইম্ব করা হয়ে যাবে। নীচে থেকে দেখা যাচ্ছে, বেশ খাড়াই ঢাল সোজা উঠে গিয়ে অনেকটা উঁচুতে একটা কালো পাথুরে মাথায় শেষ হয়েছে। ওটাই কেনজ়িং রি। আমি ঠিক করেছিলাম, পাশে যে আর একটা শৃঙ্গ চেরকো রি (৪৯৮৪ মিটার), সেটায় ঘুরে আসব। তিব্বতি ভাষায় রি মানে পিক। কিন্তু কেনজ়িঙের সবাই বলল, চেরকো রি গেলে বিকেলের আগে ফিরে আসা যাবে না। তাই কেনজিং যাব বলেই উঠতে শুরু করলাম। একাই। পেম্বা থেকে গেল নীচে।
যত উঠছি, পাহাড়টাও যেন আরও উঁচু হতে শুরু করল। যেকোনও পিকই তো তা-ই হয়। দূর থেকে দেখা একরকম, গায়ে বেয়ে বেয়ে ঘাড় উঁচু করে দেখা আর একরকম। হলদে-সবুজ ঘাস সটান উঠে গিয়েছে ঢাল বেয়ে।
এভাবে বেরিয়ে না পড়লে কত কিছু পাওয়া হত না কখনও! আসলে, বেরিয়ে পড়তে হয়। যেভাবেই হোক। নইলে বোঝা যায় না যে জীবনের কত ছোট ছোট চ্যাপ্টার ঘরে বসে কোনওদিনও শেখা হত না। জানা হয় না, পরিকল্পনাবিহীন ঘুরে বেড়ানো ব্যাপারটা আসলে দেখতে বা ভাবতে যতটা কঠিন লাগে, অনিশ্চিতের মাটিতে প্রথম পদক্ষেপটা ফেলে দেওয়ার পর আর ততটা কঠিন থাকে না। জানা হয় না নিজের অজানা স্কিলগুলো— তা চট করে নতুন ভাষা শিখে নেওয়াই হোক বা যেকোনও পরিস্থিতিতে অচেনা মানুষকে বন্ধু করে নেওয়া। কত গল্পের, কত মুহূর্তের, কত চিন্তার জন্মই হত না ঘুরে না বেড়ালে!

গাইড-ভাই পেম্বার সঙ্গে

আর একটু বাকি টপে পৌঁছতে। স্পষ্ট পথ নেই, তবে দুর্গমও নয়। আমার সঙ্গে দলে দলে মেঘও ওপরে উঠছে। শেষে বেশ খানিকটা কালো পাথুরে চড়াই। মানে একটা বড়, কালো, খাঁজ-খাঁজ পাথরই আসলে রয়েছে চুড়োয়।
ঘড়িতে বেলা সাড়ে বারোটা। তিনশো ষাট ডিগ্রি না হলেও, প্রায় দুশো সত্তর ডিগ্রি জুড়ে বরফের চুড়োগুলো দাঁড়িয়ে আছে হাত ধরাধরি করে। যেকোনও পাহাড়প্রেমীর কাছেই অত্যন্ত সুখের দৃশ্য। শুধু দৃশ্য নয়, একটা অনুভূতি। যে গিয়েছে সে বুঝবে। যে বোঝেনি, তাকে যেতে হবে।
ঘণ্টা দুয়েক সময় কাটালাম কেনজ়িং রি-এর মাথায়। অনেকগুলো দেশের পতাকা লাগানো ছিল, যেকোনও চুড়োয় যেমন থাকে। প্রেয়ার ফ্ল্যাগ তো ছিলই। কিন্তু আমার দেশের পতাকা ছিল না সেখানে। আমার সঙ্গে যদি থাকত, বেঁধে আসতাম। খুব আফশোস হল।

কেনজিং রি-র চুড়োয়

শীত করছিল বেশ, নামতে লাগলাম। বেশি সময় লাগল না। আমায় জ্যান্ত এবং সুস্থ ফিরতে দেখে পেম্বা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
সারা বিকেল-সন্ধে গল্প করে কাটল। তার পরে ডিনার। অত সকালে উঠেছিলাম, পিকে ওঠা-নামা, পেটভরা খাবার আর পাহাড়ি রেজ়াইয়ের উষ্ণতা… ঘুম আসতে দেরি হল না।
ঘুম ভেঙে গেল রাত দুটো সাতচল্লিশে। জানলা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই দেখি তারা-বোনা চাদরটা মাটিতে নেমে এসেছে। বাইরে বেরোলাম জ্যাকেট চাপিয়ে। অনন্ত, অফুরান, অপার্থিব এক অনুভূতি! দূরে দূরে সাদা চুড়োদের আবছা অবয়ব। সেখান থেকে ছুটে আসা হিমেল হাওয়া বুকের ভেতর পর্যন্ত জমিয়ে দেয়। তারার রাশি যেন ঘিরে আছে আমায়।

সার বেঁধে, মাথা তুলে

পরের দিন, ৯ অক্টোবর, ভোর ছ’টায় বেরিয়ে পড়লাম। এদিনই সোজা স্যাফ্রু পর্যন্ত পৌঁছনোর অলীক পরিকল্পনাটা করেছি। মানে যে পথ তিন দিন ধরে ওঠা, সেই পথই এক দিনে নামা। ম্যাপ বলেছে, প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ। পুরোটাই যদিও উতরাই।
পেম্বাকে ঘুম থেকে তুলে টা টা করে হাঁটা শুরু করলাম। মুন্ডু পর্যন্ত নেমে, মামিকে ডেকে তুলে চা খেলাম এক কাপ। নরচুম, সোপেমা, রিশে, সোনম বুট্টিদের সঙ্গে দেখা করলাম। রাশি রাশি মায়া কাটিয়ে এসে লাংট্যাং যখন পেরোলাম তখনও আটটা বাজেনি। মেঘে মেঘে ঘুমিয়ে আছে উপত্যকা।
লামা হোটেল পৌঁছতে বারোটা বেজে গেল। ততক্ষণে আমার পিঠের রুকস্যাকটা যেন আরও ভারী হয়েছে। ঢালাও উতরাই নেমে নেমে হাঁটুদুটো বিদ্রোহ করছে। লামা দাজুর হাতে নুডলস স্যুপ খেয়ে ফের স্যাক তুললাম। পাথুরে পথ দিয়ে হড়বড়িয়ে নামতে নামতে হাঁটুর বারোটা বাজতে লাগল। ব্যাম্বু লজে যখন ঢুকলাম যখন তখন তিনটে বেজে গিয়েছে।
লামা হোটেল পেরোনোর পর থেকেই উঠতি পথের ট্রেকারদের সঙ্গে দেখা হতে শুরু করেছিল। কেনজ়িং থেকে সোজা নামছি এবং আজকেই স্যাফ্রু যাব শুনে সবাই দারুণ অবাক! কেউ বলল নিশ্চয়ই নেপালি মেয়ে। কেউ বলল আমরা গাইডরাও এই এতটা পথ এক দিনে নামি না। এক ইংরেজ জেঠু আবার ‘ওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট’ ধরনের কী বললেন। তবে বেশিরভাগই এককথায় বললেন— পাগল।

ঘরে ফেরার গান

শেষের দিকে পায়ের পাতায় ফোসকা পড়ে গেল। হাঁটুজোড়া অবস্থান বিক্ষোভ ছাড়িয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে এগোতে লাগল। আর এর মধ্যেই মেঘ ও অন্ধকার দুইয়ে মিলে নেমে এল। এসবের মধ্যেই আরও ঘণ্টা দেড়েক গড়িয়ে গড়িয়ে স্যাফ্রুবাসির আলো দেখতে পেলাম। নিজেকে ঠেলতে ঠেলতে সেই দেবেন্দ্র থাপার ইয়ালা পিক হোটেলে ঢুকে পড়লাম। তার পরে শুধু নুডলস স্যুপ আর ঘুম। তবে পায়ে প্রবল ব্যথার কারণে ঘুম তেমন হল না ভাল করে। পাহাড়ি পথে চল্লিশ কিলোমিটার হাঁটা মুখের কথা নয়!
পরের দিন, ১০ অক্টোবর স্যাফ্রু থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত যাব বলে বেরোলাম। কিন্তু কোনও গাড়ি নেই! বাস তো নেই-ই। কারণ ওঁদের দশাই উৎসব চলছে। আমাদের যে বিজয়া দশমী, তাই ওঁদের দশাই। খুব বড় উৎসব। অনেক চেষ্টা করে একটা গাড়ির ব্যবস্থা হল। চড়া ভাড়া নেবে বলল। তাই সই। সকাল সাতটা নাগাদ গাড়ি ছাড়ল।
সন্ধেয় কাঠমান্ডুর ঠামেল পৌঁছে দেখলাম বেশিরভাগ দোকানপাটই বন্ধ দশাইয়ের জন্য। অনেক খুঁজে খুঁজে একটা ট্র্যাভেল এজেন্সি খোলা পেলাম, ফেরার ফ্লাইটের টিকিট কাটলাম। পরের দিন ফেরা। খুব মনখারাপ! কী সুন্দর উৎসবের সকাল আজ! সবাই কেমন নতুন জামা পরে, কপালে টিকা লাগিয়ে ঘর থেকে বেরোচ্ছে। চারদিকে কত প্রাণ! আমায় এসব ফেলে ফিরতেই হবে? কিন্তু না ফিরলে যে আবার নতুন করে আসা হবে না!
সেই ছোট্ট প্লেনে চড়ে ভদ্রপুর এসে পৌঁছলাম বেলা দশটা নাগাদ। মেচি নদীর সীমান্ত পেরিয়ে শিলিগুড়িতে ঢুকলাম। দশমী। সারা শহর জুড়ে বিসর্জনের সুর, চারদিকে সিঁদুর মাখা মুখ, ঢাকের বাদ্যি।

শিলিগুড়ি ফেরার পথে

এতগুলো দিনে এই প্রথমবার মায়ের জন্য বুকটা হুহু করে উঠল। ফোন করলাম। কথা হল। ওই কথাই যেন হয়ে উঠল আমার ঘরে ফেরার গান।

ছবি: লেখিকা 
মতামত জানান

Your email address will not be published.